প্রবাসে আমরাও ছিলাম যুদ্ধে

পাকিস্তানের প্রতি মার্কিন সমর্থনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ায় ১৯৭১ সালে বিক্ষোভ
পাকিস্তানের প্রতি মার্কিন সমর্থনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ায় ১৯৭১ সালে বিক্ষোভ

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়, যা চিরকাল আমাদের জাতীয় জীবনে আলোকবর্তিকার কাজ করবে। তাই সেই ইতিহাসকে যথাযথভাবে ধরে রাখার দায়িত্ব আমাদের সবার। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের আসন্ন সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে আমাদের বিষয়টি আরও গভীরভাবে অনুধাবন করতে হবে।

আমেরিকাপ্রবাসী সাধারণ বাঙালিদের ভূমিকা

দেশের অভ্যন্তরে যেমন, তেমনি দেশের বাইরে কীভাবে বাঙালিরা এই মুক্তিযুদ্ধে সংশ্লিষ্ট হয়েছিলেন, সে কথা সবার জানা নেই। সম্ভবত এসব তথ্য সংগ্রহ করার কোনো সাংগঠনিক প্রয়াসও এ পর্যন্ত নেওয়া হয়নি। এ ব্যাপারে নিজস্ব দায়িত্ববোধ থেকে আমি এ লেখায় একাত্তরে সুদূর আমেরিকায় বসবাসরত বাংলাদেশের সাধারণ বাঙালির অবদানের কথা এখানে তুলে ধরতে চেষ্টা করব। আশা করব, আমার মতো আরও অনেকে এ ধরনের কাজে এগিয়ে আসবেন। একাত্তরে আমি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে পড়ালেখা ও শিক্ষকতার কাজ করতাম। সেখান থেকেই নানাভাবে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগ হয়েছিল।

আমি এখানে দুটি বিষয়ের ওপর বিশেষ নজর দিতে চাই। এক, সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের বিভিন্ন ধরন, কৌশল ও প্রক্রিয়া এবং দুই, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে তার সুফল। এর ভেতর দিয়ে আমরা জানতে পারব যে দেশের ভেতরে বিভিন্ন রণক্ষেত্রে সরাসরি যুদ্ধ করা ছাড়াও দেশের ভেতরে–বাইরে কীভাবে নানা প্রক্রিয়ায় নানাজন আমাদের স্বাধীনতার পথ প্রশস্ত করেছেন। এটাকে আমি বলব মাঠযুদ্ধের সঙ্গে সমান্তরালভাবে পরিচালিত কৌশলগত যুদ্ধ।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ আন্দোলন

আমেরিকার প্রধান কয়েকটি শহরে স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্থানীয় বাঙালিদের তৈরি সাংগঠনিক ব্যবস্থা গড়ে উঠলেও মূলত নিউইয়র্ক ও শিকাগোতেই সমন্বয়ের কাজগুলো পরিচালিত হতো। আমি শিকাগোবাসী হওয়ার ফলে আমার অভিজ্ঞতা শিকাগোকেন্দ্রিক। এ ব্যাপারে প্রথমেই বলতে হয় বাংলাদেশ ডিফেন্স লিগের কথা, যা বিডিএল নামে সুপরিচিত ছিল। বিডিএলের প্রধান কর্ণধার ছিলেন প্রখ্যাত বাঙালি প্রকৌশলী ড. ফজলুর রহমান খান, যিনি সেই সময়কার পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু দালানগুলোর (হ্যানকক টাওয়ার ও সিয়ার্স টাওয়ার) স্থপতি—ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে সারা পৃথিবীতে সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনি ছিলেন বিডিএলের সভাপতি আর আমি সাধারণ সম্পাদক। আমেরিকার বিভিন্ন রাজ্যে বসবাসকারী বাঙালি প্রতিনিধি ও তাঁদের সুহৃদদের সঙ্গে আলোচনা করে বিডিএল স্থাপন করা হয়েছিল। এর পরিচালনা পর্ষদ গঠিত হয়েছিল বিভিন্ন স্টেটের প্রতিনিধিদের নিয়ে।

বিডিএল গড়ার কিছুদিনের মধ্যে বাংলাদেশ ইমার্জেন্সি ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন (বিইডব্লিউএ) নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয়েছিল শিকাগোতেই, মূলত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য অর্থ সংগ্রহ করার জন্য। এটাতেও এফ আর খান সভাপতি। অন্যান্য পদধারী সবাই অবাঙালি মার্কিন নাগরিক। সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক—ড. রোনাল্ড ইন্ডেন।

বিইডব্লিউএর জন্য অর্থ সংগ্রহ হতো মূলত এফ আর খানের নিজস্ব অনুদান থেকে। আর সব বড় অঙ্ক আসত খান সাহেবের সহকর্মী ও পরিচিতজনদের কাছ থেকে, যাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই মার্কিন নাগরিক। তবে সাধারণ বাঙালিরা ক্ষুদ্র অঙ্কের হলেও অনেকেই মাসে মাসে টাকা পাঠাতেন। এখানে ক্ষুদ্র অঙ্কের দাতাদের কথাই আমার বেশি মনে পড়ে। সেকালে চেকের মাধ্যমে টাকা পাঠানোরই রেওয়াজ ছিল। শিকাগোতে আমাদের বিডিএল ও বিইডব্লিউএর পোস্টবক্সে স্বাধীনতা আন্দোলনের ৯ মাসের প্রায় প্রতিদিনই যেসব চিঠি জমা পড়ত, সেগুলোর মধ্যে অনেক খামেই চেক থাকত বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে কোনো কাজে লাগানোর জন্য।

তাঁরা আমেরিকার কোথায়, কোন কোন শহরে কীভাবে বাংলাদেশের আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন, তার অনেক উপাদান আমার সংকলিত বাংলাদেশ নিউজলেটার বইটিতে পাওয়া যাবে। আমেরিকাব্যাপী সব কর্মকাণ্ডের সমন্বয় সাধনের জন্য ‘বাংলাদেশ নিউজলেটার’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। বিভিন্ন স্টেটের বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনগুলোর কার্যকলাপ অন্য সবাইকে জানানো ও তাদেরও এ ধরনের কাজে উদ্বুদ্ধ করা এবং সিনেটর-কংগ্রেসম্যানদের কাছে কোন বিষয়ে চিঠি লেখা প্রয়োজন ও সেই চিঠি কীভাবে লিখলে ভালো হয়, তার খসড়া তৈরি করে দেওয়া ইত্যাদি সবই নিউজলেটারের মাধ্যমেই হতো।

নিউজলেটারগুলো থেকে বাছাই করা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজগুলোর কিছু নমুনা এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করব। এসবের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আমেরিকার বিভিন্ন স্টেটের বড় বড় শহরে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনগুলোর সঙ্গে বৈঠক করে বাংলাদেশের কথা সবার কাছে তুলে ধরা; বিভিন্ন স্থানে নানা ধরনের মেলাতে অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশের পক্ষে লিফলেট ও অন্যান্য প্রকাশনা বিলি করা; গাড়িতে লাগানোর জন্য বাম্পার-স্টিকারে ‘স্টপ জেনোসাইড’, ‘ফ্রি শেখ মুজিব’, ‘রিকগনাইজ বাংলাদেশ’, ‘জয় বাংলা’ ইত্যাদি লিখে বিলি করার মাধ্যমে বাংলাদেশ ইস্যুটি সবার মনে জাগরিত রাখা। সারা উত্তর আমেরিকা, অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সভা–সেমিনার/বক্তৃতার ব্যবস্থা করে বাংলাদেশ আন্দোলনের যৌক্তিকতা ছড়িয়ে দেওয়া। সেই সব সভার আগে-পরে র‍্যালি করে, পোস্টার টাঙিয়ে, লিফলেট বিতরণ করে বাংলাদেশ সমস্যার ব্যাখ্যা করে কী কারণে সমস্যার উদ্ভব এবং তাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কী, তা বিশ্লেষণ করা ইত্যাদি।

