নাগরিকত্ব হরণের জার্মান ইতিহাস

জার্মান ইহুদীদের নাগরিকত্ব হরণের সংবাদ, ১৯৩৫ সালের একটি মার্কিন সংবাদপত্রে। কৃতজ্ঞতা: ইউনাইটেড স্টেইটস হলোকস্ট মেমরিয়াল মিউজিয়াম।
জার্মান ইহুদীদের নাগরিকত্ব হরণের সংবাদ, ১৯৩৫ সালের একটি মার্কিন সংবাদপত্রে। কৃতজ্ঞতা: ইউনাইটেড স্টেইটস হলোকস্ট মেমরিয়াল মিউজিয়াম।

প্রাচীন ইতিহাসে মোসোপটেমীয় সভ্যতার নগর রাষ্ট্রগুলোতে স্থানীয় লোকজনের নাগরিক অধিকার কেড়ে নেওয়ার বিবরণ পাওয়া যায়। সেই থেকে শুরু। প্রথম বড় ধরনের রাষ্ট্রহীন জাতির হদিস পাওয়া যায় ধর্মে—বনি ইসরাইল জাতিকে ঘিরে। যুগে যুগেই নাগরিকদের বিভিন্ন সময় রাষ্ট্রহীন করা হয়েছে। গত শতকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিভিন্ন সাম্রাজ্যের পতন, তুরস্ক ও গ্রিসের মধ্যে নাগরিক বিনিময়, রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লবসহ বিভিন্ন কারণে রাষ্ট্রহীন নাগরিকের সংখ্যা বাড়তে থাকে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় ১৯৩০ সালে নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগ শহরে রাষ্ট্রগুলো মিলিত হয়ে রাষ্ট্রবিহীন উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব পুনর্বহালের জন্য কনভেনশনে স্বাক্ষর করে।

দ্য হেগ কনভেনশন স্বাক্ষরের পর পরিস্থিতির খুব বেশি উত্তরণ ঘটেনি। বরং আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করে। নাৎসি জার্মানি আইন করে ইহুদিসহ রাইখের শত্রুদের নাগরিকত্ব গণহারে বাতিল শুরু করে। মিয়ানমার যেভাবে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেয়নি, বিশুদ্ধ বর্মি জাতীয়তাবাদের চেতনা থেকে সেভাবেই বিশুদ্ধ আর্য জাতি গঠনের প্রচেষ্টা নাৎসি জার্মানি করেছিল।

ইতিহাসের অনেক ঘটনাই সময়ের বাঁকে বাঁকে নানা চরিত্রের মাধ্যমে স্থানভেদে ফিরে আসে। অ্যাডলফ হিটলার ও গোয়েবলসের ছায়া দেখা যাচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নেতাদের মধ্যে। নাৎসি জার্মানিতেও ইহুদিরাই ছিল মূল লক্ষ্য। বহিরাগত অভিযোগ তুলে জার্মানিতে ইহুদিদের নাগরিকত্ব ও সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। আইন করে জার্মান ইহুদিদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করা হয়। বিভাজিত করা হয়েছিল জার্মান ও ইহুদি বলে। এমন যেন, ইহুদিরা জার্মান হতে পারে না বা পারবে না।

জার্মান ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ১৯৩৫ সালের সেপ্টেম্বরে নুরেমবার্গ আইনের মাধ্যমে ইহুদিদের নাগরিকত্ব বাতিল করা শুরু হয়। তবে এই প্রক্রিয়া শুরু হয় নাৎসিরা ক্ষমতায় আসার পরপরই। ১৯৩৩ সালে এক আইনের মাধ্যমে ইহুদিসহ বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর নাগরিকত্ব বাতিল করে হিটলারের নাৎসি সরকার। ওই সময় প্রায় ৮ হাজার ইহুদির নাগরিকত্ব বাতিল হয়। ১৯৩৫ সালে নুরেমবার্গে এক নাৎসি সমাবেশে নতুন দুটি আইনের ঘোষণা দেওয়া হয়। দ্য রাইখ সিটিজেনশিপ আইনে বলা হয়, একমাত্র পরিশুদ্ধ জার্মান রক্ত বহনকারীরা নতুন আইনের আওতায় জার্মানির নাগরিক বলে বিবেচিত হবে। ওই আইনের মাধ্যমে ইহুদিরা ভোটাধিকার হারায় এবং রাষ্ট্রবিহীন নাগরিকে পরিণত হয়। এমনকি নাগরিকত্ব সনদ বা পাসপোর্ট বাতিল করায় ইহুদিদের বৈধভাবে ভিসা নিয়ে জার্মানি ত্যাগের সুযোগ ছিল না।

১৯৩৫ সালের দ্বিতীয় আইনটি ছিল জার্মান বা আর্য রক্ত সংরক্ষণের জন্য। এই আইনে ইহুদিসহ অন্যান্য নৃগোষ্ঠীর সঙ্গে জার্মানদের বিয়ে নিষিদ্ধ করা হয়। এমনকি ইহুদিদের সঙ্গে জার্মানদের বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কেরও অনুমতি ছিল না। ইহুদিরা ৪৫ বছরের কম কোনো জার্মান নারী বা তাদের রক্তের সম্পর্কিত কাউকে গৃহকর্মে নিয়োজিত করতে পারত না। ইহুদিদের জার্মান পতাকা ওড়ানোর ও ব্যবহারের অনুমতি ছিল না। দেশের রাষ্ট্রীয় রংও ইহুদিদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল। তবে ইহুদিরা চাইলে নিজস্ব ধর্মীয় রং ব্যবহার করতে পারত। সর্বোপরি ইহুদিদের ধর্মীয় অধিকার রাষ্ট্রের কাছে মানে রাইখের কাছে সংরক্ষিত থাকবে বলে ওই আইনে বলা হয়েছিল। ফলে ইহুদিরা কখন বা কীভাবে ধর্মীয় রীতি-নীতি পালন করবে, তারও সিদ্ধান্ত আসবে রাইখের কাছ থেকে।

এই আইন প্রণয়নের ফলে স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, কে ইহুদি আর কে ইহুদি না—এটা কীভাবে নির্ধারণ করা হবে। কারণ ইহুদি পরিবারে জন্ম নিয়ে খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করলে কেউ আর ইহুদি বলে বিবেচিত হবে না। কিন্তু নাৎসিরা এই যুক্তি মানতে নারাজ ছিল। তারা ইহুদিবাদকে কোনো ধর্ম বা সংস্কৃতির নিরিখে বিবেচনা না করে জাতি বা বর্ণ হিসেবে বিবেচনা করত। তাই ধর্মান্তরিত হয়ে ইহুদিবাদ ত্যাগের কোনো সুযোগ ছিল না। নাৎসিদের মতে, ইহুদি হিসেবে জন্মগ্রহণ করলেই আজীবন ইহুদি বলেই চিহ্নিত হবে। ১৯৩৫ সালের নভেম্বরে এ বিষয় একটি আইন প্রণয়ন করা হয়। এতে বলা হয়, কারও পূর্ববর্তী তিন পুরুষ ইহুদি ধর্ম পালন করলেই তাকে ইহুদি বলা হবে। সদ্য খ্রিষ্টের ধর্মে আগতরাও ইহুদি বলে বিবেচিত হবেন।

এরপর ১৯৪১ সালে একাদশ ডিক্রি জারির মাধ্যমে ঢালাওভাবে ইহুদিদের বিতাড়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। বিশেষ করে যেসব ইহুদির অন্য কোনো দেশে বসবাসের অনুমিত ছিল, তাদের নাগরিকত্ব সরাসরি বাতিল করে দেওয়া হয়।

বোঝাই যাচ্ছে, নানা ধরনে আইনগত বাধা তৈরি করে জার্মানিতে ইহুদিদের রাষ্ট্রবিহীন করা হয়। এদের জন্য নির্মাণ করা হয় কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। আরাকানে ও আসামে নাগরিকত্ববিহীন মানুষের জন্য একই ধরনের ব্যবস্থা করা হয়েছে বা করা হবে বলে বলা হচ্ছে। অ্যাডলফ হিটলারের ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট ওয়ার্কার্স পাটি (নাৎসি) ১৯৩৩ সালে বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়েই ক্ষমতায় এসেছিল। ওই সময় ইউরোপের শ্রমিক শ্রেণি নাৎসি পার্টিকে সমর্থন করত। হিটলার প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ভগ্নদশা থেকে জার্মানিকে বের করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে জাতীয়তাবাদের সঙ্গে অর্থনীতিকে যুক্ত করেছিলেন।

জাতিবাদী নাগরিকত্ব হরণের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, নাগরিকত্ব হারানো জনগোষ্ঠীর জীবনাচরণ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা। নাৎসিরা ইহুদিদের জীবনাচরণ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে। করুণ পরিহাস হলো, জার্মানিতে সম্ভবত যে আইনে অস্ট্রীয় হিটলারের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছিল, সেই আইনেই ইহুদিদের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়েছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসিদের পতনের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদের বিদায় হয়েছিল বলে ধারণা করতেন অনেকেই। কিন্তু ফ্যাসিবাদ সময়ের আড়ালে লুকিয়ে ছিল। মনে রাখতে হবে, হিটলার-মুসোলিনিরাও নির্বাচিত ছিলেন। নির্বাচিত সরকারে আড়ালে থাকা ফ্যাসিবাদ সুযোগ পেলেই সময়ের আড়াল থেকে আত্মপ্রকাশ করছে।

ফ্যাসিবাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এটা একটি দেশের সীমারেখাতেই আবদ্ধ থাকে না। আশপাশের দেশগুলোও ফ্যাসিবাদের হলকা টের পায়। নাৎসিদের হাত থেকে পোল্যান্ড, চেক রিপাবলিক, নেদারল্যান্ডস কেউই রক্ষা পায়নি।

ড. মারুফ মল্লিক: ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো, ইনস্টিটিউট অব অরিয়েন্ট অ্যান্ড এশিয়ান স্টাডিজ, ইউনিভার্সিটি অব বন