মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কাণ্ড

স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর রাজাকারের তালিকার নামে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় যে কাণ্ড করেছে, তা শুধু অনাকাঙ্ক্ষিত ও অনভিপ্রেতই নয়, তা অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। একাত্তরে যাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছেন, তাঁরাই হলেন মুক্তিযোদ্ধা। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কেরামতিতে তাঁদের অনেকের নাম রাজাকারের তালিকায় ঢুকে গেছে।

মন্ত্রণালয় প্রথম ধাপে ১০ হাজার ৭৮৯ জন রাজাকারের তালিকা দিয়েছিল। তালিকা প্রকাশের পর দেখা গেছে, তাতে অনেক ভাতাপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধার নাম আছে, আছেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এবং শহীদের স্ত্রী। তালিকা প্রকাশের পর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন মহল থেকে প্রতিবাদ ওঠে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তালিকার সমালোচনা করে বলেছেন, রাজাকারের তালিকায় কোনো মুক্তিযোদ্ধার নাম থাকতে পারে না। যেসব শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবার এই তালিকায় আহত হয়েছেন, তাঁদের প্রতি গভীর সমবেদনাও জানিয়েছেন।

 প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর মঙ্গলবার মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় রাজাকারের তালিকাটি স্থগিত ঘোষণা করেছে। তারা বলছে, তালিকা যাচাই-বাছাই করে আগামী ২৬ মার্চ রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করা হবে। কিন্তু সেই তালিকা কতটা নির্ভুল হবে, সেই সংশয় রয়েই যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় শুরু থেকে প্রায় প্রতিটি কাজে দুর্নীতি, অসততা ও অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। বিএনপির আমলে এই মন্ত্রণালয় স্বাধীনতাযুদ্ধ: দলিলপত্র–এর তৃতীয় খণ্ডে সংযোজন-বিয়োজন ইতিহাস বিকৃতি করেছিল। আওয়ামী লীগ সরকার মুক্তিযুদ্ধের সময় বিদেশি বন্ধুদের সম্মাননা দেওয়ার একটি মহৎ উদ্যোগ নিয়েছিল, যা দেশ-বিদেশে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বিদেশি বন্ধুদের দেওয়া পদকের সোনা বারো আনাই খেয়ে ফেলেছেন। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, ‘যেখানে পদকে ষোলো আনা সোনা থাকার কথা, সেখানে দেওয়া হয়েছিল চার আনা।’

তাদের অপকর্ম এখানেই শেষ নয়। গত ১১ বছরে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় বহু ব্যক্তিকে নতুন করে মুক্তিযোদ্ধা সনদ দিয়েছে, যাঁদের অনেকে পরে অমুক্তিযোদ্ধা প্রমাণিত হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একজন সাবেক সচিব ভুয়া সনদ দেখিয়ে চাকরির বয়স বাড়িয়ে নিয়েছিলেন। পরে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে স্বাধীনতার পূর্বাপর সরকারগুলোর আমলে মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়ে নয়ছয় হলেও মুক্তিযোদ্ধাদের চাকরির বয়সসীমা বাড়ানোর পর সেটি অনেক বেড়ে যায়। আবার অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা সনদের জন্য মন্ত্রণালয় ও জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের কাছে বছরের পর বছর ধরনা দিয়েও সনদ পাননি। এর পেছনে রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি ছাড়াও উৎকোচ-বাণিজ্যেরও বিস্তর অভিযোগ আছে।

 মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় রাজাকারের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করে যে অন্যায় করেছে, স্থগিত করার ঘোষণা দিলেই তা থেকে মাফ পাওয়ার সুযোগ নেই। মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের সদস্যদের নাম রাজাকারের তালিকাভুক্ত করে তাঁদের সামাজিকভাবে যেভাবে হেয় ও বিপর্যস্ত করা হলো, তার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। ক্ষমতাসীন দলের কেউ কেউ এর ভেতরে ষড়যন্ত্র ও অন্তর্ঘাতের গন্ধ খুঁজছেন। ষড়যন্ত্র হোক আর অন্তর্ঘাত হোক, সত্য উদ্‌ঘাটন করতে হবে। যেহেতু মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় নিজেই রাজাকারের তালিকা প্রণয়ন করেছে, সেহেতু মন্ত্রণালয়ের কাউকে দিয়ে এর তদন্ত হতে পারে না। অন্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের দিয়ে তদন্ত করালেও সেটি তাদের মনঃপূত হবে না। স্বচ্ছতার স্বার্থে এই ঘটনার একটি গ্রহণযোগ্য ও স্বাধীন তদন্ত এবং দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি।

তবে মুক্তিযোদ্ধা কিংবা রাজাকার, যে তালিকাই করা হোক না কেন, এ রকম কিছু নির্ভুলভাবে প্রণয়নের ক্ষমতা যে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নেই, তা প্রমাণিত হয়ে গেছে। এই বাস্তবতা দুর্ভাগ্যজনক।