স্যার আবেদের প্রয়াণ

একজন ব্যক্তিমানুষ যে নিজের কর্ম ও সাধনাবলে মানবকল্যাণ, দেশ পুনর্গঠন ও সমাজ পরিবর্তনে কী অসামান্য অবদান রাখতে পারেন, তার অনন্য উদাহরণ হয়ে থাকবেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ—বিশ্বের বৃহত্তম বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে বেদনাহত, শোকাভিভূত।

 ফজলে হাসান আবেদ ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা, এটাই তাঁর একমাত্র পরিচয় নয়। তিনি ক্রমেই তাঁর কর্মক্ষেত্র বাড়িয়েছেন। একের পর এক সফল ও সার্থক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। তাঁর কর্মজীবন বর্ণাঢ্য। ষাটের দশকে তিনি যখন যুক্তরাজ্যে চার্টার্ড অ্যাকাউন্টিংয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরেছেন, তখন বাংলাদেশ পাকিস্তানি নিগড় থেকে বেরিয়ে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে উচ্চ পদে আসীন। দেশমাতৃকার মুক্তির আহ্বানে তিনি নিজেকে দেশের মুক্তিসংগ্রামে যুক্ত করেন। স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের কাজ এগিয়ে নিতে আবেদ প্রতিষ্ঠা করেন ব্র্যাক; যেই প্রতিষ্ঠানটি এখন দেশের সীমা ছাড়িয়ে ১১টি দেশে ১২০ কোটি মানুষকে সেবা দিয়ে যাচ্ছে।

ফজলে হাসান আবেদ বিশ্বাস করতেন, মানুষ অমিত শক্তির অধিকারী। সামান্য সুযোগ পেলে সে নিজেই নিজের ভাগ্য বদলাতে পারে। অন্যান্য বেসরকারি সংস্থার মতো তাঁর প্রতিষ্ঠিত ব্র্যাক মানুষকে শুধু ঋণ দিয়ে সহায়তা করেনি, হতদরিদ্র মানুষের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তুলতে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছে, তাদের কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিয়েছে। বিভিন্ন জাতিসত্তার ভাষাশিক্ষা চালুর ক্ষেত্রেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করে ব্র্যাক।

সমাজকর্মের জন্য আবেদ যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে মর্যাদাকর ‘স্যার’ উপাধি, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সরকারি স্বীকৃতি ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ ছাড়াও বিশ্বের বহু সম্মানিত পুরস্কার পেয়েছেন। সর্বশেষ শিক্ষাক্ষেত্রে অনবদ্য অবদানের জন্য তাঁর ‘ইয়াইদান পুরস্কার’ ও সোনার মেডেলপ্রাপ্তি বাংলাদেশকেই গৌরবান্বিত করেছে। এই পুরস্কারের ৩৩ কোটি টাকা তিনি শিশুদের প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষার কাজে লাগানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন। আবেদ নিজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে পূর্বাপর সরকারগুলোর প্রায় সব জনহিতৈষী কাজের সঙ্গে ব্র্যাককে যুক্ত করেছিলেন।

ফজলে হাসান আবেদ কেবল বাংলাদেশের উন্নয়নের সহযাত্রী ছিলেন না, ছিলেন ব্যতিক্রমী পথিকৃৎ। বাংলাদেশে দরিদ্র নারী-পুরুষের জন্য ক্ষুদ্রঋণ অনেক প্রতিষ্ঠানই দিয়ে থাকে; কিন্তু তাঁর প্রতিষ্ঠিত ব্র্যাক সেই ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার ওপর সব সময় গুরুত্ব দিত। আমাদের দেশে অনেক সময়ই ব্যক্তির মহিমা প্রতিষ্ঠানকে ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু স্যার আবেদ নিজেকে আড়ালে রেখে তাঁর প্রতিষ্ঠান ও কর্মী সাধারণকেই সামনে এগিয়ে নিতেন। আত্মমহিমা প্রচারের যুগে তাঁর এই সংযম প্রশংসার দাবিদার।

মৃত্যু সন্নিকট জেনে যে দূরদর্শিতায় ব্র্যাকের নেতৃত্ব স্যার আবেদ পরবর্তী প্রজন্মের হাতে তুলে দিয়ে গেছেন, বাংলাদেশে তা এক ব্যতিক্রমী নজির স্থাপন করেছে। কিন্তু তারও আগে অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন নেতার মতো ব্র্যাকের ব্যবস্থাপনাকে তিনি একটি প্রাতিষ্ঠানিক ও নিয়মতান্ত্রিক কাঠামোয় বিন্যস্ত করেছেন।

ফজলে হাসান শুধু তাঁর প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে নয়; বাংলাদেশ ও বিশ্বের সুবিধাবঞ্চিত কোটি কোটি মানুষের মধ্যে বেঁচে থাকবেন, তাদের প্রেরণা জোগাবেন। গত ৪৮ বছরে বাংলাদেশের সব অর্জন ও সাফল্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে তিনি যুক্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন উন্নয়নের এক অসাধারণ রূপকার।

নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠায় এবং মানুষের ক্ষমতায়নে ফজলে হাসান আবেদ যে অসামান্য ভূমিকা রেখেছেন, তার তুলনা বিরল। তাঁর কর্ম
আমাদের অনুপ্রাণিত ও সমাজ পরিবর্তনকে সামনে এগিয়ে নিতে সাহায্য করবে। আর তাঁর নির্মোহ ও পরার্থপরতার জীবনদর্শন নতুন প্রজন্মের জন্য অনুকরণীয় হয়ে থাকবে।