শিক্ষায় বড় পরিবর্তন: নতুন পাঠ্যক্রম

কবুল করছি, পরিকল্পিত নতুন কারিকুলাম বা পাঠ্যক্রম বিষয়ে যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত আমার হাতে নেই। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় যেসব রিপোর্ট বেরিয়েছে, সেটাই আমার পুঁজি। কাজেই শত ভুলের চোরাগলিতে পথ হারানোর ঝুঁকি আছে। তবু কিছু বলা দরকার মনে করছি। আর আশা করছি, যাঁরা এ বিষয়ে ওয়াকিবহাল আছেন, তাঁরা কিছু বলবেন। কেননা, শিক্ষায় বড় পরিবর্তনের ডাক শুনতে পাচ্ছি। অন্তত খবরগুলো তা-ই জানান দিচ্ছে। রিপোর্টারদের সব খবরের বরাত অভিন্ন, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড।

মোটাদাগের খবর, এত দিনের ঘেরাটোপ থেকে শিক্ষাকে বের আনার এক মহাযজ্ঞ শুরু হয়ে গেছে। এই নতুন কর্মযজ্ঞের সূচনা ২০১৬ সালের ২৫-২৬ নভেম্বর কক্সবাজারে দুদিনের আবাসিক কর্মশালার সুপারিশের জেরে। খবর মিলছে, প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা হতে পারে দুই বছর মেয়াদি। এখন শিশু স্কুলে দরজায় পা ফেলে পাঁচ বছর বয়স পেরিয়ে, নতুন নিয়ম চালু হলে শিশু চার বছর পেরোলেই যাবে স্কুলে। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা থাকবে না।

এবারই প্রথম প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত একযোগে শিক্ষাক্রম পরিমার্জনের যজ্ঞ শুরু হচ্ছে। পরিমার্জিত শিক্ষাক্রমে শিক্ষা হবে দক্ষতাভিত্তিক। সবার জন্য অভিন্ন ব্যবস্থা; অর্থাৎ মাধ্যমিক স্তরে বিজ্ঞান, মানবিক বা ব্যবসায় শিক্ষা বলে কোনো আলাদা আলাদা বিভাগ থাকবে না (প্রথম আলো, ডিসেম্বর ৫, ২০১৯)। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে, পড়ুয়ার হাতে নতুন পাঠ্যক্রমের বই যাবে ২০২১ সাল থেকে। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষা নেওয়া হবে ২০২৩ সালে আর মাধ্যমিক পরীক্ষা হবে ২০২৪ সালে। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে বাধ্যতামূলকভাবে প্রাক-বৃত্তিমূলক শিক্ষা নিতে হবে (ইত্তেফাক, মে ৩০, ২০১৯)। তবে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে বিজ্ঞান, মানবিক, ব্যবসায় শিক্ষা বিভাজন বহাল থাকবে। সেভাবেই উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা নেওয়া হবে। মনে রাখতে হবে, জাতীয় শিক্ষাক্রমের চৌহদ্দি এই দ্বাদশ শ্রেণিতে খতম।

ধারণা করি, এ কর্মযজ্ঞের ভিত্তি আমাদের সংবিধান যেখানে প্রত্যেক শিশুর শিক্ষালাভের অধিকার স্বীকার করা হয়েছে। সংবাদ প্রতিবেদনগুলোতে স্পষ্ট বলা আছে, চারটি দলিল মেনে শিক্ষাক্রমের আগাপাছতলা সংস্কারের এই মহাযজ্ঞ: ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতি, ২০৩০ সালের মধ্যে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) ৪ নম্বর লক্ষ্য, বাংলাদেশ উন্নয়ন রূপকল্প ২০৪১ এবং আওয়ামী লীগের ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহার।

নতুন এই শিক্ষাক্রমের লক্ষ্য আমাদের সন্তানদের চলতি দুনিয়ার যোগ্য ও দক্ষ করে তোলা। দালিলিক দাবি, চলমান শিক্ষাক্রম যেখানে মূলত উদ্দেশ্যভিত্তিক ও শিখনফলভিত্তিক, সেখানে এবার পরিমার্জিত এ শিক্ষাক্রম হবে যোগ্যতা ও দক্ষতাভিত্তিক। খসড়া শিক্ষাক্রম মতে, প্রাক-প্রাথমিক থেকে শুরু করে দশম শ্রেণি পর্যন্ত মূল ১০টি দক্ষতা অর্জনের লক্ষ্যে ১০টি বিষয় পড়ানো হবে, সঙ্গে পরীক্ষার বোঝা কমানোর অঙ্গীকার। এখন প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ২৪টি পাঠ্যবই, ষষ্ঠ থেকে অষ্টম পর্যন্ত ১৩টি, নবম-দশমে একেক জনকে ১৪টি বই পড়ানো হয়। নতুন নিয়মে ১৪টি বিষয় থেকে চারটি বিষয় কমিয়ে ১০টি বিষয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষা হবে (সমকাল, নভেম্বর ২৯, ২০১৯)।

এ পর্যন্ত শুনতে বেশ ভালোই লাগছে। আমাদের সন্তানেরা বই আর পরীক্ষার বোঝা থেকে মুক্ত হবে। কর্মদক্ষ হয়ে উঠবে। পাস করে ঢুকে পড়বে জীবিকার হরেক বাজারে, দেশে ও বিদেশে। ভালো আয় উপার্জন করে নিজের, পরিবারের এবং দেশের সমৃদ্ধি ঘটাবে। এসব খবর জেনে কে না খুশি হবে?

কিন্তু অনেক অস্পষ্ট কথা রয়েছে খবরের অলিগলিতে, যদিও এখনই খুব গভীরে যাওয়ার সুযোগ কম। যেমন তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা না নিয়ে কীভাবে ধারাবাহিক মূল্যায়ন করা যায়, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছে। মাধ্যমিক (দশম শ্রেণি পর্যন্ত) পরীক্ষায় মানবিক, বিজ্ঞান বা ব্যবসায় শিক্ষা বলে আলাদা কোনো বিভাগ থাকবে না, সবাই একই বিষয় পড়বে। কিন্তু সেখানে গুচ্ছ করা হয়েছে অন্তত চারটা আর তার মধ্যে অন্তত দুটো থেকে নাকি সুযোগ থাকবে বিষয় পছন্দেরও! কিছু বিষয়ে পাবলিক পরীক্ষা নেওয়া হবে না, স্কুলেই ধারাবাহিক মূল্যায়ন করা হবে, স্কুল থেকে নম্বর যাবে বোর্ডে, ট্রান্সক্রিপ্টে তা লেখাও থাকবে, কিন্তু সে নম্বর যোগ হবে না, কোনো ফায়দাও পাবে না পড়ুয়া। চতুর্থ বিষয়ও নেওয়া যাবে; কিন্তু তারও ফল ভোগে লাগবে না পড়ুয়ার! তাহলে মূল্যায়নে স্বচ্ছতার প্রশ্ন তো আছেই। তার চেয়ে বড় কথা, এসব বিষয় শিক্ষার্থীরা আদৌ পড়ে কি না। আবার এটাও বলা নেই যে, ধারাবাহিক মূল্যায়নে দুর্বল শিক্ষার্থীর জন্য নিরাময়মূলক কী কী ব্যবস্থা থাকবে। শিক্ষা দক্ষতাভিত্তিক হলে হাতে-কলমে শিক্ষাই উপায়। কিন্তু তার কোনো দিকনির্দেশনা খবর পড়ে খুঁজে পেলাম না।

শিক্ষাক্রম পরিমার্জনে নিড অ্যাসেসমেন্ট বা চাহিদার পরিমাপ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রাথমিক স্তরের জন্য যে চাহিদা পরিমাপ করা হয়েছিল তা নাকি নানা প্রশ্নের মুখে পড়ে। ২০২১ সালে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে নতুন পাঠ্যবই পড়ুয়াদের হাতে তুলে দেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হলেও শিশু শ্রেণির পাঠ্যবই দেওয়া হবে ২০২২ সালে (যুগান্তর, এপ্রিল ২৮, ২০১৯)।

এসব শিক্ষাবিদও ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। অধ্যাপক ছিদ্দিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেছেন, একমুখী শিক্ষা চালুর পরিকল্পনাটি ভালো; কিন্তু সতর্ক না হলে বিপর্যয় হতে পারে (ডিসেম্বর ৫, ২০১৯)। আর সিলেবাস ভারী হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ। তাঁর অভিযোগ, ‘আমাদের বই মোটা মোটা, ম্যাটেরিয়াল উন্নত নয় (ইত্তেফাক, মে ৩০, ২০১৯)।’ রফিকুল ইসলাম নামের একজন অভিভাবক সোজাসাপটা বলেছেন, মাধ্যমিকের প্রতিটি শ্রেণিতে বইয়ের পৃষ্ঠা বেশি, সিলেবাসও কঠিন। সে কারণে পড়ুয়ারা কোচিংয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে। তিনি পাঠ্যবই সহজ এবং সিলেবাস কমানোর দাবি জানিয়েছেন (ইত্তেফাক, মে ৩০, ২০১৯)। সম্ভবত তিনি গোটা বাংলাদেশের শিক্ষার্থী আর অভিভাবকদের মনের কথাটিই বলেছেন। এনসিটিবির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুহম্মদ এলতাসউদ্দিন এ লেখককে বলেছেন, একমুখী শিক্ষায় গুচ্ছের কোনো জায়গা নেই। এগুলো স্রেফ ধোঁকাবাজি।

খবরগুলো পড়ে মনে হয়, শিক্ষাক্রম পরিমার্জনে কিছু প্রাথমিক কাজ হয়েছে। আসল কাজ এখনো বাকি। কিছু সরেজমিন তথ্য-তালাশ করা গেছে; তবে তা কতটুকু কাজের আর কতটা দায়সারা, সে প্রশ্নে জেরবার অনেকেই। মজার কথা, কোনো সিদ্ধান্তই নাকি এখনো পাকাপাকি হয়নি। এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণচন্দ্র সাহার বরাতে প্রথম আলো লিখেছে, কী কী বিষয় শিখিয়ে একজন শিক্ষার্থীকে যোগ্য করে তোলা হবে, তা মোটামুটি ঠিক হয়েছে। তার আলোকে এখন কোন শ্রেণিতে কী কী ও কয়টা বই হবে, তা ঠিক করা হবে (প্রথম আলো, ডিসেম্বর ৫, ২০১৯)। বই লেখা, সম্পাদনা, ছাপা এসব তো হনুজ দূর অস্ত। আরেকটা বড় প্রশ্ন, কারা লিখবেন এসব পাঠ্যবই? কেননা, অতীতে অনেক লেখকই ঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেননি; অনেকের হয়তো যোগ্যতাও ছিল না। কিন্তু ঢোল পেটানো শুরু, ২০২৩ থেকে পঞ্চম ও অষ্টম আর ২০২৪ থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা নেওয়া হবে নতুন কারিকুলামেই!

পরিকল্পিত শিক্ষাক্রম চুলচেরা বিশ্লেষণের দাবি রাখে। কেননা, কাগজের খবরে অনেক প্রশ্নের জবাব মিলছে না। আশা করি, আগামী দিনে আমরা তা আলোচনার চেষ্টা করব।

আমিরুল আলম খান: শিক্ষা-গবেষক এবং যশোর বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান।
amirulkhan7@gmail. com