ভারতীয় সেক্যুলারিজমের অগস্ত্যযাত্রা

নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে
নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে

ভারতের লোকসভায় নাগরিকত্ব সংশোধন বিল, ২০১৯ পাস হয়েছে। অনেক হই–হট্টগোল আর সাত ঘণ্টা তুমুল বিতর্কের পর ৯-১০ ডিসেম্বর মধ্যরাতে বিলটি পাস হয় ৩১১-৮০ ভোটের ব্যবধানে। এখন রাজ্যসভায় পাস হলে বিলটি আইনে পরিণত হবে। এ আইন অনুযায়ী মুসলমানদের বাদ দিয়ে বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান থেকে ভারতে চলে আসা হিন্দু এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বী মানুষদের ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়া যাবে। এ লক্ষ্যে এরূপ লোকদের ক্ষেত্রে নাগরিকত্বের জন্য ভারতে অবস্থানের ন্যূনতম মেয়াদও কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিতর্ক চলাকালে, কংগ্রেস, তৃণমূল এবং বাম গোষ্ঠী এর প্রবল বিরোধিতা করে। তবে লোকসভায় তাদের সংখ্যাস্বল্পতার কারণে, বিল পাসে বিজেপি কোনো সমস্যায় পড়েনি। পক্ষে-বিপক্ষে ভোটের ব্যবধানেই বিষয়টি প্রতীয়মান। 

 দেশভাগের দ্বিজাতি তত্ত্ব নতুন করে প্রবর্তনের অভিযোগ উঠেছে ক্ষমতাসীন দল বিজেপির বিরুদ্ধে। রাজ্যসভার বর্তমান কার্যকরী সদস্যসংখ্যা ২৪০ জন। বিল পাসে দরকার ১২১ ভোট। ১২৮ জন সমর্থক আছে বিজেপি এবং সহযোগী দলগুলোর। ভোটে দেওয়া হলে তা পাস হতে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। ক্ষমতাসীন বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ যে রকম দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে নেমেছেন, ধরে নেওয়া যায় যে বিলটি তিনি পাস করিয়েই ছাড়বেন, যত সমালোচনা বা বিরোধিতাই হোক না কেন। 

নাগরিকত্ব সংশোধন বিলের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই ভারতের বিভিন্ন রাজ্য প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। বিক্ষোভ শুরু হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম এবং উত্তর–পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোয়। অন্যান্য রাজ্যেও পক্ষে–বিপক্ষে বক্তৃতা–বিবৃতি চলছে। তবে সব বিক্ষোভের কারণ এক নয়। পশ্চিমবঙ্গে বিক্ষোভ হয়েছে, কারণ বিলটি মুসলিমবিরোধী। অন্যদিকে আসামে বিক্ষোভের কারণ ভিন্ন, তারা চায় হিন্দু-মুসলিম যাই হোক আসাম থেকে সব বাংলাভাষীর অপসারণ। পরস্পরবিরোধী হলেও আসামে অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন এবং বাম দলগুলো—উভয় পক্ষই হরতাল ডেকেছে এই বিলের বিরুদ্ধে। আসামের মুখ্যমন্ত্রী আটকা পড়েছেন বিমানবন্দরে। আসাম ও ত্রিপুরার বিক্ষোভ বেশ সহিংস রূপ নিয়েছে। আসামে বিক্ষোভকারীরা পথে আগুন জ্বালিয়ে তাঁদের ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। পুলিশ বিক্ষোভ দমনে ফাঁকা গুলি চালিয়েছে। সেখানে সেনাবাহিনীকে পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ত্রিপুরায় সেনাবাহিনী নামানো হয়েছে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে। 

ভারত রাষ্ট্রের বাহাত্তর বছরের ইতিহাসে এটিই সম্ভবত হতে যাচ্ছে প্রথম আইন, যেখানে ধর্মের ভিত্তিতে কিছু মানুষ সুবিধা পেতে যাচ্ছেন এবং একটি বিশেষ ধর্মের অনুসারী হওয়ায় কিছু মানুষ সে সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন। লোকসভায় কংগ্রেস এবং অন্য দলগুলোর বিরোধিতার মূল ভিত্তিও ছিল এটাই। বিলটি যে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, তা–ও তাঁরা উল্লেখ করেছেন। আইনে পরিণত হওয়ার পর চাইলে তাঁরা আদালতে যেতে পারবেন একে অসাংবিধানিক ঘোষণার দাবি নিয়ে। তবে সম্প্রতি বাবরি মসজিদের জমির মালিকানার মামলায় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট তাঁদের রায়ের ব্যাখ্যায় আইন ছাড়াও মানুষের অনুভূতিকে যেভাবে গুরুত্ব দিয়েছেন, এরপর এ ধরনের একটি বিষয়ে তাঁরা কেমন রায় দেবেন, তা অনুমান করা কঠিন। 