বাংলাদেশ সমস্যার শুরু থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তার অতি মিত্রদেশ পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করেছিল এবং পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক, সামরিক সাহায্যসহ রাজনৈতিক সমর্থন দিয়ে বাংলাদেশে এত বড় একটি সামরিক অভিযান পরিচালনা করতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছিল। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আমাদের প্রধান কাজ হবে মার্কিন জনগণকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করা এবং তার মাধ্যমে তাদের দিয়ে মার্কিন সরকারের ওপরে চাপ সৃষ্টি করা। আমরা চেয়েছিলাম, আমাদের এসব প্রচারণার ফলে মার্কিন সরকার পাকিস্তানকে সহায়তা বন্ধ করবে এবং বাংলাদেশে পাকিস্তানের নির্যাতন বন্ধ করার পদক্ষেপ গ্রহণ করবে ও বাংলাদেশ আন্দোলনের যথার্থতা অনুধাবন করবে। পাকিস্তানের বিপক্ষে ও বাংলাদেশের পক্ষে মার্কিন সরকারের মনোভাব পরিবর্তনের জন্য জনমত তৈরি করা ও তার মাধ্যমে কংগ্রেসম্যান ও সিনেটরদের ওপর চাপ সৃষ্টি করার কাজটি করা হতো প্রধানত তাঁদের নির্বাচনী এলাকার জনগণের কাছ থেকে নিয়মিত চিঠি পাঠানোর মাধ্যমে। আমার মনে আছে, আমরা ওয়াশিংটনে ক্যাপিটল হিলে যখন সিনেটর ও কংগ্রেসম্যানদের অফিসে প্রচারকাজে যেতাম, তাঁদের অনেকেই আমাদের বলতেন, তাঁদের রাজ্যে বসবাসকারী বাঙালিদের কাছ থেকে তাঁরা যে সংখ্যক চিঠিপত্র পান, তাতে তাঁরা বিস্মিত বোধ করেন। জানতে চাইতেন কীভাবে আমরা তা সম্ভব করেছি। এর ফলে মার্কিন সিনেটর ও কংগ্রেসম্যানদের মনে যে প্রভাব পড়েছিল, তা তাঁদের বিভিন্ন বক্তব্যে ও কর্মকাণ্ডে প্রকাশ পেত।

অন্যান্য কাজের মধ্যে অন্যতম ছিল মুক্তিযুদ্ধের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা। তা দিয়ে বাংলাদেশের জন্য বেতারসামগ্রী, যোগাযোগের যন্ত্রপাতি ইত্যাদি কিনে ভারতে বাংলাদেশ সরকারের কাছে পাঠানো; অস্ত্র কেনার জন্য অর্থ সংগ্রহসহ মুক্তিযোদ্ধাদের পোশাক-আশাক ও যাবতীয় রসদ পাঠানো ও আমেরিকায় অধ্যয়নরত ছাত্রছাত্রীদের আর্থিক সহায়তা প্রদান অন্যতম। তা ছাড়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত পাকিস্তানের কূটনৈতিক বাহিনী থেকে পদত্যাগকৃত বাঙালি কূটনীতিকদের অন্তর্বর্তীকালীন ভরণপোষণের ব্যবস্থাও এ অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যের মধ্যে ছিল।

আমেরিকার তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগ নেওয়াও আমাদের আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল। আমেরিকা তখন ভিয়েতনামের গৃহযুদ্ধে গভীরভাবে জড়িয়ে গিয়েছিল। এর বিরুদ্ধে আমেরিকাব্যাপী জনগণের মনে বিরাট ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছিল। বিশেষ করে শিক্ষাঙ্গনগুলো বিক্ষোভের প্রাণকেন্দ্র ছিল এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সাধারণ জনগণ আমেরিকার শহরে শহরে বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নিত। আমরা সরকারবিরোধী সেই আন্দোলনের সঙ্গে বাংলাদেশ আন্দোলনকে যুক্ত করার চেষ্টা করেছিলাম এবং অনেকাংশে সফল হয়েছিলাম বলা যায়। আমরা পাকিস্তানকে সহায়তা করাকে ভিয়েতনামে মার্কিন সহায়তার সঙ্গে তুলনা করতাম। এসব উদ্যোগের ফলে মার্কিন জনগণ এবং তাদের প্রতিনিধিদের মধ্যে পাকিস্তানের প্রতি বিরূপ ধারণা ও বাংলাদেশের যুক্তিগুলোর পক্ষে অবস্থান নেওয়া সম্ভব হয়েছিল।

যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী বাঙালিদের অবদান

আমাদের মুক্তিযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার পুরোপুরি পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল। নিক্সন প্রশাসন একেবারেই চায়নি যে পাকিস্তান ভেঙে দুই টুকরা হয়ে যাক এবং বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হোক। সেই পরিস্থিতিতে আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল দুটি—এক, মার্কিন সরকারের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখার ওপর আমাদের প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে সবার মনে বাংলাদেশের দাবির ন্যায্যতা স্থাপন করা ও তাদের পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ও বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নিতে উদ্বুদ্ধ করা এবং দুই, এই কাজ করার জন্য মার্কিন জনমতকে আমাদের পক্ষে নিয়ে আসা।

শিকাগোতে আমরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছিলাম ওয়ার্ল্ড এয়ারওয়েজ নামক একটি চার্টার বিমান কোম্পানির অফিসের সামনে। সেখানে বাঙালিরা ছাড়াও অনেক মার্কিন ছাত্রছাত্রী শামিল হয়েছিল। এক সপ্তাহ ধরে দিনে কয়েক ঘণ্টার জন্য বিক্ষোভ সংঘটিত হতো। বিক্ষোভের মূল উদ্দেশ্য ছিল যেন সেই কোম্পানি পাকিস্তানের জন্য অস্ত্র, গোলাবারুদ ও সৈন্যসামন্ত করাচি থেকে কলম্বো হয়ে ঢাকায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য যে চুক্তি করেছিল, তা বাতিল করে দেয়। কারণ, এর মাধ্যমে তারা বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষের ওপর পাকিস্তানিদের হত্যা ও নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত হচ্ছিল। অন্য উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশে পাকিস্তানের নির্যাতনের কথা সবাইকে জানিয়ে জনমত সৃষ্টি করা। বিক্ষোভকারীরা শত শত কাগজের প্লেন আকাশে ছুড়ে, দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, বিমান কোম্পানির কুকীর্তির কথা প্রচার করে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করতে পেরেছিল। আরও আলোড়ন হয়েছিল শিকাগো নদীর পানিতে মানুষের আকারে তৈরি বেলুনে লাল রং ভরে ভাসিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে। যেন বাংলার নদীতে মৃতদেহ ভাসছে। নদীর পানি দূষিত করার জন্য দুজন মার্কিন নাগরিককে গ্রেপ্তারও করা হয়েছিল। সব মিলিয়ে বিক্ষোভ সমাবেশটি খুব ফলাও করে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছিল।

বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য এবং অসামান্য কার্যকরী ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে আরেকটির কথা এখানে বলা প্রয়োজন মনে করি। সেটি হচ্ছে, ওয়াশিংটন ডিসিতে বাংলাদেশ ইনফরমেশন সেন্টার নামে একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা। সেন্টারটি মার্কিন কংগ্রেসে বাংলাদেশের বক্তব্য উপস্থাপন করতে এবং মার্কিন জনপ্রতিনিধিদের বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নিতে বিশেষভাবে সহায়তা করেছিল। এখানে সার্বক্ষণিক কর্মীদের মধ্যে বাঙালিরা যেমন ছিল, তেমনি অনেক মার্কিন নাগরিকও ছিল। এই সেন্টারের পরিচালনায় শিকাগোর বিডিএলের আর্থিক অনুদান ছিল উল্লেখযোগ্য।

আমাদের এসব কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে সিনেটর-কংগ্রেসম্যানদের কাছে হাজার হাজার চিঠিপত্র পাঠানোর ফলে মার্কিন কংগ্রেসের দুটি কক্ষেই বেশ কয়েকটি বিল উত্থাপন হয়েছিল, যেগুলো পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নিক্সন প্রশাসনের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়। এদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল মার্কিন বৈদেশিক সাহায্য বিলে দুটি সংশোধনী প্রস্তাব, যা গ্যালাগার ও স্যাক্সবি-চার্চ সংশোধনী হিসেবে খ্যাত।

এই সংশোধনীগুলোর মূল লক্ষ্য ছিল মার্কিন বৈদেশিক সাহায্য বিলে এমন পরিবর্তন আনা, যাতে পাকিস্তানের পক্ষে আমেরিকার নির্ধারিত সহায়তা তহবিল থেকে অস্ত্র সরবরাহ রহিত করা এবং তার পরিবর্তে ভারতে আশ্রয়রত ১ কোটি উদ্বাস্তুকে সহায়তার জন্য অধিক পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করা। যদিও শেষ পর্যন্ত বিলটি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ১৯৭২ সালে আমেরিকার বৈদেশিক সাহায্য আইন হিসেবে গৃহীত হয়, দীর্ঘদিন মার্কিন কংগ্রেসের উভয় কক্ষে আলোচনার ফলে বিষয়টি আমাদের আন্দোলনের প্রায় ৯ মাস ধরে আমেরিকার মিডিয়ায় স্থান করে নেয়, বাংলাদেশের মানবিক সমস্যাটি বিভিন্ন ফোরামে আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয় এবং তার ফলে সরকার ও জনগণের মনে বাংলাদেশ সমস্যার আশু সমাধানের বিষয়টি অগ্রাধিকার লাভ করে।

বাঙালিদের এসব কর্মকাণ্ডের ফলেই মার্কিন কংগ্রেসের ৬ জন বিশিষ্ট কংগ্রেসম্যান ও সিনেটর সরেজমিনে বাংলাদেশ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য ভারত উপমহাদেশে আসেন। তাঁদের মধ্যে কংগ্রেসম্যান গ্যালাগার ও সিনেটর কেনেডি, পার্সি, ফ্রাঙ্ক চার্চ ও স্যাক্সবি অন্যতম। তাঁরা প্রত্যেকেই তাঁদের বিভিন্ন বক্তব্যের মাধ্যমে বাংলাদেশে পাকিস্তানের নির্মম হত্যাযজ্ঞ ও ভারতের উদ্বাস্তু শিবিরগুলোতে বাঙালি শরণার্থীদের অমানবিক ও করুণ পরিস্থিতি সম্বন্ধে বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। নিক্সন সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে এবং পাকিস্তানের জন্য মার্কিন সহায়তা বন্ধ করা বা কমানোর কাজে এসব কাজের গুরুত্ব খাটো করে দেখার উপায় নেই।

এ কথা মানতেই হবে যে মার্কিন সরকার, মার্কিন কংগ্রেস, গণমাধ্যম ও জনমতের ওপর প্রভাব সৃষ্টিতে আমেরিকায় বসবাসকারী বাঙালিদের নিরলস কর্মকাণ্ড ও অবদান ছাড়া আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ধারা নেতিবাচক রূপ ধারণ করতে পারত। তার ফলে বাংলাদেশে পাকিস্তানের হত্যাযজ্ঞ যে আরও নির্মম ও দীর্ঘস্থায়ী হতো না, তা কে বলতে পারে? তাই তাদের সবার কাছে আমরা বিশেষভাবে ঋণী। তাদের মতো সারা বিশ্বে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অন্যান্য সাধারণ বাঙালির একাত্তরের অবদানের কথা আমাদের জানতে হবে ও তার মাধ্যমে আমাদের জাতির ইতিহাসকে পরিপূর্ণতা দিতে হবে। যাঁরা এ কাজে ব্রতী, তাঁদের কাছে আমার অনুরোধ, যেন বিদেশে অবস্থানরত যেসব বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অবদান রেখেছেন, তাঁদের কথা ও কাজ সংগ্রহ করে জাতীয় ইতিহাস রচনায় সংযোজন করবেন।

শামসুল বারী: রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ বাংলাদেশের চেয়ারপারসন, ইউএনএইচসিআরের সাবেক পরিচালক