আবার দেখা যদি হলো সখা...

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

ছবি তোলার জন্য অর্ধবৃত্তাকারে দাঁড়িয়েছিলেন একই রঙের শাড়ি পরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল প্রাক্তন ছাত্রী। এই উচ্ছ্বসিত সদ্য প্রাক্তন ছাত্রীদের হুড়োহুড়ির সময় ধাক্কা খেয়ে মাটিতে পড়ে গিয়েছিলেন তুরানী মাহফুজ, এই তরুণীদের বয়োজ্যেষ্ঠ সতীর্থ। হাত ভেঙে গেছে তাঁর। মুহূর্তে বিষাদের ছায়া পড়ল হাসিখুশি মুখগুলোতে। তুরানী মাহফুজকে ধরাধরি করে তাঁর কয়েকজন সহপাঠী বন্ধু নিয়ে গেলেন কাছের কোনো চিকিত্সাকেন্দ্রে। অনুতাপে ভরে গেল মন।

সেই অনুশোচনার বোধে দিনটা মাটি হয়ে যেতে পারত তরুণীদের। কিন্তু ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ফিরে এলেন তুরানী। ব্যান্ডেজ বাঁধা হাতটা গলার সঙ্গে ঝোলানো। অনুষ্ঠানস্থলে ফিরেই হাসিমুখে ছবি তুললেন সেই স্নেহভাজন সতীর্থ তরুণীদের সঙ্গে। সকালটা আবার আলো ঝলমলে হয়ে উঠল। এই একটি ঘটনাই যেন পুরো উৎসবের প্রতীকী চিত্র। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত প্রথম পুনর্মিলনী উৎসবটি (২১ ও ২২ নভেম্বর) ছিল এ রকমই ভালোবাসা-মমতা-সৌহার্দ্য-সম্প্রীতিতে মোড়ানো।

প্রথম দিন বিকেলে চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে সিআরবির শিরীষতলা পর্যন্ত প্রকৃত অর্থেই এক বর্ণময় শোভাযাত্রায় অংশ নিয়েছিলেন হাজার হাজার শিক্ষার্থী। শিরীষতলায় বাউলগানের আসর চলেছিল রাত অবধি। পরদিন সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত নগরের জিইসি কনভেনশন সেন্টারে ছিল কথামালা, আড্ডা, খাওয়াদাওয়া, স্মৃতিচারণা আর গান। এ রকম বিরাট আয়োজনে কোথাও কোনো ত্রুটি ছিল না, তা তো নয়। কিন্তু কী আশ্চর্য, কারও কোনো অভিযোগই নেই যেন। হাজার লোকের সমাগম (রেজিস্ট্রেশন করেছেন সাড়ে আট হাজার প্রাক্তন শিক্ষার্থী) অথচ কোথাও একটু কলহ, সামান্য বচসা, এমনকি রাগ-অভিমানের দৃশ্যও চোখে পড়ল না। এ যেন প্রাণের টানে ছুটে আসা, অতীতকে আরও একবার বর্তমানের কাছে আনার চেষ্টা, ‘মাঝে হলো ছাড়াছাড়ি গেলেম কে কোথায়, আবার দেখা যদি হলো সখা প্রাণের মাঝে আয়।’

১৯৬৬ সালে বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস ও অর্থনীতি—এই চারটি বিভাগ আর মাত্র ২০৪ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু এই বিশ্ববিদ্যালয়ের। সেই হিসাবে অর্ধশতাব্দী পেরিয়েছে। এখন এটি পত্র-পুষ্প-পল্লবে বিকশিত একটি বৃক্ষ। বিষয়ভিত্তিক ৫০টির বেশি বিভাগে প্রায় ২৮ হাজার শিক্ষার্থী ও ৮৭২ জন শিক্ষকের বিশাল কর্মযজ্ঞ এখানে। পাহাড় ও এর পাদদেশে কলা, বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, ব্যবসায় প্রশাসনসহ বিভিন্ন অনুষদ ভবন, গ্রন্থাগার, মিলনায়তন, জাদুঘর ও প্রশাসনিক ভবন, আটটি ছাত্রাবাস, চারটি ছাত্রীনিবাসসহ বিরাট এক অবকাঠামো। আয়তনের দিক থেকে দেশের সবচেয়ে বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শুধু নয়, পাহাড়-অরণ্য-ঝরনা-হ্রদবেষ্টিত প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যেরও অকৃপণ বিস্তার এখানে।

প্রতিষ্ঠার পাঁচ দশক পেরিয়ে এসে আজ বহু ইতিহাসের সাক্ষী এই বিশ্ববিদ্যালয়। সেই উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছিলেন সদ্য প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন চাকসুর সাধারণ সম্পাদক আবদুর রবসহ ১২ জন শিক্ষার্থী, একজন শিক্ষক এবং মোহাম্মদ হোসেন বীর প্রতীকসহ এই প্রতিষ্ঠানের দুজন কর্মচারী। আবার নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনের সময়েও দ্রোহে-ক্ষোভে রাজপথ মুখর করেছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। মোজাম্মেলের মতো তরুণ তাজা প্রাণের আত্মাহুতির বিনিময়ে ত্বরান্বিত হয়েছিল স্বৈরাচারের পতন।

গৌরবের সমাচার কম কিছু নেই। এ দেশের একমাত্র নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস ছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। আবুল ফজল, এ আর মল্লিক, আর আই চৌধুরী, আবদুল করিম, আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজউদ্দিনের মতো বরেণ্য শিক্ষাবিদেরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেছেন বিভিন্ন সময়ে। মন্ত্রী, সচিব, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা, বিজ্ঞানী, শিল্পী, লেখক, শিক্ষক, সাংবাদিক, ব্যাংকার, শিল্পোদ্যোক্তা হিসেবে নানা পেশায় নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করেছেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। আর তাঁদের শিক্ষক ছিলেন জামাল নজরুল ইসলাম, আনিসুজ্জামান, আহমদ শরীফ, মুর্তজা বশীর, এখলাস উদ্দিন আহমদ, অনুপম সেন, হুমায়ুন আজাদ, সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদের মতো সৃজনমুখর মননশীল মানুষেরা। সব মিলিয়ে অর্ধশতাব্দীর ইতিহাসের অনেকটাই গৌরবোজ্জ্বল।

প্রথম পুনর্মিলনী উৎসবে উপস্থিত হয়েছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচের ছাত্র সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। ১৯৬৮ সালে অর্থনীতি বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন তিনি। সফেদ পাজামা-পাঞ্জাবি আর সাদা শ্মশ্রুমণ্ডিত এই প্রৌঢ় যেন নিজের তারুণ্যকে ফিরে পেলেন সেদিন। বিভিন্ন বয়সের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছবি তুলছিলেন, হাসি-আড্ডায়–স্মৃতিচারণায় মাতিয়ে রেখেছিলেন চারপাশ। বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়েছেন প্রায় পঞ্চাশ বছর হয়ে গেল। কিন্তু পুনর্মিলনীতে এসে যেন ক্যাম্পাস-জীবন ফিরে পেয়েছেন। বয়োজ্যেষ্ঠ হিসেবে অনুজ শিক্ষার্থীদের শ্রদ্ধা-ভালোবাসা পেয়ে আনন্দিত। শুধু সহপাঠী বন্ধুদের কথা মনে করতে গিয়ে একটু আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন যেন, হাহাকারের মতো শোনাল তাঁর কণ্ঠ, ‘আমরা ২৫-৩০ জন ছিলাম, কিন্তু আজ আমি ছাড়া তো কেউ বেঁচে নেই!’

পুনর্মিলনী যেন বর্তমানের পরিচয় ও পদপদবি ভুলে ছাত্রজীবনের সেই বন্ধুদের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া, যেখানে একটা পরিচয়ই বড় হয়ে ওঠে সবকিছুকে ছাপিয়ে—বন্ধু!

এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র কয়েকজন মন্ত্রী, সাংসদ, সরকারি আমলা উপস্থিত ছিলেন পুনর্মিলনীতে। কিন্তু প্রটোকল ভেঙে তাঁরা মিশে গেছেন ভিড়ে, বন্ধুদের সান্নিধ্যে। আবদার মেটাতে ছবি তুলেছেন অনুজের কাঁধে হাত দিয়ে। তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ তো স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বলেই ফেললেন, ‘প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় শাটল ট্রেনে গলা ছেড়ে আমিও গান গাইতাম। অনেক দিন পর আজ চেনা মুখগুলো দেখছি। তাদের দেখে আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে। বন্ধুদের নিয়ে যদি আবারও শাটলে গান গেয়ে ক্যাম্পাসে যেতে পারতাম।’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিবার্য অনুষঙ্গ শাটল ট্রেনের স্মৃতিটা আরও একবার উসকে দিয়েছিলেন শিল্পী নকিব খান। রাতে গানের আসরে তিনি ব্যান্ড দল ‘সোলস’ এর সূচনালগ্নের সেই জনপ্রিয় গানগুলো গেয়ে শোনালেন, যেগুলো প্রায় প্রতিদিনই শাটল ট্রেনের বিভিন্ন বগিতে গাইতেন ছাত্রছাত্রীরা। উৎসব শেষে ফিরে গেছেন প্রাক্তনরা। কিন্তু তার রেশ যেন ফুরাল না। ‘মুখরিত জীবনের চলার বাঁকে’ পুরোনো দিনগুলো আবার বারবার সুর তুলবে তাঁদের মনকে ঘিরে।

পুনর্মিলনীর দুই দিনের উৎসব একটা বার্তা দিয়ে গেল যেন—শত্রুতা, ঈর্ষা, সংকীর্ণ গ্রুপিং আর দলীয় রাজনীতির ভেদাভেদ সাময়িক; কিন্তু বন্ধুত্ব ও সহমর্মিতা দীর্ঘস্থায়ী। আজ যাঁরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, তাঁরা যদি এই বার্তাটি উপলব্ধি করতে পারেন, তবেই শাটল ট্রেনের যাত্রাটা আবার প্রাণবন্ত ও আন্তরিক হয়ে উঠবে।

বিশ্বজিৎ চৌধুরী প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক, কবি ও সাহিত্যিক