শীত যেখানে রোমান্টিক নয়, নিষ্ঠুর

খড়কুটা জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা। গতকাল কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলার পাথরডুবি এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো
খড়কুটা জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা। গতকাল কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলার পাথরডুবি এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো

কুড়িগ্রাম-লালমনিরহাট-রংপুরে শীত জেঁকে বসেছে। চলছে শৈত্যপ্রবাহ। তারই মধ্যে নৌকা চলছে। অটো-ভটভটি চলছে। চলছে জীবন। পেঁয়াজসহ নিত্যপণ্যের দামও চড়া। জেলেপাড়ার লোকজন মাছ ধরছেন ব্রহ্মপুত্রে। বউরা শীতবস্ত্র ভিক্ষা করতে ছুটছেন অবস্থাপন্নদের বাড়ি বাড়ি—যদি একটু বস্ত্র মেলে। রাস্তায় নেতাগোছের কাউকে দেখলেই পুরুষেরা আবেদন রাখছেন শীতবস্ত্রের। যে তরুণেরা বানে ও শীতে জনগণের পাশে একটু দাঁড়ায়, তাদের বাড়িতে সকাল হলেই চেঁচামেচি—‘এলাও কাপড়-টাপড় আনেন নাই বাহে? জ্বারোতে মরি গেইনো যে। তোমার বন্ধুবান্ধবক এহনা কন।’

হাট ভাঙছে সকাল সকাল। গ্রামে বিকেল হলেই আগুনের পাশে জড়ো হচ্ছেন গৃহস্থরা। ঠান্ডা থেকে রেহাই চাই। গোয়ালে গোবরের ঘুটে দিয়ে পোঁড় দিচ্ছেন অবলা জীবের জন্য। দেখা দিচ্ছে ঠান্ডাজনিত বালাই।

‘একাশি সালে একবার কুড়িগ্রামের চিলমারীতে গিয়েছি।...ঘরের দরজা থেকে সরে যায় একটি মুখ ঝট করে। পরে শুনি পিতার একটিমাত্র যে লুঙ্গিটি, তারই একটি খণ্ড তার পরনে। শুধু কোমরে প্যাঁচানো যায়, কিশোরীর বুক উদম। শহর থেকে “লোক” আসায় অর্ধ–উলঙ্গ অবস্থায় সে বেরোতে পারছিল না ঘরের বাইরে। শুনি, লুঙ্গির বাকি যে অংশটুকু, তা দুই টুকরো করে লেংটি বানিয়ে নিয়েছে বড় ছেলে দুটি। অপর দুজন লেংটাই থাকে। ছোট ওরা।’ চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিনের দেখা এই দৃশ্য গার্মেন্টস শিল্পের বিকাশের কারণে অনেকটাই উধাও। কিন্তু শীতের রাতে খড়ের তোষক বানিয়ে ঠান্ডা নিবারণের চেষ্টা এখনো আছে। আছে ভোর হতেই আগুন জ্বালিয়ে তাপগ্রহণ। স্থানীয় ভাষায় যার নাম পোঁড় দেওয়া। বান বা শীত এলে দারিদ্র্যের ঢাকনা উন্মুক্ত হয়।

চিলমারী বন্দর। ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনে যার নাম এখন রমনা ঘাট। শিক্ষকদের নৌকা চালান প্রবীণ শমসের নাইয়া। কোদালকাটি থেকে সকাল সাড়ে সাতটায় রমনা ঘাটে আসেন। তিনি জানান, ‘ঠান্ডায় বাঁচি না বাহে। কাইমের বাতাসে সহ্য না হয় কারও, তার ওপর ফির ব্রহ্মপুত্রের বাতাস। পেটের দায়ে আসা লাগে বাপ!’ উল্লেখ্য যে, গরমের দিনেই ব্রহ্মপুত্রের বাতাস শরীরকে ঠান্ডা করে। শীতের দিনে তার কাঁপুনি কেমন, তা সহজেই অনুমেয়।

আলেয়া বেগম। বয়স ৭০–এর কাছাকাছি। মুক্তিযুদ্ধে স্বামী শহীদ হয়েছেন। থাকেন পুঁটিমারীর বাঁধের রাস্তায়। ভূমিহীন। নিঃসঙ্গ। এদিকে বাঁধ থেকে উচ্ছেদের নোটিশ দিয়েছে। শহীদ পরিবার যে কিছু রাষ্ট্রীয় সুবিধা পায়, তা–ও বেখবর। তিনি বলেন, ‘জ্বারোত মরি গেনু বাবা। এহনা কম্বলের জইন্যে কত জাগাত গেনু। কাঁই দেইখপে হামাক?’

এনজিওগুলো যদি সাহায্য করে, তা–ও নিজের সদস্যদের। ভোটের নেতারা ভোটের সময় ছাড়া সাক্ষাৎ দেন না। কেউ দুই টাকার রিলিফ দিয়ে ১০ টাকার প্রচার নেয়। সেখানে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো ব্যতিক্রম। এই তরুণেরাই আশা। চিলমারী সমাজকল্যাণ সংগঠন নামের একটি সংগঠন শীতবস্ত্রের আহ্বান জানিয়ে মোড়ে মোড়ে কার্টন বসিয়েছে। কার্টনগুলোতে কেউ এখনো শীতবস্ত্র জমা করেনি। তাঁরা পাড়ায় পাড়ায় বস্ত্র সংগ্রহের জন্য ঘুরছেন। স্থানীয় বিত্তশালীদের কাছে হাত পাতছেন। তাঁদের একজন সদস্য রাঙ্গা মিয়া বলেন, বিত্তশালীরা কেউ এগিয়ে আসছেন না। তাঁরা নিজেরাই নাকি উদ্যোগ নেবেন। মোটামুটি দিন যায় এমন পরিবারগুলোই নিজেদের বস্ত্র দান করছেন। বড়লোকেরা নন।

ষড়্‌ঋতুর দেশে শীত ঋতু একটা স্বাভাবিক ঘটনা। তবু সংবাদে দেখি, উত্তরাঞ্চলে তীব্র শীত। শীত স্বাভাবিক হলে খবর হবে কেন? খবর হয়, কারণ শীতবস্ত্রের অভাবে এখানে মৃত্যু হয়। জীবন থেমে যায়। বাংলাদেশে যখন ৮–৯ ডিগ্রি, তখন ইউরোপ-আমেরিকায় মাইনাস ডিগ্রি চলছে। তবু ওই সব দেশে শীতে মৃত্যুর ঘটনা নেই বললেই চলে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর মুখে আমরা। এখন বস্ত্রের মতো মৌলিক চাহিদা পূরণ করা গেল না। লাখো মানুষের আত্মদান তবে কেন? মুক্তিযুদ্ধের সময় গোটা দেশবাসীর আর্থিক সামর্থ্য তো প্রায় একই ছিল। কীভাবে ওপরের দিকে ১০ ভাগের সঙ্গে তলার দিকের ১০ ভাগের বৈষম্য এত প্রকট হলো? যেদিন বিআইডিএস রিপোর্টে জানায়, কুড়িগ্রামের ৩০ ভাগ পরিবার তিনবেলা ঠিকমতো খেতে পায় না; তারই কদিন পর সরকারি আরেক গবেষণা প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, দারিদ্র্যের হার ২৪ থেকে কমে এখন ২০ ভাগ। অথচ কুড়িগ্রামে তা ৭০ দশমিক ৬৭ ভাগ। এমনকি পুঁটিমারীর বাঁধে আশ্রিত নিঃসঙ্গ শহীদজায়া আলেয়া বেগমদের কাছেই বা কী বলার আছে রাষ্ট্রের? সংবিধানে সমাজতন্ত্র না রেখেও যা ছিল, রেখেও তাই আছে। কিছু কি বদলাল?

চতুর্দিকে ঠান্ডা। দাঁড়ালে খামচে ধরে, হাঁটলে শিরশির বাতাস শক্তি শুষে নেয়। বরফ যেন পুরো শরীরকে অসাড় করে দেয়। হাসপাতালে ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ভাঙা এ তরি। বিছানা থেকে মেঝে পর্যন্ত মায়ে–সন্তানে একাকার। পুঁটলির মতো করে ধরে আছেন জননী। এক অপর থেকে উষ্ণতা নিচ্ছেন। শীত এলে মানুষ মানুষের কাছে আসে। ঘন হয়। মানুষই মানুষের আশ্রয়। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন থেকে শুরু করে পুলিশ সুপার মুহিবুল আলম খান পর্যন্ত শীতবস্ত্রের আবেদন জানাচ্ছেন ফেসবুকে। জনগণের পাশে জনগণ ছাড়া কে আছে!

লেখক: লেখক ও সামাজিক সংগঠক।
[email protected]