কোথায় তারে দিবি রে ঠাঁই

সুলতানা কামাল
সুলতানা কামাল

এবার আমরা আমাদের বিজয়ের ৪৮ বছর পালন করছি। পাকিস্তানি সামরিক জান্তার গণহত্যার মুখে মুক্তিবাহিনী গঠন করে মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত নানা কৌশলে যুদ্ধ করে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলে বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতা অর্জন করে। এই যুদ্ধকে আমরা অভিহিত করেছি মুক্তিযুদ্ধ বলে। এই নামকরণটির মধ্য দিয়ে এ দেশের মুক্তিকামী মানুষ নিজেদের জীবনযাপনের শর্তগুলো নিজেরাই প্রতিষ্ঠিত করবে, সে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিল। শর্তগুলো বাংলাদেশের মানুষ ক্রমান্বয়ে নিরূপণ করেছিল এক–একটি সংগ্রামের পথ ধরে, যার সূচনা ঘটেছিল বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি জনযুদ্ধ, যার মূলে ছিল সব মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা—এ দাবির অনুকূলে পরিষ্কার ব্যাখ্যার সন্ধান পাই আমরা বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণে। বঙ্গবন্ধু তখন হয়ে উঠেছেন এ দেশের সব মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। তিনিই সমগ্র জাতির হয়ে ঘোষণা দিলেন, ‘বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়।’ তিনি বাংলাদেশের সেই সময় সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে জানান দিলেন, এ দেশের মানুষ সব রকম শোষণের হাত থেকে মুক্তি চায়। তাঁর ভাষায়, ‘বাংলার মানুষ অর্থনৈতিক মুক্তি চায়, সামাজিক মুক্তি চায়, সাংস্কৃতিক মুক্তি চায়। বাংলার মানুষ রাজনৈতিক মুক্তি চায়।’ মুক্তির যাত্রায় এর চেয়ে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা আর কী হতে পারে। তাই তো আমরা কত সহজে আমাদের সংবিধান রচনা সম্পন্ন করতে পারলাম কত অল্প সময়ে, যেখানে সমতা, সামাজিক ন্যায়বিচার আর মানবমর্যাদার প্রতিষ্ঠাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সে সংবিধানে কিছু অধিকারের কথা সংযোজন-বিয়োজনের তাগিদ নিশ্চয়ই ছিল। কিছু ত্রুটিও অনুধাবন করতে পেরেছি আমরা পরবর্তী সময়ে। সংবিধানে নারী অধিকারের স্বীকৃতি তখনকার তুলনায় যথেষ্ট অগ্রসরতার স্বাক্ষর রাখলেও তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনে অধিকারের সমতা নিশ্চিত করেনি। জাতি, ধর্ম, কে কোথায় জন্মগ্রহণ করেছে বা লিঙ্গভেদে রাষ্ট্র কারও প্রতি কোনো বৈষম্য প্রদর্শন না করার অঙ্গীকার করা সত্ত্বেও বাংলাদেশের বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠী এবং অবাঙালি জনগণের অস্তিত্বের অস্বীকৃতি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে যে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়নি, সেটাও আলোচনায় এসেছে অধিকারসচেতন মানুষের কাছ থেকে। তারপরও অত্যন্ত প্রত্যয়ের সঙ্গেই বলা যায় যে এ দেশের মানুষের দীর্ঘ ২৩ বছরের সংগ্রাম আর মুক্তিযুদ্ধের আশা-আকাঙ্ক্ষার নির্যাস আমাদের সংবিধানের চারটি মূলনীতিতে আমরা গ্রথিত করতে পেরেছিলাম। যে বিপুল আবেগ নিয়ে আমরা আমাদের সংবিধানকে মানুষের ইচ্ছার দলিল হিসেবে স্থাপন করেছি, তা অবশ্য কখনোই নিছক আবেগের বিষয় ছিল না, তার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল লাখো স্বজন হারানোর আর নির্মম নির্যাতনের অভিজ্ঞতার গভীর বেদনায় নিষিক্ত সব অন্যায় আর অবিচারের বিপরীতে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার প্রতিজ্ঞা। আর এ প্রতিজ্ঞা সাধারণ মানুষের ব্যক্তিজীবন, সামাজিক লেনদেন অথবা রাষ্ট্রের সঙ্গে তার যে চুক্তি—সর্বক্ষেত্রে সত্য করে তোলার জন্য যে চারটি নীতি—গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্র—আমরা গ্রহণ করেছিলাম রাষ্ট্র পরিচালনার মৌলিক নীতি হিসেবে, তার চেয়ে যথাযথ সিদ্ধান্ত আর কিছু কি হতে পারত?