গত সাধারণ নির্বাচনে বিজেপি এবং সংঘ পরিবারের অঙ্গীকার ছিল রামমন্দির নির্মাণ, কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল এবং ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের’ বিতাড়ন। তাদের এ পরিকল্পনা যে ভারতীয় জনগণের ব্যাপক সমর্থন লাভ করেছে তার প্রমাণ নির্বাচনে তাদের বিপুল জয়। এটা খুব স্পষ্ট যে বিজেপি এবং সংঘ পরিবার তাদের এই প্রতিশ্রুতিসমূহ বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর। আর এ পথে আইনসভা এবং আদালত সবারই সহযোগিতা পাচ্ছে তারা। সুপ্রিম কোর্টের বিচিত্র রায় রামমন্দির নির্মাণের পথ প্রশস্ত করেছে, কাশ্মীরকে এক ধাক্কায় বিশেষ অধিকারসমৃদ্ধ রাজ্য থেকে বিভক্ত কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করা হয়েছে, তথাকথিত ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের’ বিতরণের পথেও পা পা এগোচ্ছেন অমিত শাহ। ধীরে, কিন্তু নিশ্চিত পদক্ষেপে হিন্দু রাষ্ট্র বিনির্মাণের পথে অগ্রসর হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষ ভারত। দুর্ভাগ্যক্রমে যে যুবসমাজের এ ধরনের রূপান্তর রুখে দাঁড়ানোর কথা, সেই তারুণ্যের বড় অংশ সংঘ পরিবারের পতাকাতলে শামিল হয়েছে। তাঁদের মধ্যে উচ্চশিক্ষিত, আপাতদৃষ্টিতে আধুনিক ও সংস্কৃতমনা তরুণদের সংখ্যাও বিপুল। 

বন্ধু ভারতের এই যাত্রাপথ বাংলাদেশ রাষ্ট্র এবং সমাজের জন্য উদ্বেগের বিষয়। আসাম নাগরিক তালিকার ১৯ লাখ ‘বিদেশি’ থেকে ১৪ লাখ হিন্দু বাদ পড়ে যাওয়া স্বস্তির হতে পারত। কিন্তু এর ফলে বাকিদের বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার প্রয়াস জোরদার হবে, এমন আশঙ্কা রয়েছে পুরোপুরি। সাম্প্রতিক সময়ে পুশ–ইন তৎপরতার বৃদ্ধিতে তারই আভাস মেলে। ভারতের এই রূপান্তর বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রতির জন্য পীড়াদায়ক হয়ে উঠতে পারে। এটা শাশ্বত সত্য যে মানুষ সহজে দেশ ত্যাগ করতে চায় না। খ্রিষ্টপূর্ব ৪৩১ সালে গ্রিক নাট্যকার ইউরিপিডিস লিখেছিলেন, জন্মভূমি হারানোর চেয়ে বড় কোনো দুঃখ পৃথিবীতে নেই। তবু মানুষ দেশত্যাগ করে, হয় উন্নততর জীবনের প্রলোভনে, নয় পারিপার্শ্বিক চাপের সম্মুখীন হয়ে। ভারতের নতুন এই নাগরিকত্ব আইন বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের মধ্যে এই উভয় প্রেরণাকে উসকে দিতে পারে। 

বাংলাদেশের একজন সাধারণ হিন্দু নাগরিকের কাছে এই রূপান্তরিত ভারত রাষ্ট্রে একজন হিন্দু নাগরিক হিসেবে বসবাসের সুযোগ আকর্ষণীয় মনে হতেই পারে। পাশাপাশি সমাজের যে স্বল্পসংখ্যক দুষ্কৃতিকারী দুর্বল সংখ্যালঘুদের সম্পদ দখলের লক্ষে্য তাদের প্রতিনিয়ত উত্ত্যক্ত করতে আগ্রহী, এ আইনকে তারা তাদের অপকর্মের সহায়ক হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সমাজকে এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। পাশাপাশি কোনো বায়বীয় প্রতিশ্রুতিতে আস্থা না রেখে বাংলাদেশকে ভারতের পুশ-ইনের যেকোনো চেষ্টাকে ঠেকাতে হবে। 


মো. তৌহিদ হোসেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব