মন্ত্রীর দম্ভ বনাম শ্রমিকের মৃত্যু

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

বাংলাদেশের এক মন্ত্রী ছয় হাজার ডলার মাথাপিছু আয়ের স্বপ্নের গল্প শোনাচ্ছেন আর প্রতি পরিবারের একটি করে গাড়ির স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। আরেক মন্ত্রী দম্ভ করে ঘোষণা দিচ্ছেন, এখন মানুষ প্রতিদিনই মুরগির মাংস দিয়ে ভাত খেতে পারছে, যা আগে শুধু ঘরে মেহমান এলে খেত। সেদিনই বকেয়া মজুরি পাওয়াসহ আরও ১১ দফা দাবিতে অনশনে থাকা খুলনায় পাটকলশ্রমিক আবদুস সাত্তার মারা গেলেন। তিনি খুলনার প্লাটিনাম জুট মিলের শ্রমিক ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে শ্রমিকেরা খুব স্বাভাবিকভাবেই আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। সর্বশেষ ১৫ ডিসেম্বর মারা গেছেন অনশনে অসুস্থ হয়ে পড়া আরেক শ্রমিক।

এদিকে ঢাকার কেরানীগঞ্জে প্লাস্টিক কারখানার আগুনে পুড়ে এ পর্যন্ত মৃত শ্রমিকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৭।

মজুরি কমিশন বাস্তবায়নসহ বিভিন্ন দাবিতে খুলনা অঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ত নয়টি পাটকলের শ্রমিকেরা গত ১০ নভেম্বর থেকে আমরণ অনশনে রয়েছেন। জাতীয় মজুরি কমিশন বাস্তবায়ন ছাড়াও পাটকলশ্রমিকদের দাবির মধ্যে অন্যতম হলো সরকারি-বেসরকারি অংশীদারির (পিপিপি) সিদ্ধান্ত বাতিল ও অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিক-কর্মচারীদের পিএফ-গ্র্যাচুইটির টাকা পরিশোধ করা। শ্রমিকেরা বলেছেন, তাঁদের নিয়মিত বেতন দেওয়া হয়নি। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের দাবিতে তাঁরা রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়েছেন।

অথচ এই অনশন যদি ঢাকায় হতো, যদি কোনো নামকরা স্কুল, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বা শিক্ষকেরা করতেন, তাহলে এতক্ষণে সেটি ভাঙার জন্য বিভিন্নজন এসে হাজির হতেন। দাবি মানার জন্য নানা দেনদরবার হতো। মিডিয়া সারা দিন ছোটাছুটি করত। কিন্তু সাত্তারদের কাছে কেউ নেই। বরং রাষ্ট্র এবং ক্ষমতাবানেরা বিরক্ত। কারণ, এই সাত্তারদের মৃত্যু মাথাপিছু জাতীয় আয়ের অপ্রতিরোধ্য ঊর্ধ্বগতিতে উচ্ছ্বাসকে নাড়িয়ে দেয়, চোখ রাঙিয়ে দেয়।

কেন একজন আবদুস সাত্তার এবং পাটকলশ্রমিকদের অনশন মধ্যবিত্তের অনশন নয়, বরং মুরগির মাংস খাওয়ার দাবিদারদের দাবিকে চূর্ণবিচূর্ণ করে এ ধরনের অনশন। কারণ, শ্রমিকের অনশন বাড়তি সুবিধা পাওয়ার দাবির অনশন নয়। ন্যায্য মজুরিসহ মানুষ হিসেবে অধিকার পাওয়ার অনশন।

এ দেশে গতরখাটা মানুষের মূল্য সব সময় কম। আর এই শ্রম বিক্রি করেই তাঁরা জীবন টেনে নেন। সেখানে তাঁদের মজুরি বাকি পড়লে খাওয়া-পরার নিশ্চয়তাটুকুও হারিয়ে যায়। যিনি কায়িক শ্রম বেচে জীবন টানেন, তাঁর কাছে খাওয়া, না-খাওয়ার গুরুত্ব অন্য কারও সঙ্গে মেলার নয়। একজন শ্রমিকের কাছে খাওয়া একটা ভীষণ জরুরি কর্তব্য। তিনি জানেন, অতটুকু না পেলে বাঁচতে পারবেন না, শ্রম বেচতে পারবেন না। তাই শ্রমিকেরা যখন অনশন করেন, তখন এই অনশনের অর্থ পাল্টে যায়, এই অনশন হয় সাধারণ ‘রোমান্টিকতা’ ভেঙে সত্যিকারের মৃত্যুর জন্যই প্রস্তুত থাকা। ঝুলে ঝুলে বেঁচে থাকা তাঁদের জন্য আর সম্ভব হয়ে ওঠে না।

মানুষের ক্ষুধা, কায়িক শ্রম—এগুলোর প্রতি আমাদের এখন একধরনের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়েছে। এখন আমাদের আশপাশে কোনো ক্ষুধাকাতর মানুষের জন্যও আমাদের খারাপ লাগে না। এমনকি রাষ্ট্র নাগরিকের ক্ষুধা নিবৃত্ত করার দায়িত্ব নেয় না। মন্ত্রীর মুরগির মাংস দিয়ে ভাত খাওয়ার গল্প কিংবা দেশকে দেখতে ফ্রান্স কিংবা সুইজারল্যান্ডর মতো লাগে—এই গল্প শুনতে শুনতে আমরাও ভুলে যাই, মানুষ বাঁচার জন্য অনশন করতে পারে। শাহবাগ থেকে টিএসসির বুকচিরে জেগে ওঠা মেট্রোরেলের উন্নয়নের খোঁড়াখুঁড়ি মধ্যেই আমাদের কাছে আবছা হতে থাকে আবদুস সাত্তারদের মুখগুলো। ওদের দেখা যায় না, তবে ওদের মৃত্যু এবং ন্যূনতম মজুরি না পেয়ে শ্রমিকদের এই অনশন নিঃসন্দেহে প্রশ্ন তোলে ‘সব মানুষের মুরগি’ দিয়ে ভাত খাওয়ার গালগল্পকে। আরও সামনে নিয়ে আসে এই রাষ্ট্রের ক্ষমতাবানেরা সাধারণ মানুষ সম্পর্কে কতটা দায়িত্বহীন।

তাই শ্রমিকের অনশন মানে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ। খোঁড়াখুঁড়ির উন্নয়নের থেকে মানুষকে তার অধিকার নিশ্চিত করে বাঁচিয়ে রাখার নামই উন্নয়ন। দেশকে প্যারিস কিংবা সুইজারল্যান্ডের মতো দেখার গল্প বলে লাভ নেই, যে দেশে মানুষের জীবনের মূল্য থাকে না, প্রতিবছর লোভের কারখানাগুলোয় পুড়ে এত মানুষ অগ্নিদগ্ধ হতে হয়।

জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।