এই চারটি নীতির প্রতিটিতেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অন্তর্নিহিত রয়েছে। সামগ্রিকভাবে এই চারটি নীতির সঠিক ও সৎ বাস্তবায়নই পৌঁছে দিতে পারত আমাদের স্বপ্নের সোনার বাংলার দ্বারপ্রান্তে। তবে এ মুহূর্তে অস্বীকার করার উপায় নেই যে আমরা সেই জায়গা থেকে এখনো অনেক দূরে রয়ে গেছি।

এ কথা সত্য যে বাংলাদেশের প্রতি ইতিহাস নিরবচ্ছিন্নভাবে সদয় আচরণ করেনি। গন্তব্যে চলার পথে দেশটিকে মাঝে মাঝেই যে শুধু হোঁচট খেতে হয়েছে, তা-ই নয়, দীর্ঘ সময় ধরে উল্টো পথে হাঁটতে হয়েছে। জাতির জনককে তাঁর পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-সহকর্মীসহ নির্মমভাবে হত্যা করে যারা দেশের ক্ষমতা দখল করল, তারা এক কলমের খোঁচায় ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি উড়িয়ে দিয়ে সংবিধানের ওপর আরোপ করল সাম্প্রদায়িক চরিত্র। তাদের উত্তরসূরি সেটাকে পাকাপোক্ত করল একটি ধর্মকে রাষ্ট্রধর্মের মর্যাদা দিয়ে। ইতিমধ্যে চরম হঠকারিতায় পুনর্বাসিত করা হলো মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তিগুলোকে, যাদের মধ্যে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত ব্যক্তিও স্থান পেল। সম্পদের সুষম বণ্টনের অভিপ্রায়কে দুর্বল করে করা হলো, জাতীয়তাবাদ ক্রমশই উগ্রতাকে ধারণ করে অন্তর্ভুক্তির চিন্তাকে সরাসরি ত্যাগ করল, আর গণতন্ত্র যে চরিত্র এবং চেহারা প্রদর্শন করল, তা গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা না বাড়িয়ে জনগণকে সাধারণভাবে সুশাসন এবং ন্যায়বিচারের প্রত্যাশার প্রতিই বীতশ্রদ্ধ করে তুলল। মুক্তিযুদ্ধের রূপরেখার বাংলাদেশের যে চেহারা, তা ক্রমশ আবছা হতে হতে বিলীন হওয়ার ঝুঁকিতে পড়তে বাধ্য হলো।

দীর্ঘ একুশ বছর পরে সময় এল, যখন ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেল।এ কথা সত্য যে পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে সংবিধানের চার নীতি উপড়ে ফেলে সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক, সামরিকতন্ত্রী ও অগণতান্ত্রিক চিন্তাচেতনা দ্বারা আচ্ছন্ন রাজনৈতিক ধারার যে বীজ রোপণ করা হয়েছিল, দীর্ঘ বিশ বছর ধরে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় তা আমাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিকসহ প্রতিটি ক্ষেত্রকে ছেয়ে ফেলেছিল আগাছার মতো। দুঃখের বিষয়, মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি অন্তত দুটি নির্বাচনে জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন পেয়েও সেই আগাছা পরিষ্কার করার বিপরীতে তাতে বরং জলসিঞ্চন করে আজকে তা প্রায় মহিরুহতে পরিণত করেছে এবং ফলে বারবার মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির সঙ্গে আপস করে চলার নীতি গ্রহণ করতে নিজেদের বাধ্য করছে।

কিছু সূচকে বাংলাদেশের উন্নয়নের অগ্রগতি যথাযথভাবেই প্রশংসিত হয়েছে এবং একজন নাগরিক হিসেবে তার জন্য অবশ্যই গর্ববোধ করি। কিন্তু সেই উন্নয়নের সবটাই প্রায় কাঠামোগত এবং অনেক ক্ষেত্রেই মানুষের জীবনে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার নিরপেক্ষ। কখনো কখনো তা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থীও বটে।

অত্যন্ত খোলাখুলিভাবেই জনগণ এই শক্তির কাছ থেকে বারতা পাচ্ছে যে বাহাত্তরের সংবিধানের মূলনীতির পূর্ণ বাস্তবায়ন তাদের রাজনীতিতেও আর অগ্রাধিকারের জায়গায় নেই। তাদেরই ভাষ্যে রাজনীতির চরিত্রের বদল হয়েছে এবং এই পরিবর্তিত রাজনীতির ‘খেলা’য় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি অনুগত থাকার চেয়ে ক্ষমতায় যাওয়া এবং তা ধরে রাখার দক্ষতা অর্জন করাই বিচক্ষণতার কাজ। এর প্রভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাদের সাংবিধানিক নির্দেশনা অগ্রাহ্য করে বৈষম্যমূলক নীতি, আইনকানুন বজায় রাখতে হয়েছে, নিজেদের প্রণীত শিক্ষানীতি অকার্যকর করতে হয়েছে, প্রচণ্ড নারীবিদ্বেষী মতবাদকে সমর্থন করে চলতে বাধ্য করা হয়েছে, বিশেষ বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থের প্রাধান্যের কাছে বিশেষ জনগোষ্ঠীর অধিকারের প্রশ্নে ছাড় দেওয়া হয়েছে। প্রবৃদ্ধি তাড়িত উন্নয়ন মডেলের দাপটে প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশের ক্ষতির হিসাব রাখার সদিচ্ছা পরিত্যাগ করতে হয়েছে।

প্রত্যাশা ছিল প্রথম পাঁচ বছর এবং পরবর্তীকালে টানা দশ বছর মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের দাবিদার অন্য রাজনৈতিক দলগুলো মিলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সেই পরিবর্তন আনতে সক্ষম হবে। যেমন আগে বলেছি তাদের অগ্রাধিকার ও আনুগত্য এই মৌলিক অঙ্গীকারগুলো থেকে দূরে সরে যাওয়ায় রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতি এবং সবচেয়ে বড় কথা আমাদের সংস্কৃতিতে তার ধারণক্ষমতা তৈরিতেই মনোযোগ দেওয়া হয়নি। গুরুত্বই পায়নি একটি শক্ত সুশীল সমাজ গড়ে তোলার দায়িত্ব। বরং নানাভাবে সংকুচিত করা হয়েছে সমাজের অংশগ্রহণ এবং অংশীদারত্বের ধারণা এবং সুযোগ। সুশীল শব্দটিকে যথাসম্ভব অবিশ্বাসের জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, নাগরিক চেতনাকে যথাসম্ভব ধারহীন করা হয়েছে। এ প্রক্রিয়া যে ইদানীং শুরু হয়েছে, সেটা বলা অন্যায় হবে। তবে তা থেকে উত্তরণের উদ্যোগ হয়েছে ব্যক্তিকেন্দ্রিক, কখনো দলকেন্দ্রিক কিন্তু কদাচিৎ সামগ্রিক। অপশক্তির দোহাই দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ নির্দেশিত পথে না হেঁটে অনবরত অন্য পথ ধরা হয়েছে। ভুলে গেলে চলবে না যুক্তিযুক্ত কারণে পথের কেবল খানিকটা যাওয়া আর ভুল পথে যাওয়া এক কথা নয়। শোষণ আর বঞ্চনার দেশ বদলে সব মানুষের দেশ গড়তে হলে তো তার জন্য ব্যক্তিমানস, সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, শিক্ষা—সর্বক্ষেত্রের ধারণক্ষমতা তৈরি করতে হবে, বদলকে গ্রহণ করার শক্তি অর্জন করতে হবে। সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলো, যারা নীতিনির্ধারণের দায়িত্ব গ্রহণ করে, তারা সে কাজটা সৎ ও যোগ্যভাবে করতে না পারলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ঠাঁই কোথায় হবে?

সুলতানা কামাল: মানবাধিকার কর্মী, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা