আমি বিজয় দেখেছি?

সরদার ফজলুল করিম
সরদার ফজলুল করিম

১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় দিবস। এ দিবসে এখনো নানা অনুষ্ঠান হয়। সংবাদপত্রে ‘বিজয় দিবস সংখ্যা’ প্রকাশিত হয়। এখনো সংবাদপত্রের স্মারক সংখ্যার একটি অনিবার্য শিরোনাম: আমি বিজয় দেখেছি। আমাকেও বন্ধুবান্ধব জিজ্ঞেস করে, তুমি বিজয় দেখেছ? প্রশ্নটার জবাব তিন রকমে দেওয়া যায়। আমি বিজয় দেখেছি? আমি বিজয় দেখেছি। আমি বিজয় দেখিনি।

এর প্রতিটি জবাবেরই নিজস্ব অর্থ থাকতে পারে। কিন্তু কেবল কি এই তিন রকমের জবাবেই শেষ হয় কথাটা?

তুমি বিজয় দেখেছ? এ প্রশ্নের উত্তরে আমিও ধূসর হয়ে আসা স্মৃতির পটে হাত বোলাই, সে পট জমা বিস্মৃতির ধুলায় প্রায় আচ্ছন্ন। তবু কিছুই কি জাগে না স্মৃতিতে?

১৬ ডিসেম্বর রাজধানী ঢাকার রেসকোর্সে পাকিস্তানি বাহিনীর অধিনায়ক জেনারেল নিয়াজি পরাজিত বাহিনীর জেনারেলদের নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের মিত্রশক্তি ভারতের বাহিনীপ্রধান এবং বাংলাদেশের বাহিনী: দুই বাহিনীর যুক্ত কমান্ডের কাছে অস্ত্র সমর্পণ করেছিল। আত্মসমর্পণ করেছিল। আত্মসমর্পণের দলিলে সই করেছিল। সেই অনুষ্ঠানের আলোকচিত্র এখনো কিছু কিছু দেখা যায়। কিন্তু তার কোনো তথ্যচিত্র দেখা যায় না।

আমি আজও, এই ’৯৩-তে বেঁচে আছি। একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরও দৈহিকভাবে বেঁচেছিলাম। তবু রমনা রেসকোর্সে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের ঘটনার বিবরণ এর অধিক আমি নিজের মনের দিকে চেয়ে নিজের কাছেও দিতে পারছি না।

আসলে আমি বিজয় দেখিনি। বিজয় বলতে যদি স্বাধীন বাংলাদেশে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকার উত্তোলন হয়, যদি শত্রুপক্ষ পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠানকে সাক্ষাৎভাবে দর্শন করা হয়, তবে আমি ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় দেখিনি।

আমি আর কামরুদ্দীন আহমদ দুজনেই ছিলাম ’৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে বন্দী। কামরুদ্দীন সাহেবের নাম আজকের তরুণদের কাছে না হলেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের ছাত্র এবং বয়স্ক ব্যক্তিদের কাছে একটি পরিচিত নাম। তাঁরই ছেলে মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে শহীদ হয়েছে যত ছাত্র যুব যোদ্ধা, তাদের অন্যতম এক যুবক: নিজামুদ্দীন আজাদ। বেতিয়ারার খণ্ডযুদ্ধের স্মৃতিচারণায় তার সাথিরা এখনো তার গৌরবময় যুদ্ধের কথা স্মরণ করে।

