শহীদের রক্ত কোনো দিন শুকাবে না

রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা। ছবি: তানভীর আহমেদ
রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা। ছবি: তানভীর আহমেদ

একাত্তরের অক্টোবরের প্রথম দিকে আ ন ম গোলাম মোস্তফা আমাকে এক ছোট্ট চিঠিতে লিখেছিলেন, সন্ধ্যার আগেই রাস্তা ফাঁকা হয়ে যায়। অফিস–আদালত খোলা থাকলেও লোকজন নেই বললেই চলে। কাজকর্মও নেই। জনমানবহীন রাতের ঢাকা ভীতিকর। তবে আশা করছি, এ অবস্থা আর বেশি দিন থাকবে না। মোস্তফা রাতের শিফটে কাজ করা উপভোগ করতেন। লিখেছিলেন, সাংবাদিকতা বলতে তো কিছু নেই, চাকরিটা করছি বলে অফিসে যাই।

শহীদ সাংবাদিক আ ন ম গোলাম মোস্তফা ছিলেন আমার বয়োজ্যেষ্ঠ বন্ধু। দিনাজপুর সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে স্নাতক হন। মধ্য ’৬০–এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ করেন। ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা থাকায় কারাভোগ করেন। সরকারের খাতায় তখনই তাঁর নাম উঠে থাকবে, যদিও পরে আর রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না। তবে বাঙালি জাতীয়তাবাদী ও পূর্ব বাংলার স্বাধিকার আন্দোলনের অবিচল সমর্থক ছিলেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই তাঁর সংবাদ-এ সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি। শহীদুল্লা কায়সারের স্নেহভাজন ছিলেন। পরে কিছুদিন আজাদ-এর সাহিত্যের পাতা দেখতেন। প্রগতিশীলদের লেখা ছাপতেন। নিজে লিখতেন কম, অন্যকে লিখতে উৎসাহ দিতেন। নিউজ ডেস্কে কাজ করার আগ্রহ থেকে পূর্বদেশ-এ সিনিয়র সাব-এডিটর হিসেবে যোগ দেন। তখন পূর্বদেশ-এ বিশিষ্ট কলাম লেখক ও খ্যাতিমান সাংবাদিক ছিলেন অনেকে। প্রখ্যাত কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক ও বিজ্ঞানীদের সাক্ষাৎকার নিয়ে একটি চমৎকার বই প্রকাশ করেছিলেন—অন্তরঙ্গ আলোকে

গণ–অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে আইয়ুব খানের পতনের কিছুদিন পর মোস্তফা বিয়ে করেন। তাঁর স্ত্রী রবীন্দ্রগবেষক আহমদ রফিকের ভাতিজি। শান্তিনগরে লোকসাহিত্যের গবেষক মুহম্মদ মনসুর উদ্দিনের বাড়ির নিচতলা ভাড়া নিয়ে সংসার পাতেন মোস্তফা। আমরা আড্ডা দিতাম। বৃদ্ধ মনসুর উদ্দিন সাহেবও তাতে যোগ দিতেন। অসহযোগ আন্দোলনের সময়ই এক পুত্রের বাবা হন মোস্তফা। তাঁকে বেশ সুখী মনে হতো। বন্ধুবৎসল ছিলেন। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, অল্প দিনের মধ্যেই শত্রুর পরাজয় হবে এবং অভ্যুদয় হবে স্বাধীন বাংলাদেশের। কিন্তু অনুমান করতে পারেননি স্বাধীন বাংলাদেশ দেখার ভাগ্য তাঁর হবে না।

আহমদ রফিক সাহেব ইস্ট পাকিস্তান মেডিকেল জার্নাল-এর সম্পাদক ছিলেন। তাঁর মাধ্যমে ডা. ফজলে রাব্বী, ডা. আলীম চৌধুরীসহ খ্যাতিমান ডাক্তারদের সঙ্গে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা। ২২ ডিসেম্বর আমি ঢাকা এসে যাঁদের বাসায় যাই, সেখানে গিয়ে তাঁদের কাউকে পাইনি, পাই তাঁদের সদ্য-বিধবাদের এবং পিতৃহীন শিশুসন্তানদের অথবা কারও পুত্রহারা মাকে। নজরুল যেমন ‘মোহররম’ কবিতায় লিখেছেন, ‘পুত্রহীনার আর বিধবার কাঁদনে/ ছিঁড়ে আনে মর্মের বত্রিশ বাঁধনে।’ সে এক বীভৎস অভিজ্ঞতা। যাঁদের বিধবাদের সঙ্গে দেখা হয় তাঁরা হলেন সিরাজুদ্দীন হোসেন, শহীদুল্লা কায়সার, আ ন ম গোলাম মোস্তফা, ডা. আলীম চৌধুরী, ডা. ফজলে রাব্বী, সাইদুল হাসান প্রমুখ। আরও অনেক অখ্যাত তরুণ বন্ধুকে হারাই। ‘মুক্তির-মন্দির সোপান তলে কত প্রাণ হলো বলিদান।’

পঁচিশে মার্চ থেকে ষোলোই ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগীরা শ্রমিক–কৃষক থেকে সব শ্রেণি-পেশার দলমত–ধর্মনির্বিশেষে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করেছে। অনেকে প্রশ্ন করেন, ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস’ আলাদা পালনের তাৎপর্য কী? বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে এবং তাতে অন্যান্য শহীদের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয় না।

যুদ্ধবিগ্রহের মধ্যে অথবা অশান্ত পরিস্থিতিতে পথেঘাটে মানুষ নিহত হতে পারে। তা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু বুদ্ধিজীবীদের কেউ সেভাবে কোনো আততায়ীর হাতে নিহত হননি। তালিকা করা হয়েছে তাঁদেরই, যাঁরা স্বাধীনতার পক্ষে, বর্বরতার বিরুদ্ধে, মানবতার পক্ষে। তাঁদের বাসস্থানের ঠিকানা জোগাড় করা হয়েছে। তাঁদের অপহরণের জন্য যাদের পাঠানো হয়েছে তারা কেউ তাদের ব্যক্তিগত দুশমন ছিল না। বুদ্ধিজীবীদের তারা ব্যক্তিগতভাবে চিনত না পর্যন্ত। বুদ্ধিজীবীদের অনেককে টেনেহিঁচড়ে তুলে নিয়েছে তাঁদের মা–বাবা, ভাইবোন, স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের সামনে। নাৎসি বর্বরতার আরেক সংস্করণ। পাকিস্তানি গোয়েন্দারা যখন বুঝতে পারে যেকোনো মুহূর্তে তাদের পতন অনিবার্য, তখনই তারা তালিকা করে, টার্গেট করে হত্যাযজ্ঞ চালায়। তাদের জিঘাংসার উদ্দেশ্য বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করা। হত্যাযজ্ঞের ১৭-১৮ দিন পরে রায়েরবাজারে গিয়ে যে দৃশ্য দেখেছি, তা কল্পনাও করা যায় না।

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সবারই নিজস্ব রাজনৈতিক মতাদর্শ ছিল, কিন্তু তাঁরা বিশেষ কোনো দলের নেতা–কর্মী ছিলেন না। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সংখ্যা হাজারের বেশি। তাঁরা কেউ শিল্পী-সাহিত্যিক, কেউ শিক্ষাবিদ, কেউ চিকিৎসক, কেউ প্রকৌশলী, কেউ–বা অন্য কোনো পেশার মানুষ। তাঁরা খ্যাতির প্রত্যাশী ছিলেন না। নীরবে কাজ করেছেন। জনগণের কাছে তাঁরা অনেকেই পরিচিত ছিলেন না। কিন্তু জাতীয়তাবাদী চেতনা বিকাশে তাঁদের অবদান সামান্য নয়। গ্রামের বিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষককে জানি যাঁদের বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা খ্যাতিমান অনেক বুদ্ধিজীবীর চেয়ে বিশেষ কম নয়।

শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ২০-২১ জন শিক্ষক শহীদ হয়েছেন, পৃথিবীর ইতিহাসে তার কোনো তুলনা নেই। বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসাকেন্দ্রের ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা ছিলেন আমাদের বামপন্থীদের একজন গুরু। তাঁকেও আলবদর সদস্যরা তুলে নেয় ১৪ ডিসেম্বর ভোরে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের দুজন শিক্ষক শহীদ হন। তাঁরা হলেন ফয়জুল মহী ও সিরাজুল হক খান। বাংলাদেশে আজ মানসম্মত পাঠ্যপুস্তকের অভাব। ড. সিরাজুল হক খান মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবই নিয়ে গবেষণা করতেন।

ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের পরিচালক আমানুজ্জামান খানের ফ্ল্যাটে অনেক দিন তাঁকে দেখেছি পাঠ্যবই নিয়ে আলোচনা করতে। মুনীর চৌধুরীর সঙ্গেও এ বিষয়ে কথা বলতে দেখেছি তাঁকে। তাঁকেও ১৪ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় কোয়ার্টার থেকে আলবদররা ধরে নিয়ে যায়।

সারা পৃথিবীতেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বুদ্ধিজীবীদের স্রষ্টা। সেখান থেকেই বড় বড় প্রতিভা ও বুদ্ধিজীবী তৈরি হন। পাকিস্তানি হানাদাররা গণহত্যার প্রথম প্রহরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আঘাত হানে। তারা যে শুধু প্রতিষ্ঠিত বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে তা–ই নয়, তারা আগামী দিনের সম্ভাব্য বুদ্ধিজীবীদেরও হত্যা করে। ২৩ ডিসেম্বর জগন্নাথ হলে গিয়ে দেখি প্রাঙ্গণটি শূন্যতায় খাঁ খাঁ করছে।  শুধু যে দেবতার মতো প্রফেসর জিসি দেব নেই তা–ই নয়, যেন কেউই নেই। সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ও ইকবাল হলের (জহুরুল হক হল) একই অবস্থা। শতাধিক শহীদ ছাত্রের বিদেহী আত্মার যেন নিশ্বাস শোনা যাচ্ছে। জগন্নাথ হলে গিয়ে শুনলাম দর্শন বিভাগের বন্ধু রমণী মোহন ভট্টাচার্য শহীদ হয়েছেন। আরও শুনলাম চারুকলা ইনস্টিটিউটের অমিত বসাক এবং শাহনেওয়াজও শহীদ। অনাগত প্রতিভাবানরা চলে গেছেন।

 একটি হাদিসে পড়েছি, শহীদের রক্ত শুকায় না। ওঁদের রক্তও শুকাবে না। জাতির স্মৃতিতে ওঁরা থাকবেন চির অম্লান। নজরুল যথার্থই বলেছেন, ‘গোলামির চেয়ে শহীদি দর্জা অনেক ঊর্ধ্বে জেনো।’

বুদ্ধিজীবী দিবস পালন শুধু শহীদদের স্মরণ করে তাঁদের প্রতি আনুষ্ঠানিক বিনম্র শ্রদ্ধাজ্ঞাপন নয়। দিনটি জীবিত বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ করিয়ে দেয় তাঁদের সামাজিক ও জাতীয় কর্তব্য ও দায়িত্ব সম্পর্কে। যে আদর্শের কারণে একাত্তরে বুদ্ধিজীবীদের জীবন উৎসর্গ করতে হয়েছিল, সেই আদর্শ বাস্তবায়ন প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের পবিত্র দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি অসম্মান। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ডান, বাম, মধ্যপন্থী, উদার গণতন্ত্রী সব মতবাদীই ছিলেন। একটি ব্যাপারে তাঁদের মধ্যে মিল ছিল তা হলো, তাঁরা চেয়েছিলেন একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, শোষণমুক্ত সমাজ, আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার। আমাদের সংবিধানে এসব অঙ্গীকারের উল্লেখ আছে। যা দরকার তা হলো, সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য বুদ্ধিজীবীদের চাপ অব্যাহত রাখা।

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক