সিএএ ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়

নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের বিরুদ্ধে ভারতজুড়ে বিক্ষোভ চলছে। ছবি: রয়টার্স
নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের বিরুদ্ধে ভারতজুড়ে বিক্ষোভ চলছে। ছবি: রয়টার্স

ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) নিয়ে প্রতিক্রিয়া হচ্ছে ভারতের বাইরেও। এই আইনের প্রতিবাদে ভারতের দুটি প্রাচীন মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদমুখর ছাত্রদের ওপর পুলিশ হামলা করেছিল। হামলার প্রতিবাদ করেছেন বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ভারতীয় ছাত্র ও অ্যালামনাইরা।

জাতিসংঘ মানবাধিকার অফিস মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর বৈষম্যমূলক হিসেবে আইনটির নিন্দা করেছে। কয়েকটি দেশ তাদের নাগরিকদের ভারতের কিছু রাজ্যে যাওয়ার বিষয়ে সতর্ক করেছে। সবচেয়ে অভাবিত প্রতিবাদ এসেছে পাকিস্তানের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের কাছ থেকে। সিএএতে পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশে ‘নিপীড়িত’ হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধসহ মুসলমান ছাড়া অন্য যেকোনো ধর্মের মানুষকে নাগরিকত্ব দেওয়ার বিধান আছে। তারপরও পাকিস্তানের সংখ্যালঘুদের সংগঠনগুলো এই আইনের সমালোচনা করেছে, সেখানে নাগরিকত্ব পাওয়ার প্রস্তাব দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে।

আইনটি পাস হওয়ার সময় যে তিনটি দেশের কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে আফগানিস্তানের সঙ্গে ভারতের বর্তমানে কোনো সীমান্ত নেই। অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে বৈরী রাষ্ট্র পাকিস্তানের সীমান্তে সার্বক্ষণিক উত্তেজনা বিরাজমান। এ পরিস্থিতিতে সিএএ আইনের কারণে নাগরিকত্ব ও নিরাপত্তা হারানো ভারতীয় মুসলমানদের সবচেয়ে বেশি অনুপ্রবেশ ঘটার আশঙ্কা বাংলাদেশের সীমান্ত দিয়ে। বিবিসির একটি রিপোর্টে ইতিমধ্যে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের কিছু ঘটনা তুলেও ধরা হয়েছে। কিন্তু এরপরও এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো অবস্থান গ্রহণ করেনি।

বাংলাদেশ সরকারের এ অবস্থান নানা কারণে উদ্বেগজনক। সরকার প্রথম থেকেই বিষয়টি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে বর্ণনা করেছে এবং বাংলাদেশের চিন্তার কারণ নেই বলে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের কথা উল্লেখ করেছে। এড়িয়ে গেছে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, সঙ্গে আরও কয়েকজন বিজেপি নেতার অনুপ্রবেশকারীদের বাংলাদেশের বলে দাবি করার বিষয়টি। আইনটি পাস করার সময় লোকসভার আলোচনায় ধর্মীয় সংখ্যালঘু নিপীড়নে বাংলাদেশকে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সঙ্গে এক কাতারে ফেলার পর আমরা দেখেছি যে বাংলাদেশের দুজন মন্ত্রীর ভারত সফর স্থগিত হয়েছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এটিও জানানো হয় যে এই স্থগিতের সঙ্গে সিএএর কোনো সম্পর্ক নেই; বরং পররাষ্ট্রমন্ত্রী এমন বক্তব্য প্রদান করেন যে ভারতে অনুপ্রবেশকারীরা বাংলাদেশের হলে তাদের ফেরত নেওয়া হবে।

এসব দেখে মনে হতে পারে যে সরকার বুঝে উঠতে পারছে না তাদের ঠিক কী প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিত। তাদের পক্ষ থেকে অতীতে বিএনপির শাসনামলে, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ করা হয়েছে। কিন্তু সিএএতে এই নিপীড়নের অভিযোগ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু সরকারের পর ঢালাওভাবে বাংলাদেশে সব সরকারের আমলে। বর্তমান সরকারের আমলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের স্বার্থে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে, প্রধান বিচারপতিসহ সরকারের শীর্ষ পদে তাদের বহু নিয়োগ ঘটেছে, বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো হিন্দু জনগোষ্ঠীর পরিমাণও ২ শতাংশের মতো বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু সিএএ বা এ নিয়ে লোকসভার আলোচনায় এর কোনো প্রতিফলন ঘটেনি।

বিজেপির বর্তমান যে রাজনীতি এবং সিএএর যা লক্ষ্য, তাতে বাংলাদেশে অতীতে নিপীড়ন হয়েছে, বর্তমানে হচ্ছে না, এটা বলা হবে—এমন আশা করারও সুযোগ নেই। সেখানে অভিযুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ, এর সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া হবে বাংলাদেশের ওপর। সরকারকে তাই অবস্থান নিতে হবে দেশের পরিপ্রেক্ষিত থেকে, দেশের স্বার্থে।

২.

সংখ্যালঘু নিপীড়ন সভ্যতার আদি যুগের সমস্যা। প্রথম মহাযুদ্ধের অবসানের পর জাতিপুঞ্জের উদ্যোগে নতুন জন্ম নেওয়া রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে যে মানবাধিকার চুক্তিগুলো স্বাক্ষরিত হয়, তা ছিল সংখ্যালঘুদের রক্ষা করার জন্য। জাতিগোষ্ঠী ও ধর্মভিত্তিক বৈষম্য দূর করার জন্য এরপর বহু আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক চুক্তি হয়েছে, বাংলাদেশ, ভারতসহ পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে এ ধরনের বৈষম্যকে সংবিধান ও আইনে
নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তারপরও পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতেও এ ধরনের সমস্যা রয়ে গেছে। উগ্র জাতীয়তাবাদ, ধর্ম ও বংশগত পরিচয়ভিত্তিক রাজনীতি ও সন্ত্রাসী হামলা বৃদ্ধির কারণে সাম্প্রতিক সময়ে পৃথিবীর বহু অঞ্চলে এ সমস্যা আরও মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।

আমাদের দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশে এ সমস্যা আগের চেয়ে প্রকট হয়েছে। এটি কী ভয়ংকর পর্যায়ে যেতে পারে, তা আমরা পাকিস্তানে আসিয়া বিবি মামলায় দেখেছি। ভারতে ক্ষমতাসীন দলের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রভাব কী প্রকটভাবে পড়েছে, তা গো–মাংস ভক্ষণ নিয়ে নির্বিচার তাণ্ডবকাণ্ডে আমরা লক্ষ করেছি। বাংলাদেশে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করার পরও সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাহানির কিছু ঘটনা ঘটেছে।

সংখ্যালঘু নিপীড়ন কমবেশি সব জায়গায় রয়েছে। কিন্তু একটি দেশ এ কারণে একতরফাভাবে কোনো প্রমাণ ছাড়া অন্য দেশের বিরুদ্ধে ঢালাও অভিযোগ করলে সে দেশটি নিশ্চুপ থাকে না। সিএএতে পাকিস্তান আর আফগানিস্তানের মতো দেশের কাতারে বাংলাদেশকে ফেলার পর সরকারের তাই নিশ্চুপ থাকার কারণ নেই।

সিএএর বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান নেওয়ার আরও অনেক বড় যৌক্তিকতা হচ্ছে এর সম্ভাব্য প্রভাব। এই আইনের কারণে ভারত থেকে লাখ লাখ মুসলমানের বাংলাদেশে চলে আসার মতো চাপ বা পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে, এর আলামত এখনই দেখা যাচ্ছে। এটি সত্যি সত্যি ঘটলে তা সামাল দেওয়ার সামর্থ্য আমাদের আছে কি? গণহত্যার মুখে রোহিঙ্গারা প্রাণভয়ে একসঙ্গে এ দেশে চলে এসেছে বলে তাদের জন্য আমরা কিছু বিদেশি সাহায্য পাচ্ছি। ভারত থেকে মুসলমানরা ভীতি ও অনিশ্চয়তার কারণে এ দেশে আসতে থাকলে তেমনটি ঘটবে না।

ভারতের এই আইনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে মানবিক কারণেও। এই আইন প্রতিবেশী তিনটি রাষ্ট্রে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তার জন্য আরও ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। এমনকি তারা স্বেচ্ছায় ভারতে চলে গেলেও তা সেখানকার জনগোষ্ঠীর জীবনে বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। আসামসহ ভারতের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া দেখে তার আভাস আমরা পাই।

বছর চারেক আগে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ইউরোপের বিভিন্ন দেশে থাকা ইহুদিদের আহ্বান জানিয়েছিলেন ইসরায়েলে চলে আসার জন্য। ইউরোপ আর আমেরিকায় ধর্মীয় উগ্রতা এবং পরিচয়ভিত্তিক রাজনীতির জোয়ারে আক্রান্ত হচ্ছিল ইহুদিরাও। ডেনমার্ক, ফ্রান্স, জার্মানিসহ কয়েকটি দেশে এমন হামলার পর তিনি এ আহ্বান জানিয়েছিলেন। তাঁর এ আহ্বানের পর ইউরোপ-আমেরিকায় ইহুদির জীবনে অনিশ্চয়তা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারতের এ আইনও, বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশগুলোতে সম্প্রদায়গত সম্পর্কের অবনতি ঘটার আশঙ্কা রয়েছে।

বিজেপি এই আইনকে নিপীড়িত মানুষের রক্ষাকবচ হিসেবে দাবি করেছে। সমালোচকেরা বলছেন, তাহলে ভারত পাকিস্তানের আহমদিয়া বা মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা কেন বলছে না? তাঁদের বক্তব্য, ভারতের এ আইন ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় আবেগ
ব্যবহার করে ক্ষমতায় থাকার অভিপ্রায় থেকে নেওয়া। আশঙ্কা করা হচ্ছে যে এই আইন প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোতেও এ ধরনের রাজনীতিকে বেগবান করতে পারে।

৩.

ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি আমাদের বিশ্লেষণের বিষয় হতে পারে, কিন্তু প্রতিক্রিয়ার বিষয় নয়। তবে এই আইনের প্রভাব অবশ্যই আমাদের প্রতিক্রিয়া দাবি করে। এই আইন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করেছে, বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাঝুঁকি ও দেশে ভারতীয়দের অনুপ্রবেশের আশঙ্কা সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের সমাজ ও অর্থনীতির ওপর এর মারাত্মক প্রতিক্রিয়া পড়তে পারে।

দেশের স্বার্থে অবশ্যই সরকারকে এর বিরুদ্ধে স্পষ্ট ও জোরালো ভূমিকা নিতে হবে। সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার ও সুরক্ষিত করতে হবে। সেই
সঙ্গে দেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও বৈষম্যহীনতাকে আরও সুরক্ষিত করতে হবে নিজস্ব সাংবিধানিক দায় থেকে।

এনআরসি আর সিএএ ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়, এটি দিবালোকের মতো স্পষ্ট হওয়ার পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তিগুলোকেও এ বিষয়ে স্পষ্ট অবস্থান নেওয়া উচিত।

আসিফ নজরুল: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক