বিজয়ের মাস ও খালেকের মাফলার

পুড়ে যাওয়া কারখানার দেয়ালে ঝুলছে নিহত শ্রমিক খালেকের মাফলার। প্রথম আলো ফাইল ছবি
পুড়ে যাওয়া কারখানার দেয়ালে ঝুলছে নিহত শ্রমিক খালেকের মাফলার। প্রথম আলো ফাইল ছবি

সকাল থেকেই মাথায় ঘুরছিল খালেকের মাফলারের কথা। কেরানীগঞ্জের আগুনে পোড়া প্লাস্টিক কারখানার আগুন থেকে ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছেন সোহাগ। একসঙ্গে দুপুরে খানা খেলেও বন্ধু খালেক মারা গেছেন হাসপাতালে। দেয়ালে এখনো ঝুলছে খালেকের মাফলার। সেই মাফলারটা একনজর দেখতে তিনি এসেছিলেন পরিত্যক্ত কারখানায়। ‘জীবন আমার বোন’, ‘কালো বরফ’ ও ‘অনুর পাঠশালা’র মতো কালজয়ী উপন্যাসের রচয়িতা কথাসাহিত্যিক মাহমুদুল হক একাত্তরের আগুনমুখো দিনগুলো নিয়ে একটা গল্প লিখেছিলেন ‘কালো মাফলার’ নামে। ঢাকায় একটা গেরিলা অপারেশন করতে এসে ছোট ভাই টুলটুল গোপনে দেখা করেন বড় ভাই মনোয়ারের সঙ্গে তাঁদের বাড়িতে। যাওয়ার সময় একটা মাফলার নিয়ে যান, ‘তোর গলায় মাফলারটা আমাকে দে, ওটা মা’র হাতের বোনা…’ সকালে মনোয়ার জানতে পারেন ...গলায় ফাঁস দিয়ে মারা হয়েছে হতভাগাটাকে, এখনো নাকি গলায় একটা মাফলারের ফাঁস আঁটা, মানুষ আর মানুষ নেই! মনোয়ার বুঝে যান টুলটুলের ভাগ্যে কী ঘটেছে। খালেকের মাফলারটাতেও কি তাঁর মায়ের স্মৃতি ছিল? সোহাগ জানান, খালেক কখনো হাতছাড়া করতেন না মাফলারটা। তাঁদের দুজনের একসঙ্গে এবার বিজয় দিবসে সাভারে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। হয়তো খালেকের গলায় তখনো থাকত মাফলারটা।

এর মধ্যেই খবর আসে, গাজীপুর থেকে এক ফ্যান তৈরির কারখানায় এক লহমায় ১০টা মানুষ শেষ। দূরে কেউ বিজয় দিবসের প্রস্তুতি গান বাজাচ্ছে, ‘একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার।’

কেরানীগঞ্জে শ্রমিকের পোড়া গন্ধ বাতাসে হারিয়ে যাওয়ার আগেই দগ্ধ হন গাজীপুরের খেটে খাওয়া শ্রমিকেরা। অনশনে ঝরছে পাটকলশ্রমিকদের প্রাণ। কৃষক বুক চাপড়াচ্ছেন ধানের হাটে। কেরানীগঞ্জের কোনো এক নিহত শ্রমিকের অবুঝ কন্যা জেদ করে বসে আছে, বাবা না এলে সে ভাত খাবে না, ঘুমাবে না। লাশ ছাড় করানোর জন্য নিহত ব্যক্তির স্ত্রী-ভাই-স্বজনেরা ছুটছেন হাসপাতালের এতলা-সেতলায়।

খুলনার প্লাটিনাম জুট মিলের হাকিম ভাই, মোল্লা মিস্ত্রি, সফুরুন বাওয়া চেয়েছিলেন বিজয় দিবসে নিহত দুই শ্রমিকের স্মরণে শোকসভা হোক। ঢাকার নেতাদের সে শোকসভায় তাঁরা দেখতে চেয়েছিলেন। যাঁদের চেয়েছিলেন, তাঁদের অনেকেই ঢাকার বিজয় উৎসবেই থেকে গেছেন; শোকসভায় যেতে পারেননি। বিজয় দিবসে অনশনে মৃত শ্রমিকের শোকসভার রাজনৈতিক গুরুত্ব না বুঝলে তাঁরা শ্রমিকের গায়ে-মাথায় হাত বোলানো ছেড়ে দিলে কার ক্ষতি?

বিজয় উদযাপনে আমরা নিশ্চয়ই অতীতের গল্পগাথা আর অর্জন-বিসর্জনের আলোচনা করব। কিন্তু একই সঙ্গে চাওয়া আর পাওয়ার হিসাব মিলিয়ে বিজয়কে সব মানুষের সব সময়ের বিজয়ে পরিণত করার প্রচেষ্টাও তো থাকতে হবে। ভুললে চলবে না আমাদের শুধু অতীত নেই, ভবিষ্যৎও আছে। তবে সেটা আপনা-আপনি আসে না। তাকে নির্মাণ করতে হয়। ভবিষ্যতের ভিত্তি রচনা করে বর্তমান।

শ্রমিকেরা যদি তাঁদের কাজের জায়গায় মাফলার ঝুলিয়ে আর বাড়ি ফিরতে না পারেন, কৃষক যদি তাঁর ফসলের দাম না পান, দখলদার পাকিস্তানি হার্মাদদের ডেরার বদলে নারীরা যদি ভোগ্যপণ্য হন মধ্যপ্রাচ্যের দেশে দেশে, তাহলে আমাদের বিজয়ের উদ্দেশ্য অসফলই থেকে যাবে। আমি আপনি চাইলে এই নির্মম ভবিষ্যৎধ্বংসী হাতিয়ারের হাতল হতে পারি অথবা চেষ্টা করতে পারি অতীতের বিজয়কে বর্তমান লড়াইয়ের পুঁজি করার এক নতুন চর্চা প্রচলনের ও ধারণের।

বিজয় দিবসে গারো পাহাড়ের শিশুদের সঙ্গে অনিমা হাজং যখন রংতুলি নিয়ে বিজয়ের ফুল আঁকতে বসে, তখন যেন তার মনে প্রশ্ন না জাগে, ঢাকার পরলারে কাজ সেরে দিদি কি নিরাপদে বাসায় ফিরতে পারবে? ঢাকা কি নিরাপদ? দেশটা কি নিরাপদ? এটা কি আমাদের সেই দেশ, যেখানে আমরা নিশ্বাস নিতে পারি বিশ্বাসের সঙ্গে। এই বিজয় ফুল আমাদের সবার অন্তরে ফোটাতে পারলেই আমরা সার্থকতার দিকে এগোতে পারব।

গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক ও গবেষক
[email protected]