সিগারেট তুমি কার?

পান আর সিগারেটের মধ্যে পার্থক্য সামান্যই। পানের চুন-তামাক মুখগহ্বরের ক্ষতি করতে করতে পাকস্থলীতে পৌঁছায় আর সিগারেটের ধোঁয়াও মুখগহ্বরের ক্ষতি করতে করতে ফুসফুস শেষ করে দেয়। দুটোই ক্যানসারের কারণ। চিকিৎসকেরা বলেন, পান-তামাক ধূমপানের চেয়েও ক্ষতিকারক। কিন্তু ধূমপানে যে লুকোচুরি, পান-জর্দায় তা নেই।

পান-চিনি বিয়ের একটি অন্যতম অনুষঙ্গ। বিয়ের ভূরিভোজের পর পান-জর্দা না পেলে চাই কি বিয়ের আসর ভন্ডুলও হয়ে যেতে পারে। অথচ চলচ্চিত্রের নায়কেরা নায়িকাদের ইম্প্রেসড করতে এবং ঘোর মানসিক সংকটে সিনেমার পর্দা ধোঁয়ায় ধূসর করে তোলেন। বারবার সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ ভেসে ওঠে ‘ধূমপান স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর, ধূমপান ক্যানসারের কারণ’। ওতে অভিনেতা বা পরিচালকদের জেল-জরিমানা হয় না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধূমপান পৌরুষ প্রমাণের হাতিয়ারও বটে।

তবে বিড়ি-সিগারেট-পান-জর্দা-মদ বা অন্যান্য নেশাদ্রব্য গ্রহণ-সেবনের সঙ্গে জেন্ডার বৈষম্য বিবেচনা নিরর্থক। উত্তরাঞ্চলের কোনো কোনো এলাকায় নারীরা প্রকাশ্যে ধূমপান করে। বড় বড় শহরে দিনমজুর নির্মাণশ্রমিক নারীরা (মনে হয় তাঁরা বেশির ভাগই উত্তরাঞ্চল থেকে আসেন) জিরিয়ে নেওয়ার সময় বেশ সুখটান দেন। বঙ্কিমচন্দ্র-শরৎচন্দ্রের অনেক নারী চরিত্রের গড়গড়া সেবনে বিশেষ মর্যাদা প্রদর্শিত হয়েছে। খোঁজ নিলে দেখা যাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন ছাত্রীকে ধূমপানের জন্য যে হল অভিভাবক সিট বাতিল করেছেন, তিনি নিজেও হয়তো পান-তামাকে আসক্ত।

বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘...আইনের দ্বারা নির্দিষ্ট অন্যবিধ প্রয়োজন ব্যতীত মদ্য ও অন্যান্য মাদক পানীয় এবং স্বাস্থ্যহানিকর ভেষজের ব্যবহার নিষিদ্ধকরণের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবে।’ সংবিধান নারী-পুরুষনির্বিশেষে পালনযোগ্য। সংবিধান লঙ্ঘন করে বা সংবিধানপরিপন্থী নীতিমালা কোনো প্রতিষ্ঠান নির্ধারণ করতে পারে না। তামাকও যদি ‘স্বাস্থ্যহানিকর ভেষজ’–এর অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে, তাহলে তার ব্যবহার নারী-পুরুষ সবার জন্যই নিষিদ্ধ হওয়া উচিত।

ছাত্রদের কোনো আবাসিক হল কি ধূমপানমুক্ত? যুগের পর যুগ ছাত্ররা প্রকাশ্যে–অপ্রকাশ্যে শিক্ষাঙ্গনে ধূমপান করে আসছেন, মাদক গ্রহণ করছেন। ধূমপানরত অবস্থায় অসাবধানতায় শিক্ষক বা অভিভাবকদের সামনে পড়ে গেলে বড়জোর পেছনে হাত লুকিয়ে ফেলছেন বা জুতার তলে রেখে দিচ্ছেন। ধূমপান স্বাস্থ্যের পক্ষে হানিকর বা বদভ্যাস, যা নারী-পুরুষ উভয়েরই থাকতে পারে। এটা পুরুষের একচেটিয়া নিরপরাধ বদভ্যাস নয়। ছাত্রাবাস সৃষ্টির পুরাকাল থেকে এ পর্যন্ত শুধু ধূমপানের কারণে কোনো ছাত্রকে বহিষ্কার করা হয়েছে বলে কেউ কখনো শোনেনি। প্রথম আলোর খবরে প্রকাশ নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ধূমপান করায় দুই ছাত্রীর সিট বাতিল’।

জেন্ডার-ধারণায় সমাজসৃষ্ট শ্রম বিভাজনে ঘরের কাজ, বাইরের কাজ যেমন নারী-পুরুষের জন্য নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে, তেমনি কোনটা পুরুষালি নেশা ও কোনটা মেয়েলি নেশা, তা-ও সমাজ তথা পুরুষেরই তৈরি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিমল মিত্ররা যখন তাঁদের উপন্যাসে নারীর মদ্যপানের চিত্র তুলে ধরেছিলেন, তখন তা পাঠকের কাছে অভাবনীয় বিস্ময়কর ঠেকেছে। বুদ্ধদেব বসু তাঁর বিদেশে পড়াশোনা করতে যাওয়া কন্যাকে গোমাংস খেতে বলেছিলেন।

বলছি না যে পুরুষ ধূমপান করলে নারীকেও করতে হবে। তবে ধূমপান এমন কোনো গর্হিত অপরাধ নয় যে নারীর শিক্ষাজীবন হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়বে। জেন্ডার সমতার এ যুগে যাঁরা গৃহে পুরুষ সদস্যকে রান্না, ধোয়ামোছার কাজ করতে দেখে ‘জাত গেল জাত গেল’ বলে মাথা চাপড়ান, সেসব মানসিকতার ধ্বজাধারীরাই নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-অভিভাবক। যদি ধূমপায়ী শিক্ষার্থীদের আবাসিক হলের সিট বাতিল করতে হয়, তবে সবার আগে পুরুষ শিক্ষার্থীদের করতে হবে। তখন ঠগ বাছতে কীভাবে গাঁ উজাড় হয়, তা সবাই দেখতে পাবে।

ধূমপানকে নারী-পুরুষ-তৃতীয় লিঙ্গনির্বিশেষে ক্ষতিকারক হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। এটা আশা করাও অন্যায় হবে না যে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ধূমপায়ী ছাত্র তাঁদের দুই ছাত্রীবন্ধুর লঘু পাপে গুরুদণ্ডের প্রতিবাদে সোচ্চার হবেন। যেসব শিক্ষক পুরুষের ধূমপানকে পৌরুষত্বের প্রতীক ভেবে ছাড় দেন আর নারীদের ধূমপানকে ‘মায়ের জাতের কলঙ্ক’ বলে শিক্ষাজীবন প্রতিহত করেন, সেসব শিক্ষক অতিসত্বর দুঃখ প্রকাশ করে বহিষ্কৃত ছাত্রীদের হলে পুনর্বাসন করবেন বলে দাবি করি। সেই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কাছে আবেদন, শিক্ষকদের, বিশেষ করে আবাসিক হলের হাউস টিউটর ও প্রভোস্টদের জেন্ডার ধারণার ওপর অবিলম্বে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ, আমাদের দেশে আবাসিক হোস্টেল সৃষ্টির পর থেকেই, বিশেষ করে ছাত্রী হলের শিক্ষক-অভিভাবকদের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার দৌরাত্ম্যে শিক্ষার্থীদের জীবন একেবারে অতিষ্ঠ।

উম্মে মুসলিমা: কবি ও কথাসাহিত্যিক
[email protected]