রাষ্ট্রপতির বক্তব্য গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে

প্রথম আলোসহ দেশের সব সংবাদমাধ্যমে রাষ্ট্রপতি প্রদত্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫২তম সমাবর্তন ভাষণের মৌলিক বিষয়াদি বেশ গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। এবারের সমাবর্তনে তিনি কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অবতারণা করেছেন। তাঁর মতে, কিছু উপাচার্য (ভিসি) ও শিক্ষক নিজের কাজ 

ভুলে গেছেন। প্রশাসনিক পদ-পদবিতে অনেক শিক্ষকই নিজের মূল পরিচয় ভুলে যান। তাঁর মতে, অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় দিনে সরকারি ও রাতে বেসরকারি রূপ ধারণ করে। রাষ্ট্রপতি বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন ডিপার্টমেন্ট, ইভনিং কোর্স, ডিপ্লোমা কোর্স ও ইনস্টিটিউটের ছড়াছড়ি।

নিয়মিত কোর্স ছাড়াও এখন বাণিজ্যিক কোর্সের মাধ্যমে প্রতিবছর হাজার হাজার গ্র্যাজুয়েট বের হচ্ছেন। এসব ডিগ্রি অর্জন করে শিক্ষার্থীরা কতটা লাভবান হচ্ছেন, এ নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও একশ্রেণির শিক্ষক লাভবান হচ্ছেন বলে রাষ্ট্রপতি সমাবর্তন ভাষণে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, সেই শিক্ষকেরা নিয়মিত নগদ সুবিধা পাচ্ছেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়কে পরিণত করেছেন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাসহ সার্বিক পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে।

রাষ্ট্রপতির মতে, কোনো কোনো শিক্ষক নিয়মিত কোর্সের ব্যাপারে উদাসীন থাকলেও এ ধরনের বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপনার বিষয়ে ‘খুবই সিরিয়াস’। বিশ্ববিদ্যালয় জনগণের টাকায় পরিচালিত হয় বিধায় এর জবাবদিহিও জনগণের কাছে। তাঁর মতে, পদোন্নতির জন্য মৌলিক গবেষণাকে বিবেচনায় নিতে হবে। সম্প্রতি দেশের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া অমানবিক ও অনভিপ্রেত ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেন রাষ্ট্রপতি। তিনি বলেন, এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ও শিক্ষার্থীদের সুনাম ক্ষুণ্ন হয়েছে। কর্তৃপক্ষ সময়মতো সঠিক পদক্ষেপ নিলে অপ্রত্যাশিত ঘটনা রোধ করা সম্ভব হতো। এর দায় কর্তৃপক্ষের বলেও তিনি উল্লেখ করেছেন। তিনি আরও কর্মতৎপর ও মনোযোগী হতে আহ্বান জানান শিক্ষকদের।

রাষ্ট্রপতির বক্তব্যের প্রতিটি শব্দের সঙ্গে এ দেশের সচেতন জনগণ পরিচিত। এগুলো নিয়ে বিভিন্ন সময় নাগরিক সমাজসহ নানা ফোরাম ও সংবাদমাধ্যমে আলোচিত হয়েছে। এমনকি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন অনেক শিক্ষকও বিভিন্ন সময়ে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা তুলেছেন। ইভনিং কোর্সের নামে নিম্নমানের গ্র্যাজুয়েট তৈরি হচ্ছে বলে বছর তিনেক আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সভায় এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিলেন তখনকার কোষাধ্যক্ষ। অতিসম্প্রতি বুয়েটে ঘটে যাওয়া আবরার হত্যাকাণ্ড নিয়েও প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। সরকার দ্রুত যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নিয়েছে, কিন্তু সেখানকার দায়িত্বশীলদের কী ভূমিকা ছিল, তা আমরা লক্ষ করেছি। এ পটভূমিকায় রাষ্ট্রপ্রধানের বক্তব্য আর তা-ও দেশের সর্বপ্রাচীন এবং সবার শীর্ষে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ভিন্নতর একটি নতুন মাত্রা দিয়েছে সমস্যাগুলোর।

রাষ্ট্রপতির কোনো নির্বাহী ক্ষমতা না থাকতে পারে, তবে তিনি রাষ্ট্রের অভিভাবক এবং তাঁর বক্তব্যের একটি প্রচণ্ড নৈতিক জোর রয়েছে। হতে পারে বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। নিজস্ব আইনের মাধ্যমে এগুলো চলে। এখানে সরকারের হস্তক্ষেপের ক্ষমতাও সীমিত। তবে যেহেতু জনগণের করের টাকায় এগুলো চলে, সে ক্ষেত্রে সরকার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের মধ্যে থেকেই সক্রিয় হস্তক্ষেপ করার সুযোগ রয়েছে। রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। তাদের অনুমোদন ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন কোনো বিভাগ বা ইনস্টিটিউট খুলতে পারে না। পারে না বাড়াতে মঞ্জুরীকৃত পদের অতিরিক্ত পদ। এগুলো তেমন কিছু মানা হচ্ছে না, এমনটিই জানা যায়। সে ক্ষেত্রে মঞ্জুরি কমিশনের সদিচ্ছা ও সক্ষমতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। অথচ কোনোটিই থাকার কথা নয়।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সিন্ডিকেট আছে। অনেকটির আছে সিনেট। সিন্ডিকেট শক্ত অবস্থান নিলে কোনো ফ্যাকাল্টি ইভনিং কোর্স চালানোর সুযোগ পেতে পারে না। শিক্ষকেরাই তো বলেছেন, এগুলো নিম্নমানের গ্র্যাজুয়েট তৈরি করছে। নিয়মিত কোর্সে যাঁরা পড়ছেন, তাঁদের মধ্যে বেশ কিছু ভালো ছাত্র আছেন। তবে অধিকাংশেরই মান ক্রম নিম্নমুখী, এমন অভিযোগ লাগাতার আসছে। সে সমস্যার গভীরে নিয়ে উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়ন করা এখন সময়ের দাবি। সে দাবির বিষয়ে তেমন কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে আরও নিচের দিকে চলে যাওয়ার মতো ইভনিং কোর্স চালু করা হয়েছে। সেখানে মোটা অঙ্কের ফি দিয়ে পড়তে হয়। এ টাকার হিসাব-নিকাশেও তেমন কোনো স্বচ্ছতা নেই বলে জানা যায়।

ইভনিং কোর্সে মেধাবী শিক্ষার্থীদের কেউ নেই, বিষয়টি তা নয়। কিন্তু দিনের শেষে শিক্ষকেরা সন্ধ্যায় তাঁদের কী দিতে পারেন, এটা বোধগম্য নয়। যা-ই হোক, ব্যাপক জনশ্রুতি, সেগুলোতে তেমন একটা পড়াশোনা হয় না। অথচ পরীক্ষাতে মোটামুটি ‘ভালোই’ করছেন সব। তাঁরাও নিয়মিত কোর্সের শিক্ষার্থীদের মতো একই বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদধারী হয়ে যান। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কোনোটিই যে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে হাজারের ঘরে থাকছে না, এর পেছনে এ ব্যবস্থারও অবদান থাকা স্বাভাবিক। শিক্ষা সম্প্রসারণের কোনো উদ্যোগ ভালো, তবে তা করতে গিয়ে গোটা শিক্ষাব্যবস্থার মান ক্রম নিম্নমুখী করে ফেলা হচ্ছে, এটা সবাই স্বীকার করবেন। অবশ্য এটা বলা সংগত যে শুধু স্নাতক, স্নাতকোত্তর পর্যায়ে নয়; প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকসহ সব স্তরেই শিক্ষার মান নেমে যাচ্ছে।

ফলে আমাদের ক্রমবর্ধিষ্ণু অর্থনীতিতে যুক্ত হওয়া নতুন কলকারখানা, ব্যবসা এমনকি সেবা সংস্থাগুলোর পরিচালনার যোগ্য লোক না পাওয়ার অভিযোগ আসছে। চাকরিদাতারা অনেক ক্ষেত্রেই বিদেশ থেকে কর্মী এনে চালাচ্ছেন এগুলো। ফলে সরকারিভাবেই বছরে চলে যাচ্ছে তিন বিলিয়ন ডলার। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ সম্পর্কে রাষ্ট্রপতি যা বলেছেন, তা-ও কারও অজানা নয়। দলীয় রাজনীতি কিংবা সরকারি দলের ছাত্রসংগঠনের কিছুটা প্রভাব থাকতে পারে ভর্তি কিংবা হলের সিট বণ্টনে। কিন্তু এটা কীভাবে নিরঙ্কুশ হয়, তা বোধগম্য নয়। অথচ সেটাই হয়েছে। আর এটা সম্ভব হয়েছে ছাত্রসংগঠনকে হাতে রেখে কতিপয় শিক্ষকের উচ্চতর পদ-পদবি লাভ ও রক্ষার অভিপ্রায়ের কারণে। তারপরও প্রশ্ন থাকে, কীভাবে কিছু ছাত্র সবার জ্ঞাতসারে হলে টর্চার সেল চালু করেন এবং কার্যকর রাখেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছেন উচ্চ মেধার জোরে, এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ কারও নেই। তবে এ ধরনের অনাচারের বিরোধিতা করার কি কোনো প্রয়োজন নেই? অনেকেই করতে চান, কিন্তু পারছেন না সাহসের অভাবে। সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক হয়েও যদি শুধু নিজের নিরাপত্তার কথা ভাবেন, তখন আমরা যাব কোথায়!

রাষ্ট্রপতি দেশের সর্বোচ্চ পদাধিকারী ব্যক্তি। রাষ্ট্রের মানক্রমেও তিনি শীর্ষে। তাঁর কথাগুলো অনুশাসন হিসেবে নিতে হবে। তিনি একটি কথাও ভুল বলেননি। কোথাও ছাড়াননি সীমা। দিনের পর দিন বিভিন্ন মহলে যে কথাগুলো আলোচিত হতো, তা-ই তুলে ধরেছেন। আমরা আনন্দিত, রাষ্ট্রপতির এ বক্তব্যের পরদিনই বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ইভনিং কোর্স বাতিল করে আদেশ জারি করেছে। অবশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বলেছেন, এখন যাঁরা পড়ছেন, তাঁরা এ আদেশের আওতায় আসবেন না। নতুনভাবে আর কোনো ভর্তি হবে না। বিষয়টি বাস্তবসম্মত। এতে আমরা আশাবাদী। তবে যাঁরা এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত, তাঁরা অত্যন্ত প্রভাবশালী।

মঞ্জুরি কমিশন যথাযথ তৎপর না থাকলে কোথাও থমকে পড়বে। রাষ্ট্রপতির অন্য বক্তব্যগুলো আমলে নিয়ে সমস্যাগুলো দ্রুত দূরীকরণের জন্য সচেষ্ট হতে হবে। ক্ষমতাসীন দল তার সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে পরিবর্তন এনেছে। পরিবর্তন এসেছে ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্বেও। তবে তাদের কার্যক্রমে কোনো ইতিবাচক ব্যতিক্রম নজরে আসছে না। এ ক্ষেত্রে শিক্ষকদের, বিশেষ করে উপাচার্য, প্রভোস্ট ও রেক্টরদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলার কর্তৃত্ব নিতে হবে নিজেদের হাতে। রাষ্ট্রপতির বক্তব্যও যদি সংশ্লিষ্ট মহল কথার কথা বলে মনে করে, তবে দেশটির সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠানের নৈতিক ভিত্তির ওপর একটি বড় আঘাত হানা হবে।

আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
[email protected]