শিক্ষকদের চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল

অধ্যাপক গিয়াসউদ্দীন, অধ্যাপক ড. সিরাজুল হক খান, অধ্যাপক ডা. আবুল খায়ের, অধ্যাপক ড. ফয়জুল মহিউদ্দীন, অধ্যাপক ড. রাশিদুল হাসান, অধ্যাপক ড. আনোয়ার পাশা,  অধ্যাপক ড. সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য
অধ্যাপক গিয়াসউদ্দীন, অধ্যাপক ড. সিরাজুল হক খান, অধ্যাপক ডা. আবুল খায়ের, অধ্যাপক ড. ফয়জুল মহিউদ্দীন, অধ্যাপক ড. রাশিদুল হাসান, অধ্যাপক ড. আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক ড. সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য
>

বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২, ২০১৩ সালের ৩ নভেম্বর দুই পলাতক আসামি আশরাফুজ্জামান ও চৌধুরী মঈনুদ্দীনকে আমৃত্যু ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তাঁদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার নির্দেশ দেন। জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন সহযোগী সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের ওই দুই কেন্দ্রীয় নেতার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময় শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসকসহ ১৭ বুদ্ধিজীবীকে অপহরণের পর হত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হয়। দণ্ডিত ব্যক্তিরা কখনো আপিল করেননি। এই মামলার শুনানিতে সাক্ষীদের ভাষ্যে অনেক অজানা মর্মস্পর্শী তথ্য ও বিষয় উদ্‌ঘাটিত হয়। তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালের জ্যেষ্ঠ বিচারক বিচারপতি ওবায়দুল হাসান নথিপত্রের ভিত্তিতে কিছু বিষয় নির্বাচিত করেছেন। এর সবটাই মূলত শহীদদের স্বজন ও প্রত্যক্ষদর্শীদের জবানবন্দি। পাঁচ কিস্তির এই নির্বাচিত অংশের তৃতীয় পর্ব ছাপা হলো আজ।

[গতকালের পর]
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক যথাক্রমে অধ্যাপক গিয়াসউদ্দীন আহমেদ, অধ্যাপক ড. সিরাজুল হক খান, অধ্যাপক ডা. আবুল খায়ের, অধ্যাপক ড. ফয়জুল মহিউদ্দীন, অধ্যাপক ড. রাশিদুল হাসান, অধ্যাপক ড. আনোয়ার পাশা ও অধ্যাপক ড. সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্যের অপহরণ ও হত্যাকাণ্ড নিয়ে আজ কিছু জানাতে চাই।

এই অভিযোগ প্রমাণ করার জন্য ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিয়েছেন অধ্যাপক গিয়াসউদ্দীনের ভাগনি মাছুদা বানু রত্না, অধ্যাপক সিরাজুল হকের ছেলে ডা. এনামুল হক খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান, শহীদ ড. মর্তুজার নিকটাত্মীয় ওমর হায়াত এবং শহীদ ডা. আবুল খায়েরের পুত্র রাশেদুল ইসলাম। ১৯৭১ সালে এই রাশেদুল ইসলাম ছিলেন ছয় বছরের শিশু। কিছু কিছু ঘটনা তাঁর আবছা আবছা মনে থাকলেও বড় হয়ে তিনি তাঁর মা ও আত্মীয়দের কাছ থেকে তাঁর বাবার অপহরণ ও হত্যাকাণ্ডের কথা জানতে পারেন। এই সাক্ষীরা ট্রাইব্যুনালে যে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন, তার কিয়দংশ তুলে ধরছি।

মাসুদা বানু রত্নার (শহীদ অধ্যাপক গিয়াসউদ্দীন আহমেদের ভাগনি) সাক্ষ্যের অংশ

‘১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল ১৭ বছর। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে প্রথম বর্ষ সম্মান শ্রেণির ছাত্রী ছিলাম। ওই সময় আমি আমার মামা শহীদ অধ্যাপক গিয়াসউদ্দীন আহমেদ সাহেবের নীলক্ষেতের বাসায় থেকে লেখাপড়া করতাম। আমার মামা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক ছিলেন এবং পাশাপাশি তিনি হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের হাউস টিউটর ছিলেন।

