অপুষ্ট এক ভবিষ্যৎ প্রজন্ম

অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের সারিতে ঢুকে পড়েছে। বিশ্বব্যাংকের এ বছরের দারিদ্র্য পর্যালোচনা সমীক্ষায় দেখা গেছে, গত এক দশকে আমাদের দারিদ্র্য কমে এসেছে অর্ধেকে। খাদ্য উৎপাদনে গত কয়েক বছরে আমরা আশাতীত উন্নতি করেছি। মানব উন্নয়ন সূচকেও প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে আমাদের অবস্থান বেশ ভালো। এ পটভূমিকায় সহজেই এমন আত্মতৃপ্তি আসতে পারে যে আমাদের পুষ্টি-পরিস্থিতিও তাহলে নিশ্চয়ই যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক।

৬ ডিসেম্বর প্রকাশিত প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদন সেই আশাব্যঞ্জক অনুমানে ঠান্ডা পানি ঢেলে দিয়েছে। খবরটি বলছে, দেশের প্রায় ২ কোটি ১০ লাখ মানুষ পুষ্টিকর খাবার পাচ্ছে না। এর আগে ৪ নভেম্বর প্রথম আলো ‘খাদ্য উৎপাদন ও অপুষ্টি দুটোই বেড়েছে’ শিরোনামে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। সেই প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন তিন থেকে পাঁচ গুণ বাড়া সত্ত্বেও গত এক বছরে দেশে অপুষ্টিতে ভোগা মানুষের সংখ্যা মোটেই কমেনি, বরং বেড়েছে আরও চার লাখ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ‘বৈশ্বিক খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টি পরিস্থিতি’ এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার ‘বৈশ্বিক ক্ষুধাসূচক’-এর প্রতিবেদনের ভিত্তিতে করা এ প্রতিবেদন বলছে, দক্ষিণ এশিয়ার শ্রীলঙ্কা, ভুটান, নেপাল ও মালদ্বীপের তুলনায় বাংলাদেশের মানুষের খাদ্যশক্তি গ্রহণের পরিমাণ কম। শুধু খাদ্যশক্তিই নয়, মাংস ও দুধের মতো পুষ্টিকর আমিষ গ্রহণের দিক থেকেও বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। এর অনিবার্য ফলাফল অপুষ্টি। এ অপুষ্টির সবচেয়ে করুণ শিকার শিশু এবং গর্ভবতী ও প্রসূতি মা, যাঁরা আমাদের ক্রম–উন্নতিশীল এ রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ রচনা করছেন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ওয়েবপেজে সম্প্রতি প্রকাশ পাওয়া ‘প্রগতির পথে’ নামে অন্য আরেকটি জরিপের প্রারম্ভিক প্রতিবেদনের দিকে চোখ ফেরানো যাক। ইউনিসেফের কারিগরি সহযোগিতায় পরিচালিত এই প্রতিবেদন আমাদের দিচ্ছে মা ও শিশুর স্বাস্থ্য, পুষ্টি, শিক্ষাসহ মানব উন্নয়নের কয়েকটি সূচকের সাম্প্রতিক ছবি। আমরা দেখতে পাচ্ছি, সামগ্রিকভাবে শিশুর পুষ্টিপরিস্থিতির উন্নয়ন দৃশ্যমান হলেও বেশ কিছু গুরুতর প্রচ্ছন্ন ঝুঁকি এখনো রয়ে গেছে, এমনকি শিশুপুষ্টির গুরুত্বপূর্ণ কিছু সূচকের ধারাও অবনতির দিকে। যেমন, শিশু জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে মায়ের দুধ দান, দুধদানের ব্যাপ্তিকাল ও শিশুখাদ্যের বৈচিত্র্য—এই তিনটি সূচকেই গত ছয় বছরে অবস্থার অবনতি ঘটেছে। ২০১৩ সালে জন্মের পরপরই শিশুকে শালদুধ খাওয়াতেন ৫৭ শতাংশ মা। ২০১৯ সালে সেটি নেমে এসেছে ৪৬ শতাংশে। কমে এসেছে মায়ের দুধ খাওয়ানোর ব্যাপ্তিকালও। এ ছাড়া প্রতি দশটি শিশুর মধ্যে সাতজনের ভাগ্যেই ন্যূনতম পুষ্টিবৈচিত্র্যময় খাবার জুটছে না।

আমরা জানি, শিশুর জন্মের পরপরই শালদুধ দান, ছয় মাস বয়সের পর পুষ্টির বিচারে বৈচিত্র্যময় খাবার এবং পুরো দুই বছর পর্যন্ত মায়ের দুধ খাওয়ানো শিশুর পূর্ণ বিকাশের আবশ্যিক শর্ত। চিকিৎসাবিজ্ঞান বলছে, এসব যথাযথভাবে করা গেলে শিশুর শারীরিক বৃদ্ধি ও মানসিক বিকাশ যথাযথ ও দ্রুত হয়। সে বুদ্ধিদীপ্ত ও সক্ষম মানুষ হিসেবে বেড়ে ওঠে। এ কারণে চিকিৎসক, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বিশেষজ্ঞ এবং নীতিনির্ধারকেরা এই সূচকগুলোর ওপর খুবই গুরুত্ব দিচ্ছেন। বাংলাদেশের মতো স্বল্প সম্পদের দেশ শুধু এই সূচকগুলোর সাফল্যের মধ্য দিয়ে শিশুমৃত্যুর ঝুঁকি ও সংক্রামক রোগের ঝুঁকি দারুণভাবে কমিয়ে আনতে পারে। দেশের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য নতুন প্রজন্ম তৈরি করারও এটিই মূল ভিত্তি। চীনের অভিজ্ঞতা এ ক্ষেত্রে আমাদের উদাহরণ হতে পারে।

প্রশ্ন হলো গত ছয় বছরে এসব সূচকে আমাদের পিছিয়ে পড়ার কারণ কী? সেভ দ্য চিলড্রেনের বছরখানেক আগের একটি প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে অযাচিত অস্ত্রোপচার-নির্ভর প্রসবের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। যথাযথ ব্যবস্থাপনা ও পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদির অভাবে প্রসূতি ও শিশুর উল্লেখযোগ্য অংশ আক্রান্ত হয়ে পড়ছে বিভিন্ন সংক্রামক রোগে। ফলে জন্মের পরপর শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়ানো যাচ্ছে না। অস্ত্রোপচারের পর মায়ের চেতনা ফেরার আগে শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়ানোর জন্য যে দক্ষ আর উদ্যোগী স্বাস্থ্যকর্মী দরকার, দেশে তার প্রকট অভাব। শালদুধ নিয়েও অজ্ঞতা ও কুসংস্কার ব্যাপক। বাংলাদেশে ঘরে সন্তান প্রসবের সংখ্যা এখনো যথেষ্ট এবং সেখানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ধাত্রীদের মধ্যেও শালদুধ নিয়ে কুসংস্কার কাটেনি।

শিশুকে মায়ের দুধ ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানোর ব্যাপ্তিকাল যে ২০১৩ সালের চেয়েও কমে এসেছে, তার কারণ জটিল। দেশের অর্থনীতিতে নারীদের সম্পৃক্ততা বেড়েছে। এতে নারীদের আত্মনির্ভরশীলতা এবং পারিবারিক সচ্ছলতাও এসেছে। কিন্তু নারীবান্ধব কর্মক্ষেত্র এবং সামাজিক সুরক্ষা-বলয়ের অভাব মা ও শিশুর সম্পর্ককে জটিল সমীকরণের দিকে ঠেলে দিয়েছে। মায়ের কাছাকাছি থাকতে না পারায় বহু শিশু বঞ্চিত হচ্ছে মায়ের দুধ ও সঠিক পুষ্টিকর খাবার থেকে। আমাদের দেশে কর্মক্ষেত্রে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র তো দূরস্থান, অনেক প্রতিষ্ঠানে ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটিও দেওয়া হয় না। ফলে বহু মা সন্তানকে দুই বছর তো দূরের কথা, ছয় মাসও দুধ দিতে পারেন না। তার জায়গা দখল করে নেয় কৌটার দুধ, যা পুষ্টির বিচারে মায়ের দুধের কোনো বিকল্পই হতে পারে না। আর নিম্নবিত্ত মায়েরা তো কৌটার দুধের বদলে শিশুর খিদে মেটান চালের গুঁড়া বা সুজিজাতীয় শর্করায়। দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিক বেড়ে ওঠে প্রয়োজনীয় আমিষ, চর্বি, ভিটামিন আর মিনারেল ছাড়াই। এখনো আমাদের নিয়তি তাই প্রতি পাঁচটিতে একজন খর্বকায় এবং প্রতি নয়টিতে একজন কৃশকায় শিশু।

এখন আমরা করবটা কী? সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষকে উদ্যোগী হয়ে ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি এবং কৌটার দুধের প্রচারের ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইনের কঠোর প্রয়োগ ঘটাতে হবে। কর্মক্ষেত্রগুলোতে দিবাযত্ন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার জন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে উদ্যোগী করে তোলা প্রয়োজন। চিকিৎসক বা নার্স থেকে শুরু করে স্বাস্থ্যকর্মী-মাঠকর্মী-ধাত্রীদের শিশুর পুষ্টি বিষয়ে প্রশিক্ষণ তো দিতেই হবে। বস্তুত বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক উন্নয়নকে গতি দিতে হলে অপুষ্টি নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ নীতি গ্রহণ ও তার বাস্তবায়ন দরকার। এটা করতে হবে মাঠপর্যায় থেকে উঠে আসা নিয়মিত পরিসংখ্যান ও তথ্যের নিবিড় বিশ্লেষণের ভিত্তিতে। বহু খাতভিত্তিক সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কিংবা মাঠকর্মী বা ধাত্রীদের মাধ্যমে এ পরিস্থিতির খোলনলচে পাল্টাবে না।

আসফিয়া আজিম: জনস্বাস্থ্য ও পুষ্টিকর্মী