মোদির বিরুদ্ধে যে কারণে সরব মাহাথির

মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ছবি: এএফপি
মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ছবি: এএফপি

৭০ বছর ধরে রাজনীতিতে আছেন এবং দুই দফায় ২৩ বছর মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী তিনি। তবে এসবের বাইরে রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে মাহাথির মোহাম্মদের মননশীল এক পরিচিতি আছে বিশ্বজুড়ে। যে পরিচয়ের সুবাদে একালে মালয়েশিয়া ও মাহাথির প্রায় সমার্থক হয়ে আছে।

কিন্তু মাহাথির কেবল মায়ের দিক থেকেই মালয়। পিতার দিক থেকে তিনি ভারতীয় ঐতিহ্যের ধারক। তাঁর দাদা ইসকান্দার দক্ষিণ ভারতের কেরালা থেকে আজকের মালয়েশিয়ায় এসে মালয় নারী বিয়ে করে এখানেই থিতু হয়েছিলেন।

রাজনৈতিক জীবনের দীর্ঘ সময় মাহাথির তাঁর ভারতীয় বংশলতিকা নিয়ে ঝামেলায় পড়েছেন। বিরোধীরা এটা ব্যবহার করে বারবার তাঁকে অপদস্থ করতে চেয়েছেন। তিনি যে ‘খাঁটি মালয়’ নন, বরং অনেকাংশে ‘ভারতীয়’, সেটাই দেখাতে চাইতেন বিরোধীরা।

তবে রাজনীতি ও কূটনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু থাকে না। সর্বশেষ দেখা যাচ্ছে, মাহাথির ভারতের সঙ্গে একের পর এক বিরোধে জড়িয়ে যাচ্ছেন; আর তাঁর ভারত বিরোধিতার নিন্দায় নেমেছে দেশে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা; যাঁরা এত দিন তাঁকে ‘ভারতীয়’ প্রমাণ করতে সচেষ্ট ছিলেন।

ভারতের নাগরিকত্ব আইনের সমালোচনায় মাহাথির
মাহাথির মোহাম্মদের বয়স এখন ৯৪। কিন্তু দেশে-বিদেশে তুমুল সক্রিয় তিনি। রোহিঙ্গা ও ফিলিস্তিনিদের পক্ষে ক্রমাগত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে বলছেন। এসব বিষয়ে ওআইসির অকার্যকারিতার মুখে সর্বশেষ কুয়ালালামপুরে মুসলমানপ্রধান দেশগুলোর সম্মেলন ডেকেছিলেন। ১৯ ডিসেম্বর থেকে তিন দিনব্যাপী এই সম্মেলনে ২০-২৫টি দেশ থেকে রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি বিভিন্ন পেশার নেতৃস্থানীয় মুসলমান বুদ্ধিজীবীরা যোগ দিয়েছেন। মাহাথিরের এই কাজে তুরস্ক ও ইরানের মদদ ছিল। বহু কারণে এই সম্মেলন আন্তর্জাতিক সমাজের মনোযোগ পেয়েছে। বিশেষ করে মুসলমান দেশগুলোর সংস্থা হিসেবে ওআইসিতে সৌদিদের আধিপত্য প্রশ্নের মুখে ফেলেছে তা। সম্মেলনে কোনো কোনো দেশ যুক্তরাষ্ট্রের ডলারের বিকল্প হিসেবে মুসলমান দেশগুলোর জন্য বিকল্প মুদ্রা কিংবা স্বর্ণকে বাণিজ্যিক লেনদেনের একক মাধ্যমে পরিণত করার প্রস্তাব তোলে। এ রকম প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষুব্ধ হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। আবার ভারতে নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে চলমান বিক্ষোভ নিয়ে মাহাথিরের মন্তব্যের কারণেও কুয়ালালামপুর সম্মেলন সংবাদ শিরোনাম হয়ে উঠেছে।

সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন ২০ ডিসেম্বর মাহাথির ভারতের নতুন নাগরিকত্ব আইন নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেন। ‘এটা মুসলমানদের জন্য বঞ্চনামূলক’ বলে তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘৭০ বছর সব ধর্মের মানুষ একসঙ্গে থাকার পর মুসলমানদের প্রতি বঞ্চনাধর্মী নতুন আইনের কেন প্রয়োজন পড়ল সেখানে? এতে অস্থিতিশীলতাই কেবল বাড়বে।’

এর আগে ২৮ সেপ্টেম্বর মাহাথির নয়াদিল্লির কাশ্মীর নীতির সমালোচনা করেন। জাতিসংঘের ৭৪তম অধিবেশনে তিনি কাশ্মীরে ভারতের ভূমিকাকে ‘আগ্রাসন’ হিসেবে মন্তব্য করেন।

তারও আগে পাকিস্তান-ভারত যখন পরস্পর বিমানযুদ্ধে লিপ্ত, ঠিক তখন পাকিস্তানের জাতীয় দিবসে অতিথি হয়ে সে দেশে যান মাহাথির। মাহাথিরের পাকিস্তান আগমন ইমরান সরকারের জন্য বিশেষ উৎসাহব্যঞ্জক হয়েছিল। কারণ, এ সময় পাকিস্তানকে কূটনীতিকভাবে একঘরে করতে চাইছিল নয়াদিল্লি।

তারও আগে ইসলামি তাফসিরকারক ডা. জাকির নায়েককে ফেরত দেওয়ার ভারতীয় প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেও মালয়েশিয়া সরকার নয়াদিল্লির অসন্তুষ্টির কারণ হয়ে আছে। ২০১৬ সালে নিজ দেশে বিজেপি সরকারের আইনি পদক্ষেপের মুখে মালয়েশিয়ায় আশ্রয় নেন জাকির নায়েক। ২০ ডিসেম্বর কুয়ালালামপুরে যে সম্মেলনে মাহাথির ভারতের নাগরিকত্ব আইনের সমালোচনা করেন, সেখানে জাকির নায়েকও উপস্থিত ছিলেন। অথচ ভারত ডা. নায়েককে বিভিন্ন অভিযোগে হাতে পেতে চাইছে।

এভাবে অনেক কারণেই মাহাথিরের বিরুদ্ধে ভারতের ক্ষোভ। এই তালিকা ক্রমে বড় হচ্ছে। সর্বশেষ ২১ ডিসেম্বর মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রদূতকে ডেকে এনে ভারত সরকার নাগরিকত্ব আইন নিয়ে মাহাথিরের মন্তব্যকে ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ’ হিসেবে উল্লেখ করেছে।

মাহাথিরের কারণে ভারত-মালয়েশিয়া বাণিজ্যযুদ্ধের শঙ্কা
ভারতে সরকারি তরফ থেকে মাহাথিরবিরোধী ক্ষোভ বক্তৃতা-বিবৃতিতে সীমিত থাকলেও বিজেপি সমর্থক বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক ভাষ্যকারেরা এ ক্ষেত্রে অনেক ধাপ এগিয়ে। সংবাদমাধ্যম নিউজ এক্স-এর খ্যাতনামা সাংবাদিক রিশভ গুলাটি এমনও সুপারিশ করেছেন, মাহাথিরকে তাড়াতে মালয়েশিয়ার যেসব হিন্দু হাতে অস্ত্র নেবে, তাদের যেন ভারত সহায়তা দেয়। দেশটিতে হিন্দুধর্মাবলম্বীরা সংখ্যায় চতুর্থ বৃহত্তম। জনসংখ্যার প্রায় ৮ ভাগ। উল্লিখিত সাংবাদিকের এ রকম উত্তেজক প্রস্তাবের পাশাপাশি মাহাথিরের বক্তব্য ভারত বনাম মালয়েশিয়া বাণিজ্যযুদ্ধেরও ইঙ্গিত দিচ্ছে।

এই দুই দেশের বছরে বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ১৭ বিলিয়ন ডলারের সমান। ভারতের প্রধান ১৫ বাণিজ্যিক অংশীদারের একটি মালয়েশিয়া। দুই দেশের লেনদেনে মালয়েশিয়ার আয়রোজগারই বেশি। তারা প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে। এর মধ্যে পামতেল বড় পণ্য।

মালয়েশিয়া বছরে প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলারের পামতেল বিক্রি করে ভারতে। শোনা যাচ্ছে, ভারত মালয়েশিয়ার পামতেলে বাড়তি শুল্ক বসাবে। ভারতের নীতিনির্ধারকেরা সরাসরি না বললেও রাজনৈতিক প্রভাবে আমদানিকারকদের অনেকে মাহাথিরকে শায়েস্তা করার জন্য নতুন কোনো ক্রেতা থেকে পামতেল কেনার পথ খুঁজছে। এ ক্ষেত্রে ভারতের জন্য বিকল্প ইন্দোনেশিয়া। মালয়েশিয়া-ইন্দোনেশিয়া মিলেই বিশ্ব পামতেল বাজারের ৯০ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে। আর ভারত হলো মালয়েশিয়ার পামতেলের তৃতীয় বৃহত্তম বাজার। কিন্তু ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া উভয়ে আসিয়ানের সদস্য। আসিয়ানভুক্ত দেশগুলো সচরাচর তাদের কোনো সদস্যের সঙ্গে বিবাদে লিপ্ত জোটের বাইরের দেশকে সহায়তা দেয় না। কাশ্মীর ও নাগরিকত্ব আইন বিষয়ে ভারতের পরিস্থিতিতে ইন্দোনেশিয়ার মুসলমানরাও মাহাথিরের বক্তব্যের নীরব সমর্থক হয়ে আছেন। ফলে জাকার্তার সরকারের মাহাথিরকে ঘায়েল করতে ভারতের সঙ্গে হাত মেলানোর সম্ভাবনা খুব কম। ইন্দোনেশিয়ার পামতেল খাতের বড় বড় কোম্পানি মালয়েশিয়ারই। ইন্দোনেশিয়া থেকে পামতেল কেনা কার্যত মালয়েশিয়াতেই মুনাফার অর্থ আসা। আবার ২০১০ থেকে ভারত-মালয়েশিয়া এমন বাণিজ্যিক চুক্তি রয়েছে, যার কারণে মালয়েশিয়া থেকে আসা পরিশোধিত পামতেলে ভারতের পক্ষে বাড়তি শুল্ক আরোপে সমস্যা আছে। সে ক্ষেত্রে চুক্তিটিই বাতিল করতে হবে, যা আবার ভারতকেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

মাহাথিরকে নিয়ে ভারতের কূটনীতিক সংকট
মালয়েশিয়া ও মাহাথিরের সঙ্গে যুদ্ধ লিপ্ত হওয়ার ক্ষেত্রে নয়াদিল্লির জন্য কূটনীতিক কিছু অসুবিধাও রয়েছে। ভারত ‘লুক ইস্ট পলিসি’র মাধ্যমে ‘আসিয়ান’ জোটের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানোর যে চেষ্টা করছে—মাহাথিরকে চটিয়ে তাতে সফল হওয়া কঠিন। মিয়ানমার ছাড়া আসিয়ানের অপর দেশগুলোতে মাহাথিরের প্রভাব রয়েছে। রোহিঙ্গাদের প্রতি সহমর্মিতার কারণে কেবল মিয়ানমারের সঙ্গে মালয়েশিয়ার সম্পর্ক শীতল।

মাহাথিরের সঙ্গে বিবাদে ভারতকে মালয়েশিয়ায় থাকা ভারতীয় সংস্কৃতির নাগরিকদের ভবিষ্যৎ নিয়েও ভাবতে হচ্ছে। মালয়েশিয়ার তৃতীয় প্রধান (প্রায় ৮ শতাংশ) জনগোষ্ঠী ভারতীয় বংশলতিকার মানুষ। সংখ্যায় মালয় ও চীনা বংশজাতদের পরই সেখানে ভারতীয় বংশজাতরা। এরা অধিকাংশই দক্ষিণ ভারতীয় সংস্কৃতির মানুষ।

নয়াদিল্লির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী মাহাথিরের সম্পর্কের অবনতি মানেই মালয়দের সঙ্গে ভারতীয় বংশজাতদের সম্পর্কে জটিলতা তৈরি হওয়া। স্থায়ীদের পাশাপাশি তামিলনাড়ুর পাঁচ লাখ ভারতীয় অস্থায়ী ভিত্তিতেও মালয়েশিয়ায় রেস্টুরেন্ট ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কাজ করে। পামতেল যুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় মাহাথিরের যেকোনো কঠোর পদক্ষেপ দক্ষিণ ভারতীয় প্রবাসীদের মালয়েশিয়ায় কাজ করা দুরূহ করে তুলতে পারে। মালয়েশিয়ায় যেসব ভারতীয় দীর্ঘদিনের পুরোনো, তাদেরও বড় অংশ দেশটির পামতেল খাতের সঙ্গে অর্থনৈতিকভাবে যুক্ত। ফলে ভারতের জন্য মালয়েশিয়ার সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হওয়া দুই দিক থেকে ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে।

সাত দশকের অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ হিসেবে মাহাথির এসব হিসাব কষেই সম্ভবত বারবার ভারতবিরোধী অবস্থান নিচ্ছেন। মালয়েশিয়ার ভারতীয় সংস্কৃতির মানুষেরা সেখানে প্রধানত যে দলের সঙ্গে যুক্ত, সেই ডিএপি (ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন পার্টি) শাসক জোটে থাকলেও তাদের পক্ষপাত মাহাথিরের প্রতিদ্বন্দ্বী আনোয়ার ইব্রাহিমের দিকে। এরা যদি মাহাথিরের বিরুদ্ধে আরও সরব অবস্থান নেয়, তাঁর পক্ষে মালয়প্রধান দলগুলোকে কাছে পাওয়া সহজ হয়। মাহাথির তাই দেশে-বিদেশের রাজনীতি ও কূটনীতিকে মিলিয়েই কাশ্মীর ও গাজার পক্ষে দাঁড়াচ্ছেন; ইসলামি মহাসম্মেলন করছেন; তুরস্ক ও ইরানের সঙ্গে মৈত্রী বাড়াচ্ছেন।

তবে মাহাথির ও ভারতের চলতি বিবাদে গুরুত্বপূর্ণ ভিন্ন বার্তাও রয়েছে সবার জন্য। ক্রমে এই লক্ষণ স্পষ্ট যে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়ও জাতিবাদী রাজনীতিই কূটনীতি ও বাণিজ্যকে মোটাদাগে প্রভাবিত করতে চলেছে। জাতিবাদী ঘৃণা ও উত্তেজনা দ্রুত এবং প্রায় তাৎক্ষণিকভাবে বহুদিনের বাণিজ্যিক সম্পর্ককে আমূল পাল্টে দিচ্ছে। এই প্রবণতার ক্ষতিকর ফল হিসেবে ‘শক্তিশালী দেশগুলোর’ বাণিজ্যযুদ্ধের ভয়ে ছোট ছোট জনগোষ্ঠীর মানবাধিকারের পক্ষে বিশ্বসমাজকে অদূর ভবিষ্যতে আগের মতো আর উচ্চকিত হতে দেখা যাবে না। চীনের ভয়ে উইঘুরদের বিষয়ে, ভারতের বাজার হারানোর ভয়ে কাশ্মীরিদের প্রসঙ্গে, পাকিস্তানের সঙ্গে মিত্রতা রক্ষার বিনিময়ে বালুচদের গুম হওয়া নিয়ে, মিয়ানমারের শাসকদের ভয়ে রোহিঙ্গাদের গণহত্যায় উদাসীন থাকতে হবে সবাইকে। এভাবে দেশে দেশে শাসকদের জাতিবাদী আদর্শই তাদের মানবাধিকার দলনের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করবে। ফলে মানুষের অধিকার বিষয়ে আন্তর্জাতিক আইন ও প্রথাগত চক্ষুলজ্জার কার্যকারিতাও লোপ পেতে চলেছে ক্রমে।

আলতাফ পারভেজ: গবেষক