‘১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১ মুহসীন হলে সাপ্লাইয়ের পানি ছিল না, এই খবর পেয়ে সকাল সাড়ে সাতটা বা পৌনে আটটার দিকে আমার মামা গিয়াসউদ্দীন পিপিং স্যুটের শার্ট এবং লুঙ্গি পরে মুহসীন হলে পানির পাম্পের কাছে যান। আনুমানিক সকাল আটটার দিকে ইপিআরটিসির একটি মিনিবাস বাসার সামনে এসে থামে। সেই বাস থেকে দুজন লোক নেমে দোতলায় উঠে আসে, যেখানে আমার মামা গিয়াসউদ্দীন এবং আমরা থাকতাম। তারা দোতলায় এসে দরজায় কড়া নাড়ে।...আমার খালু নূরুল হক দরজা খুলে দিলে তারা জানতে চায় গিয়াসউদ্দীন কোথায়। দুজনের হাতেই আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। গিয়াসউদ্দীন বাসায় নেই শোনার পর ওই দুই ব্যক্তি নিচে নেমে যায় এবং ৮–১০ মিনিট পর আবার দোতলায় আসে। সারা বাসা তল্লাশি করে। একপর্যায়ে আমার মামা কিবরিয়া সাহেব বলেন, গিয়াসউদ্দীন সাহেব মুহসীন হলের পানির পাম্পহাউসে গিয়েছেন। এ কথা শুনে তারা কিবরিয়া সাহেবকে ধরে মুহসীন হলের পানির পাম্পের কাছে নিয়ে যায়। সেখানে যাওয়ার পর গিয়াসউদ্দীন সাহেবকে পায়। তখন গামছা দিয়ে আমার মামা গিয়াসউদ্দীনের চোখ বেঁধে সেই মিনিবাসে ওঠায়। আমার অপর মামা কিবরিয়া সাহেব মুহসীন হল থেকে বাসায় ফিরে এসে আমাদের কাছে এই ঘটনাটি বর্ণনা করেন।

‘যে দুই ব্যক্তি আমার মামার বাসায় সশস্ত্র অবস্থায় মামাকে খুঁজতে গিয়েছিল এবং পরবর্তী সময়ে মুহসীন হল এলাকা থেকে তাঁকে চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে যায়, এরা হলো আশরাফুজ্জামান খান এবং চৌধুরী মঈনুদ্দীন। এরা দুজনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল এবং ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা ছিল।

‘১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ বিজয় লাভের পর আমরা শুনতে পাই যাঁদের সেই ইপিআরটিসির মিনিবাসে করে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তাঁদের অনেকের লাশ রায়েরবাজার ও মিরপুরের “বধ্যভূমি”তে পড়ে আছে। আমরা আরও খবর পাই, কিছু লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে নিয়ে আসা হয়েছে। প্রথমে আমি এবং আমাদের আত্মীয়স্বজন রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে যাই এবং পরবর্তী সময়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে আসি। এই দুই জায়গার কোথাও আমার মামার লাশ আমি দেখতে পাইনি। মেডিকেল কলেজের মর্গে অন্য শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়, তাঁরাও তাঁদের স্বজনদের লাশ খুঁজছিলেন।

‘১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসের ৫ তারিখে আমার বড় খালু জনাব আবদুল মোমেন খান (সাবেক খাদ্যসচিব, খাদ্যমন্ত্রী) খবর পেয়ে মিরপুরের বধ্যভূমিতে যান এবং আমার মামার পরিধেয় বস্ত্রাদি দেখে মামার গলিত লাশ শনাক্ত করেন এবং পরিধেয় বস্ত্রাদিসহ গলিত বিকৃত লাশ ওখান থেকে তুলে এনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পাশে অন্য বুদ্ধিজীবীদের কবরের পাশে ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী দাফন করা হয়।’

এই সাক্ষীর সাক্ষ্যে বলে দেয় যে কুখ্যাত আলবদর আশরাফুজ্জামান ও মঈনুদ্দীন ছিলেন বুদ্ধিজীবী নিধন মিশনের মূল কারিগর।

ফরিদা বানুর সাক্ষ্যের অংশ

‘আমার নাম ফরিদা বানু, স্বামী জনাব নূরুল হক। আমার বর্তমান বয়স ৭৪ বছর। ১৯৭৩ সালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে যোগদান করি। আমি অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০০৫ সালে অবসর গ্রহণ করি। আমি শহীদ অধ্যাপক গিয়াসউদ্দীনের ছোট বোন হিসেবে খুব কাছ থেকে তাঁকে দেখেছি।...১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর সকালে উঠে দেখি ভাই বাসায় নেই। মুহসীন হলে পানির সরবরাহ ছিল না, এই খবর পেয়ে তিনি হলের ভেতরে পাম্পহাউসে কী হয়েছে দেখতে যান।

সকাল আটটার দিকে তৎকালীন ইপিআরটিসির একটি কাদামাখা মাইক্রোবাস আমার ভাইয়ের বাসার সামনে এসে দাঁড়ায়। আমার স্বামী আমার ভাইয়ের দোতলা বাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখতে পান কয়েকটি যুবক গাড়ি থেকে নামে, যাদের মধ্যে দুজন অস্ত্রধারী ছিল, তারা বিল্ডিংয়ে ঢুকে দোতলায় উঠে আমাদের দরজায় কড়া নাড়ে। দরজা খুলে দিলে তারা ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করে গিয়াসউদ্দীন সাহেব কোথায়। তারা যখন জানতে পারে তিনি বাসায় নেই, তত্ক্ষণাৎ তারা চলে যায় এবং কিছুক্ষণ পর আবার ফিরে আসে এবং ওরা আমার মামাতো ভাই গোলাম কিবরিয়াকে (ওই সময় ওই বাসায় থাকত) সঙ্গে নিয়ে মুহসীন হলে যায়। আমরা দক্ষিণের বারান্দা থেকে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম, অপহরণকারীরা আমাদের টেলিফোনের তার বিচ্ছিন্ন করছিল। তাদের এ কর্মকাণ্ড দেখে আমাদের মনে হয়েছিল, এরা সাধারণ অপহরণকারী নয়, এরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একটি দল। কিছুক্ষণ পর কিবরিয়া এসে জানায় অস্ত্রধারীরা মুহসীন হলের পাম্পহাউস থেকে আমার ভাই গিয়াসউদ্দীনকে চোখ বেঁধে ওই মাইক্রোবাসে করে নিয়ে যায়।

যখন আমার ভাইকে অপহরণকারীরা চোখ বেঁধে নিয়ে যায়, তখন সৈয়দ আনোয়ার হোসেনও মুহসীন হলের পাম্পহাউসে উপস্থিত ছিলেন। তিনি অপহরণের ঘটনাটি দেখেছিলেন বলে আমাদের জানান। এ ছাড়া রত্না (পিডব্লিউ-১) আমাদের বলেছিলেন যে দুজন অস্ত্রধারী আমাদের বাসায় এসেছিল, তাদের সে চিনতে পেরেছে, কারণ সে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন সময়ে ইসলামী ছাত্রসংঘের মিছিল–মিটিং করতে দেখেছে। এদের নাম মঈনুদ্দীন এবং আশরাফুজ্জামান খান বলে সে উল্লেখ করেছিল।’

. এনামুল হক খানের (শহীদ ড. সিরাজুল হক খানের ছেলে) সাক্ষ্যের অংশ

‘আমি বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর সকাল আনুমানিক সাড়ে আটটা কি পৌনে নয়টা হবে, তখন একটি ইপিআরটিসির কাদামাখা মিনিবাস আমাদের বাসার সামনে এসে থামে। ওই মিনিবাস থেকে ৫–৭ জন সশস্ত্র লোক নেমে এসে আমাদের চারতলার ফ্ল্যাটের কলিংবেল টেপে। এদের পরনে ছিল খাকি রঙের কাপড়, গায়ে পুলওভার জড়ানো ছিল, পায়ে ছিল বাদামি রঙের কাপড়ের জুতা। কলিংবেলের আওয়াজ পেয়ে আমার ছোট চাচা দরজা খুলে দিলেন, আমি তাঁর পেছনেই ছিলাম। দুটি ফ্ল্যাটের মাঝখানের জায়গায় দুজন এসে দাঁড়ায় এবং তাদের পেছনে অন্যরা সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ছিল। যে দুজন ওপরে এসেছিল তারা যথেষ্ট কেতাদুরস্ত মানুষ ছিল। তাদের একজন জানতে চেয়েছিল আমার পিতা ড. সিরাজুল হক খান কোথায় বা এটি তাঁর বাসা কি না। আমি পেছন থেকে দুজনকেই লক্ষ করছিলাম। আমার ছোট কাকা একটু কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে জানিয়েছিলেন আমার বাবা নিচতলায় অধ্যাপক ইসমাইল সাহেবের বাসায় গিয়েছেন। আগন্তুকেরা নিচতলায় অধ্যাপক ইসমাইল সাহেবের বাসায় যায় (১৬ নম্বর বিল্ডিংয়ের পশ্চিম পাশে)। বারান্দা থেকে আমি এবং আমার চাচা দাঁড়িয়ে দেখছিলাম আমার বাবাকে ইসমাইল সাহেবের বাসা থেকে আগন্তুকেরা বের করে আনে। আমার বাবার পকেটে রুমাল ছিল, সেই রুমাল দিয়ে ওনার চোখ বেঁধে ইপিআরটিসির মিনিবাসে তাঁকে উঠিয়ে নিয়ে যেতে দেখেছি।

‘সেদিন কারফিউ ছিল। আমরা নিচে নেমে এসে কম্পাউন্ডের ভেতরে খোঁজখবর করছিলাম। আমরা জানতে পারি, বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকা থেকে আরও বেশ কয়েকজনকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমাদের ক্যাম্পাস থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারের ডা. মর্তুজা এবং আরবি বিভাগের অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান সাহেবের শ্যালককে আগন্তুকেরা ধরে নিয়ে গেছে। সেদিন আমরা তেমন আর কোনো খোঁজখবর পাইনি। পরদিন ১৫ ডিসেম্বর, ১৯৭১ একটি সামরিক জিপে করে মুস্তাফিজুর রহমান সাহেবের শ্যালককে বাসায় পৌঁছে দিয়েছিল। আমি এই খবর পেয়ে মুস্তাফিজুর রহমান সাহেবের বাসায় যাই তাঁর শ্যালকের সঙ্গে দেখা করতে এই প্রত্যাশায় যে, তাঁর কাছ থেকে আমার বাবার খবরাখবর পাব। কিন্তু মুস্তাফিজ সাহেবের প্রবল আপত্তির মুখে আমি তাঁর শ্যালকের সঙ্গে দেখা করতে পারিনি। ১৫ ডিসেম্বর কারফিউ থাকার কারণে আমরা বাবা এবং অন্য অপহৃতদের আর কোনো খবর নিতে পারিনি।

‘১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম দিকে এনএসআই কর্মকর্তা সামাদ তালুকদারের সহায়তায় যে মিনিবাসে করে আমার বাবা এবং অন্যদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সেই মিনিবাসের ড্রাইভার মফিজ উদ্দিনকে আমাদের বাসায় আনা হয়। ড্রাইভার মফিজ উদ্দিন আমার বাবার ছবি দেখে নিশ্চিত করেছিলেন, তাঁর গাড়িতে করেই আমার বাবাসহ অন্যদের আলবদর সদস্যরা প্রথমে গাবতলী লোহার ব্রিজের ওপরে নিয়ে যায়। সেখানে হত্যার উদ্দেশ্যে আরও বেশ কিছু লোককে জড়ো করা হয়েছিল। সে জন্য আমার বাবা এবং অন্যদের মিরপুর মাজার রোড দিয়ে নিয়ে বর্তমানে যেখানে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়েছে, সেখানে নিয়ে (তখন জায়গাটি নিচু ছিল) তাঁদের আশরাফুজ্জামান খান নিজ হাতে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে বলে ড্রাইভার মফিজ উদ্দিন আমাদের জানিয়েছিলেন। মফিজ উদ্দিন আরও জানান যে ব্রাশফায়ার করার পর মৃতদেহগুলো দুটো গর্তে মাটিচাপা দিয়ে রাখা হয়।

‘এরপর সম্ভবত ৪ জানুয়ারি, ১৯৭২ সামাদ তালুকদার সাহেব, তৎকালীন ওসি মিরপুর থানা, একজন ভারতীয় সামরিক কর্মকর্তা ও কিছু সিপাহি, একজন ম্যাজিস্ট্রেটের তত্ত্বাবধানে মফিজ ড্রাইভারের দেখানো মতে আমার বাবা এবং অন্যদের গলিত কঙ্কালসার লাশ সেই গর্ত দুটি থেকে উত্তোলন করা হয়। এই সময় আমি এবং অন্যান্য শহীদ পরিবারের সদস্যরা সেখানে উপস্থিত ছিলাম। আমি আমার বাবার কোমরের বেল্ট, পরিহিত গ্যাবার্ডিন প্যান্ট, পকেটে থাকা পরিচয়পত্র দেখে তাঁর লাশ শনাক্ত করতে পেরেছি।’

অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেনের সাক্ষ্যের অংশ

‘আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক, বর্তমানে এলপিআরে আছি। ১৯৭০ সালের ৩ আগস্ট আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করি।

‘আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হলের সহকারী আবাসিক শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলাম। আমার আবাস ছিল হলের ভেতরে ছোট একটি বাসায়।...

 ‘১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি আমাদের বাসায় পানি নেই। অর্থাৎ পানির পাম্প চালু করা হয়নি। আমি মুহসীন হলের পেছনে উত্তর-পশ্চিম কোণে পাম্প ঘরে যাই। কিছুক্ষণ পর অধ্যাপক জহুরুল হক সাহেব সেখানে এসেছিলেন। আমরা দেখলাম পাম্প ঘরে কোনো লোক নেই। তখন আনুমানিক সকাল আটটা-সোয়া আটটা, এর মধ্যে পাম্পহাউসে এলেন গিয়াসউদ্দীন স্যার। গিয়াস স্যারই পাম্পের মেইন সুইচ অন করেন, এতে পাম্পটি চালু হয়। পাম্প চালু করে পাম্পহাউস থেকে বের হওয়ার সময় পাম্পের দরজার মুখে আমি দেখতে পেলাম একজন লোক, যার পরনে ছিল ছাই রঙের পোশাক, হাতে ছিল ৩০৩ রাইফেল, মুখ রুমাল দিয়ে বাঁধা অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। জানতে পারি সাধারণত এ ধরনের পোশাক আলবদর, আলশামস বা রাজাকাররা পরত। সেই লোকটি গিয়াস স্যারের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল “আর ইউ গিয়াসউদ্দীন?” গিয়াস স্যার উত্তরে বললেন, “ইয়েস”। তারপর ওই ব্যক্তিটি গিয়াস স্যারকে ভাঙা উর্দুতে বলল, “হামকো সাথ আইয়ে’’। এ অবস্থায় গিয়াস স্যার ইতস্তত করছিলেন। আমরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়েছিলাম। এরই একপর্যায়ে লোকটি স্যারের বুকের দিকে বন্দুক তাক করে। তখন স্যার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন “আনোয়ার চলি, দোয়া করো।” স্যারকে যখন লোকটি নিয়ে যাচ্ছিল তখন বিপরীত দিক থেকে একই পোশাক পরিহিত আরেকজন লোক এগিয়ে আসে। সামনে এবং পেছনে উভয়ই সশস্ত্র প্রহরায় স্যারকে হলের পেছন দিক থেকে সামনের দিকে নিয়ে যেতে শুরু করল। স্যার যখন ডাইনিং হলের পেছনের বারান্দায় উঠলেন তখন সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল হলের অবাঙালি উর্দু ভাষী দারোয়ান রহিম। ওই লোক দুটি রহিমের গামছাটি নিয়ে স্যারের দুটি চোখ বেঁধে তাঁকে নিয়ে গেল।’

. আনিসুজ্জামানের সাক্ষ্যের অংশ

‘আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ইমেরিটাস অধ্যাপক। ১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল ভারতের আগরতলায় এবং ১৫ মে এখান থেকে সপরিবারে কলিকাতায় গিয়ে পৌঁছি। কলিকাতায় আমি প্রথমে বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থী শিক্ষকদের সংগঠন “বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি” গঠনের কাজে যুক্ত হই। আমি এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করি। পরে আমি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য পদে যোগ দিই।

‘দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে কলিকাতা থাকা অবস্থায় ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর তারিখে বুদ্ধিজীবী হত্যার বিষয়ে সংবাদপত্রের মাধ্যমে প্রথমে জানতে পারি। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি আমি সপরিবারে ঢাকায় ফিরে আসি। ৯ জানুয়ারি আমার দুজন শহীদ শিক্ষক মুনীর চৌধুরী ও মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর পরিবারের সঙ্গে তাঁদের বাড়িতে গিয়ে সাক্ষাৎ করি। সেই সময় শহীদ অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর স্ত্রী সৈয়দা মনোয়ারা চৌধুরী আমাকে বলেন যে “আপনাদের ছাত্ররাই আপনার স্যারকে (মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী) নিয়ে গেছে।” আমি শহীদ অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর ছোট ভাই অধ্যাপক লুত্ফুল হায়দার চৌধুরীর কাছ থেকে জানতে পারি যে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর তাঁর (অধ্যাপক লুত্ফুল হায়দার চৌধুরী) বাসা থেকে অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীকে মুখে রুমাল বাঁধা অবস্থায় কয়েকজন যুবক ধরে নিয়ে যায়। এই যুবকদের মধ্যে যে সামনে ছিল একপর্যায়ে তার মুখের রুমাল খুলে যায়। তখন মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী তাকে বলেন “মঈনুদ্দীন তুমি?” সে আবার মুখে রুমাল বাঁধতে বাঁধতে বলে “জি, আপনি আমার সঙ্গে যাবেন, কোনো ভয় নেই।” এই মঈনুদ্দীন তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের ছাত্র এবং দৈনিক পূর্বদেশ–এ কর্মরত স্টাফ রিপোর্টার “চৌধুরী মঈনুদ্দীন”। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে আমিও তাকে ১৯৬৯ সালে অল্প দিনের জন্য ছাত্র হিসেবে পেয়েছিলাম। চৌধুরী মঈনুদ্দীন এবং তার সঙ্গীরা অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীকে নিয়ে যাওয়ার পর তিনি আর ফিরে আসেননি।

‘সংবাদপত্রের প্রকাশিত সূত্র থেকে এবং নানা সময়ে উদ্ধার হওয়া দলিলপত্র থেকে জানা যায়, ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের হত্যার একটি পরিকল্পনা করা হয়। ডিসেম্বর মাসে আলবদর বাহিনী এই পরিকল্পনা কার্যকর করতে শুরু করে। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা এবং এভাবে বংলাদেশকে মেধাশূন্য করা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, আইনজীবী আলবদর বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন।’

ওমর হায়াতের (শহীদ ডা. মর্তুজার স্ত্রীর ভাই) সাক্ষ্যের অংশ

‘১৪ ও ১৫ ডিসেম্বর, ১৯৭১ ঢাকা শহরে কারফিউ চলছিল। ১৬ ডিসেম্বর আমার বোনের কাছ থেকে খবর পাই, তার মেয়ের ওড়না (পরে বলেন শাড়ি) দিয়ে তার স্বামী ডাক্তার মর্তুজাকে অপহরণকারীরা চোখ বেঁধে অপহরণ করে নিয়ে গিয়ে কাদামাখা একটি বাসে ওঠায়। এরপর তিনি আর ফিরে আসেননি।

‘সামাদ সাহেব নামে একজন পুলিশ অফিসার মফিজ নামে একজন ড্রাইভারকে সঙ্গে নিয়ে এসে বেশ কয়েক দিন পর আমার বোনকে জানায় যে মিরপুর মাজারের পেছনে একটি জায়গায় কিছু মৃতদেহ পড়ে আছে। আমাদের কেউ যেন সেখানে গিয়ে খোঁজ নেন ডাক্তার মর্তুজা সাহেবের মৃতদেহ সেখানে আছে কি না। আমি ৪ জানুয়ারি, ১৯৭২ আমার বোনের বাসায় উপস্থিত হই। সেখান থেকে মিত্রবাহিনীর একজন মেজর, পুলিশ কর্মকর্তা সামাদ, ড. সিরাজুল হক খানের ছেলে এনামুল হক খান (পিডব্লিউ-৪) এবং বাসের ড্রাইভার মফিজসহ আমরা মাজার শরিফের পেছনে একটি জায়গায় যাই। ড্রাইভার মফিজের দেখানোমতে একটি জায়গায় মাটি সরিয়ে বেশ কিছু লাশ দেখতে পাওয়া যায়। মাটি খোঁড়ার পর দ্বিতীয় গর্তের প্রথম লাশটিই সম্ভবত ছিল ডাক্তার মর্তুজার।...ডাক্তার মর্তুজার চোখ তাঁর মেয়ের শাড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল এবং এক পায়ে একটি পাম শু পরা ছিল। সেখানে ওই সময় ড্রাইভার মফিজের মুখেই শুনতে পাই জনৈক মঈনুদ্দীন এই অপহরণের ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল এবং জনৈক আশরাফুজ্জামান ব্রাশফায়ার করে অপহরণ করে নিয়ে আসা বুদ্ধিজীবীদের এখানেই হত্যা করে। এই বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে যাঁদের নাম সে বলেছিল তাঁরা হলেন ড. সিরাজুল হক খান, ড. সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য, ড. ফয়জুল মহি, প্রফেসর আনোয়ার পাশা, সৈয়দ রাশিদুল হাসান প্রমুখ। ডা. মর্তুজা ছাড়া অন্য সবারই মৃতদেহ গলিত ও বিকৃত ছিল।

‘ডা. মর্তুজার লাশসহ অন্য বুদ্ধিজীবীদের লাশ গর্ত থেকে উত্তোলনের পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে নিয়ে আসা হয়। সেখান থেকে তাঁদের লাশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদে এনে জানাজা পড়ানো হয় এবং মসজিদের পাশের গোরস্থানে তাঁদের সমাহিত করা হয়। আমার বোন মিসেস সায়িদা মর্তুজা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে ছেলের সঙ্গে অবস্থান করছেন।’

সাক্ষী রাশেদুল ইসলামের (শহীদ ডা. আবুল খায়েরের পুত্র) সাক্ষ্যের অংশ

‘১৯৭১ সালে আমার বয়স ছিল ৬ বছর। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর সকাল আনুমানিক নয়টা। আমার পিতা শহীদ ডা. আবুল খায়ের হাঁটার জন্য আমাদের বাড়ির বাইরে বের হন।...উনি যখন বাড়ির গেটের বাইরে হাঁটছিলেন তখন ৪–৫ জন অজ্ঞাতনামা যুবক আমার বাবাকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কি ড. আবুল খায়ের?” আমার বাবা উত্তরে বলেছিলেন, “আমি ড. আবুল খায়ের।” এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে আগত অজ্ঞাতনামা যুবকেরা আমার বাবাকে তাঁর গায়ে থাকা চাদর দিয়ে তাঁর চোখ বেঁধে ফেলে এবং তাদের সঙ্গে নিয়ে গেটের বাইরে অবস্থানরত কাদামাখানো মিনিবাসে জোর করে উঠিয়ে নেয়। ওই সময় আমি আমাদের বাড়ির বারান্দায় খেলছিলাম এবং এই অপহরণের ঘটনাটি আমি বারান্দা থেকে প্রত্যক্ষ করি। বাবাকে যখন জোর করে গাড়িতে ওঠানোর ঘটনাটি দেখি, তখন আমি দৌড়ে আমার মায়ের কাছে এসে ঘটনাটি বলি। আমার মা তত্ক্ষণাৎ ছুটে এসে বাবাকে ওই অজ্ঞাতনামা যুবকদের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করলে ওই যুবকেরা অস্ত্র উঁচিয়ে গুলি করার ভয় দেখায় এবং আমার বাবাকে তারা গাড়িতে করে নিয়ে চলে যায়। তখন আমার মা কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় আমাদের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে এই চলে যাওয়ার দৃশ্যটি দেখছিলেন। একই সময়ে আমাদের ওই বাড়ির চতুর্থ তলায় বসবাসরত ড. ফজলে মহিকেও একই কায়দায় ওই অস্ত্রধারী যুবকেরা ওই কাদামাখানো মিনিবাসে জোর করে তুলে নিয়ে যায়। এই ঘটনাটিও আমি আমাদের বাসার বারান্দা থেকে দেখেছিলাম।

১৯৭২ সালের ৪ জানুয়ারি কাদামাখানো যে মিনিবাসে করে আমার বাবাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তার ড্রাইভারকে আমাদের বাসায় ধরে নিয়ে আসা হয়েছিল। ওই ড্রাইভারের নাম ছিল মফিজ। ধৃত মফিজ জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছিল, মিরপুর বধ্যভূমিতে বেশ কিছু বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে লাশ ফেলে রাখা হয়েছিল। এই খবরের পরিপ্রেক্ষিতে আমার মামা এবং চাচাতো ভাই ওই দিনই মিরপুর বধ্যভূমিতে গিয়ে আমার বাবার লাশের সন্ধান করে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর গলিত এবং অর্ধগলিত অনেক লাশের মধ্যে আমার বাবার চাদর দেখে (যা দিয়ে বাবার চোখ বাঁধা ছিল) তাঁর বিকৃত লাশ শনাক্ত করতে পারে। তখন তারা আমার বাবার সেই বিকৃত গলিত লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে নিয়ে আসে। সেখান থেকে লাশের ময়নাতদন্তের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদে জানাজা শেষে তার পাশের কবরস্থানে দাফন করা হয়।’

আগামীকাল: ঘাতকেরা বর্বরতার সব সীমা অতিক্রম করেছিল
বিচারপতি ওবায়দুল হাসান: হাইকোর্টের বিচারপতি