পরিবার ও ব্যক্তি নিয়েই মানুষ চিন্তিত

সেদিন ছিল আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস, প্রেসক্লাব এলাকায় প্রচণ্ড ভিড়। প্রায় সব বিক্ষোভ মানবাধিকার রক্ষাকে কেন্দ্র করে। তার এক পাশে একাকী বসে ছিল দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদ নিয়ে অনশন করা চা বিক্রেতা আরমান হোসেন। ফুটপাতের এক কোণে দাঁড়িয়ে খেয়াল করলাম যে প্রতিবাদকারীদের বেশির ভাগের বক্তব্য স্বাধীনতা, ধর্ম এবং মতপ্রকাশের মতো ধারণাগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত না হয়ে বরং ঘুরছিল আরেকটা বিষয়কে কেন্দ্র করে: পেঁয়াজের দাম।

এর থেকে এটাই বুঝতে পারা যায় যে মানবাধিকার-সম্পর্কিত কথোপকথনের ধারাও এখন নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে আলাপে নেমে এসেছে। এর অর্থ হলো, ন্যায়বিচারের ধারণাটি এখন নতুন অর্থ পেয়েছে। সহজ কথায় আজকের রাজনীতি একটি সাধারণ উপাদানের কাছে নেমে এসেছে: সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা। যদিও আমরা অনেকেই ওপরতলায় থেকে রাজনৈতিক সংকট সমাধানের জন্য গণতন্ত্র এবং ন্যায়বিচারের প্রতি খুব বেশি মনোনিবেশ করে কাজ করছি, জনগণ কিন্তু তাদের ব্যক্তি ও পরিবারের প্রাথমিক স্বার্থের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত বিষয় সম্পর্কে বেশি চিন্তিত। এবং তারা সেটা প্রমাণ করার জন্য রাস্তায় নেমে আসতে ভয় পাচ্ছে না।

উদারবাদ ও গণতন্ত্রবিষয়ক ওপরতলার ব্যাপারগুলো মানুষকে রাস্তায় নামাতে পারছে না। সামাজিক সমস্যা দাঁড়িয়েছে অপরের সমস্যা হয়ে। আপনের ধারণা ক্রমাগত টুকরা হতে হতে ক্ষুদ্রতম অবস্থানে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। শ্রেণি, ধর্ম, বর্ণ ইত্যাদিতে তো আগেই বিভাজিত ছিল এখন আরও বিভাজিত হচ্ছে; প্রতিষ্ঠান মতাদর্শ, মহল ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে। মানুষ এখন ব্যক্তিগত হয়ে যাচ্ছে এবং সেই ব্যক্তি তার পরিবার নিয়েই বেশি চিন্তিত।

বিগত দশকে যে কয়টি বড় সামাজিক আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে, তার অধিকাংশই গড়ে উঠেছে তখনই, যখন দৃঢ়ভাবে বোনা মানুষের ক্ষুদ্র সম্প্রদায়, যেমন পরিবার, বন্ধু গোষ্ঠী, সহপাঠী বা প্রতিবেশীরা সরাসরি আক্রান্ত হয়েছে। প্রায়ই এসব একক আরও ভেঙে হয়ে যায় একলা ব্যক্তির স্বার্থ। এই দিক দিয়ে আমরা আসলেই ‘আধুনিক’ হয়েছি। এ জন্য যখন সরাসরি নিজের পেটে লাথি পড়ে, তখনই সাড়া দিই। এখন যেমন বাজারের আর মাটির উদ্বেগ চলে এসেছে একদম সামনে।

যখন জাতীয় পর্যায়ে বড় মানবাধিকার বা ন্যায্যতার লঙ্ঘন ঘটে, তখন প্রশ্ন ও নিন্দা প্রবাহিত হয় ঠিক, তবে সেটা সেই পরিমাণে বৃহত্তর সংহতি তৈরি করে না; যে পরিমাণে করার কথা। এমনকি বুয়েটে আবরার ফাহাদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডও দেশব্যাপী আন্দোলন জোরদার করতে পারেনি, বরং সেটা নির্দিষ্ট একটা প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে পরিণত হয়েছে, যেখানে কিনা বেশির ভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই একই রকম কাঠামোগত সন্ত্রাসের সমস্যাটি প্রচলিত।

আবরারের হত্যা ছাড়াও এ দেশে কাঠামোগত কারণে ধর্ষণ, খুন, অপহরণ, হামলা ও হুমকি-ধমকির ঘটনা নিয়মিত ঘটে। কিন্তু কোনো আন্দোলন জোরদার হয় না। হতে পারে যে এই ঘটনাগুলোকে কেবলই ব্যক্তির সমস্যা হিসেবে দেখা হয়, সমাজের নয়।

মিডিয়ায় খবর হওয়ার ক্ষমতার নিরিখে বড় ঘটনায় আমরা শুধু অপরাধীর বিচার চাই। আর ছোট ঘটনায় চুপচাপ ভুলে গিয়ে কাঠামোর সংস্কারের প্রশ্ন থেকে পিছু হটে যাই। যদি তা না হতো, তাহলে আমরা কাঠামোগত অবিচারের এই ঘটনাগুলোর বিরুদ্ধে শক্তিশালী আন্দোলন দেখতে পেতাম। কারণ, রাষ্ট্র, রাজনীতি ও অর্থনীতির কারণগুলো তো কারও কাছেই গোপন কিছু না। তবু সেসব নিয়ে গণ-আন্দোলন গড়ে ওঠার কোনো লক্ষণ দেখতে পাওয়া যায় না।

আমরা কখন এসব বিশাল আন্দোলন দেখি? যখন বিষয়গুলো সরাসরি অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত স্বার্থে আঘাত করে। সাহেবগঞ্জ-বাগদা ফার্ম ভূমি সংগ্রাম কমিটি এবং অন্যান্য সংগঠনের নেতৃত্বে সর্বশেষ সফল কৃষক আন্দোলনটি হয়, তা সরকারি অধিগ্রহণ থেকে তাদের জমি রক্ষা এবং সাঁওতালদের প্রাণপ্রিয় প্রকৃতির সুরক্ষা নিশ্চিত করার স্বার্থকে ঘিরে সংগঠিত। শ্রমিক সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে শ্রমিকদের অন্যান্য আন্দোলন বেশির ভাগ মজুরি এবং নিরাপদ কাজের পরিবেশ, অর্থাৎ সরাসরি অর্থনৈতিক দাবির ওপর গড়ে উঠেছে। এখন যেমন চলছে খুলনার পাটকলশ্রমিকদের আন্দোলন-অনশন কর্মসূচি।

যুব আন্দোলনের ক্ষেত্রে আমরা ২০১৪-এর পরের আমলে তিনটি বৃহত্তর আন্দোলন দেখেছি: বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নো ভ্যাট আন্দোলন, কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং নিরাপদ সড়ক আন্দোলন। ভ্যাটের বিরুদ্ধে এবং কোটা সংস্কারের পক্ষে আন্দোলনের দাবিগুলো সরাসরি অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের সঙ্গে সম্পর্কিত। ভ্যাটের বিরুদ্ধে আন্দোলন শিক্ষাকে সাশ্রয়ী রাখতে এবং কোটা সংস্কার আন্দোলন জনসাধারণের চাকরিতে অর্থাৎ কর্মসংস্থানের আরও বৃহত্তর প্রবেশের দাবির ওপর গড়ে উঠেছিল।

অন্যদিকে সড়ক নিরাপত্তা আন্দোলন ন্যায়বিচারের মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপন করেছিল এবং তাদের দাবি কেবল উৎসের দুর্ঘটনার শিকারদের জন্য ন্যায়বিচারে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং সামগ্রিকভাবে ন্যায়বিচারের দিকে আঙুল তুলেছিল। অবিশ্বাস্য প্ল্যাকার্ডগুলোতে লেখা ছিল, ‘রাষ্ট্র মেরামতের কাজ চলছে’। তবে এই ন্যায়বিচার আন্দোলন চালিয়ে নেওয়া যায়নি, আন্দোলনের পর রাজপথে বেশ কয়েকটি মৃত্যু ঘটে যাওয়ার পরও।

এটি প্রমাণ করে যে ন্যায়বিচারের জন্য অবশ্যই আমাদের সংগ্রামকে অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত বিচারের দিকে নির্দিষ্টভাবে মনোযোগ দিতে হবে। প্রকৃতপক্ষে সাধারণ মানুষের মধ্যে অসন্তুষ্টির সবচেয়ে স্পষ্ট বোধ হলো অন্যায্য বাজার ও পরিবেশদূষণ।

পরিবার, সন্তান, ব্যক্তিই এখন আগ্রহের বিষয়। এখন সময় বাজার আর জীবনকে নিয়ে নতুন করে ভাবার।

অনুপম দেবাশীষ রায়: মুক্তিফোরামের একজন সম্পাদক।
[email protected]