আমি আর কামরুদ্দীন সাহেব একই দিন গ্রেপ্তার হয়েছিলাম: ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। আমাকে পাকিস্তানি বাহিনীর গুপ্ত পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল বাংলা একাডেমি থেকে। কামরুদ্দীন সাহেবকে তাঁর আইন ব্যবসায়ের একটি উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠান থেকে। গ্রেপ্তারের পর নিয়ে গেল সামরিক বাহিনীর অন্যতম নির্যাতন কেন্দ্র এমপি হোস্টেলে। দৈহিক নির্যাতন কিছু করল না। কী একজন মেজর, না কর্নেলের সামনে হাজির করল। আমাকে উদ্দেশ করে একটা হাবিলদার, না মেজর গালি পাড়ল ‘তাজউদ্দীনের বেজন্মা চেলা বলে’, ‘বাস্টার্ড সন্স অব তাজউদ্দীন’ বলে। কে একটা অফিসার ডেকে সামনে নিয়ে তৎনগদ দণ্ড শুনিয়ে দিল: কামরুদ্দীন সাহেবের ছয় মাস, না এক বছর। আর আমার দুই বছর। সন্ধ্যার দিকে আমাদের দুজনের বাঁ হাত-ডান হাত মিলিয়ে হাতকড়া পরাল। দুজনের কোমরে দড়ি বাঁধল। একটা জিপে তুলল। তারপর ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে নিয়ে গেল। ভাবলাম তবু ভালো, ক্যান্টনমেন্ট নয়।

ঢাকা জেলের দোতলা ‘নতুন বিশ ডিগ্রির’ সেলে বসে আমরা যে বাইরের পরিস্থিতি একেবারে আঁচ পাচ্ছিলাম না, তা–ও নয়। আমাদের ডিগ্রি থেকে জেলের পাশের যে বাড়িগুলো দেখা যাচ্ছিল, তার ছাদে ১৪-১৫ ডিসেম্বরের দিকে দেখেছিলাম সশস্ত্র পাকিস্তানি বাহিনীকে পজিশন নিতে। আকাশে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর সঙ্গে ভারতের জঙ্গিবিমানের যুদ্ধ: ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া নিজের চোখে দেখেছি। একদিন দেখলাম, কিছুক্ষণ ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার পরে একটা বিমান জ্বলতে জ্বলতে জিঞ্জিরার দিকে পড়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যার দিকে খবর পেলাম, ওটা নাকি মিত্রবাহিনীরই বিমান এবং বিধ্বস্ত বিমানের পাইলট নাকি পাকিস্তানের হাতে বন্দী হয়েছে। এমন খবরে দুঃখ পেয়েছিলাম। কিন্তু তবু জানতাম, বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনী অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। পরাজয় তার অনিবার্য। কেবল সময়ের ব্যাপার। মিত্র ভারত বাহিনীর অধিনায়ক পাকিস্তান বাহিনীকে অবিলম্বে আত্মসমর্পণ করতে বলে যে প্রচারপত্র বিমান থেকে ছড়াচ্ছিল, তার কিছু জেলখানাতে পড়েছিল। আমরা তা দেখেছিলাম।

১৬ ডিসেম্বর ঘটেছিল আত্মসমর্পণ। কিন্তু সে কি সকালে, না বিকেলে? আমি তা জানি না। একটা অত্যদ্ভুত অকল্পনীয় উত্তেজনাকর ঘটনা। যদি সম্ভব হতো, তাহলে ভীত-চকিত আমিও কি সেদিন সেই মুহূর্তে হাঁটি হাঁটি, পা পা করে সেই অনুষ্ঠানের কাছে ঘেঁষতে চেষ্টা করতাম না?কিন্তু তা করা আমার পক্ষে সেদিন সম্ভব হয়নি। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল। সেদিনও আমি ও কামরুদ্দীন সাহেব বন্দী ছিলাম ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে।

আইন মানা লোক আমরা। কামরুদ্দীন সাহেব প্রবীণ আইনজ্ঞ। আদর্শরকম ভদ্র। আমিও জেলখাটা, কিন্তু আইন মানা লোক। মনে করতাম: রাষ্ট্র এবং সরকার, ভালো হোক, মন্দ হোক, তা আইনের মাধ্যমে চলবে। এবং রাষ্ট্রের মানুষ আইনকে মেনে চলবে। আর তাই ’৭১-এর আগে যত কিস্তিতেই জেলে যেতে হোক না কেন, প্রতিটি কিস্তিতেই অপেক্ষা করেছি, জেলের বন্দিত্ব থেকে মুক্তিলাভের আনুষ্ঠানিক আদেশের: ‘রিলিজ অর্ডারের’।

কিন্তু ১৯৭১-এ কী করব আমরা? ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর? আমরা জানতাম না আমরা দুজন কী করব? কেউ কোনো রিলিজের অর্ডার দিল না। নিজের খুপরি ছেড়ে যে জেলের মেইন গেটে দেখতে যাব। ব্যাপারটা কী হচ্ছে, তেমন বিনা হুকুমের লোকও আমরা নই। আসলে কী অদ্ভুত রকমের গোবেচারি আর পদার্থহীন! কিন্তু তাই বলে জীবনকে জানার আগ্রহ এবং কৌতূহল কম ছিল না। দেখি না কী হয়? এরপরে কী হয়?

আমাদের জীবনে আনন্দকর সেই ঘটনাটি ঘটেছিল ১৭ ডিসেম্বর সকালে। কয়েকজন তরুণ মুক্তিযোদ্ধা কাঁধে রাইফেল ঝুলিয়ে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের গেট খুলে দিয়েছিল। শত শত দণ্ডিত এবং হাজতি বন্দী মুহূর্তের মধ্যে জেল গেটে জমায়েত হয়ে কারও নির্দেশের অপেক্ষা না করে জেলের পোশাক ছুড়ে ফেলে প্রায় বস্ত্রহীন অবস্থায় মুহূর্তের মধ্যে ঢাকা জেলের সামনে নাজিমুদ্দীন রোড দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল।

পেছনে থাকার মধ্যে জেলের ভেতরে পড়েছিলাম, আমরা দুজন: আমি আর কামরুদ্দীন। তখন জেল গেটে এসে দেখলাম: কয়েকজন জেল অফিসার বসে আছেন। আমরা তাঁদের জিজ্ঞেস করলাম: ‘এখন আমরা কী করব?’ কী হাস্যকর প্রশ্ন! অফিসার কজন আদব-দুরস্তভাবে বললেন: স্যার, আমাদের কিছু বলার নেই। এখন তো কোনো আইন নেই, হুকুম নেই। আমরা কী বলব?

তাঁরাও বাঙালি। চাকরির দায়িত্ব পালন করেছেন। তবু তাঁদের এ কথা যথেষ্ট। সেই মুহূর্তটি ছিল যথার্থই একটি শূন্যতার মুহূর্ত। আমাদের দুজনার জীবনে কেউ আর কোনো দিন এমন মুহূর্তের সাক্ষাৎ লাভ করিনি।

আমাদের চোখে-মুখে তখনো বিস্ময়ের ঘোর। আমি স্মরণ করতে পারছি না সেই ১৭ ডিসেম্বর (’৭১) তারিখে সকাল ১০টা কিংবা ১২টায় আমরা কীভাবে জেল থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম। কামরুদ্দীন সাহেবের জন্য কেউ কি এসেছিলেন জেল গেটে? প্রৌঢ় মানুষ তিনি, কেমন করে তাঁর ব্যক্তিগত জিনিসপত্রের বোঝাটি নিয়ে নিজের বাড়িতে পৌঁছেছিলেন! রিকশা বা যানবাহন বলতে তখন কিছুই ছিল না। আমাদের দুজনার মধ্যে কোনো বিদায় সম্বোধন উচ্চারিত হয়েছিল কি না, তা–ও স্মৃতিতে নেই।

আমার নিজের বোঝাটি কাঁধে নিয়ে জেল গেটের বাইরে রাস্তায় পা দিতে কেবল দেখেছিলাম জেল থেকে সদ্য বেরিয়ে যাওয়া শত শত বন্দীর পরিত্যক্ত কয়েদি পোশাকের স্তূপ। সেই স্তূপের মধ্য দিয়ে আমি আর এক বন্দী ১৭ ডিসেম্বর মুক্তির সড়কে পা দিয়েছিলাম।
১৬ ডিসেম্বর নয়, ১৭ ডিসেম্বরের এই খণ্ডচিত্রটি আমার স্মৃতিতে এখনো থেকে থেকে ভেসে ওঠে।...
১-১২-৯৩

সরদার ফজলুল করিম: (১৯২৫–২০১৪) লেখক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক