উগ্রবাদীরা আঞ্চলিক পরিস্থিতির সুযোগ নিতে পারে

মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনিরুজ্জামান।
মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনিরুজ্জামান।
>

মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনিরুজ্জামান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (বিআইপিএসএস) প্রেসিডেন্ট। প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন রোহিঙ্গা পরিস্থিতি, ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধন আইন, এ অঞ্চলের নিরাপত্তা পরিস্থিতি ও ভূরাজনীতি নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান

প্রথম আলো: আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের মামলা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে ত্বরান্বিত করবে, নাকি বাধা সৃষ্টি করবে?

মুনিরুজ্জামান: এটা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বড় ধরনের সহায়ক হবে, তা আমি মনে করি না। তবে বাধাগ্রস্ত হবে কি না, সেটা দেখার জন্য আমাদের কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। মিয়ানমার হয়তো মনে করতে পারে যে এই মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তারা অপেক্ষা করবে। এমন সিদ্ধান্ত তারা নেবে কি না, সে জন্য আমাদের কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ এ জন্য হয়তো কিছুটা সহায়ক হবে। জাতিসংঘসহ অন্যরা, যারা রাখাইনে যেতে পারছে না, সেই পথ তাদের জন্য হয়তো কিছুটা সুগম হবে। তবে এর ফলে মিয়ানমার আন্তর্জাতিকভাবে একটা বড় ধরনের চাপের মুখে থাকবে, তারা কিছুটা নমনীয় হতেও পারে।

প্রথম আলো: যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের চার জেনারেলের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিল, এ রকম আচরণগত পরিবর্তন অন্য দেশগুলোর মধ্যে দেখেন কি?

মুনিরুজ্জামান: খুব বড় কোনো পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। কানাডা ও নেদারল্যান্ডস—এই দুটি দেশই প্রকাশ্যে গণহত্যার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। তারা অবশ্য আগেও এই অবস্থানে ছিল। সুতরাং তাদের দিক থেকে এটা নতুন কিছু নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আগেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। এখন শুধু তারা আরেকটু কড়াকড়ি আরোপ করল। এটা একটা ইতিবাচক চিহ্ন হিসেবে আমি দেখি। তবে একই সময়ে মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান চীনে ছিলেন। চীন তাঁর সফরকে গুরুত্ব দিয়ে ভূয়সী প্রশংসা করেছে। তবে মিয়ানমারের বড় যারা মিত্র রয়েছে, তাদের মনোভাবে কোনো পরিবর্তন আমি দেখি না। বরং ভারত প্রথমবারের মতো মিয়ানমারকে সাবমেরিন প্রদান করেছে। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর প্রশিক্ষণেও ভারত ওতপ্রোতভাবে জড়িত। রাশিয়ার সহযোগিতাও অব্যাহত রয়েছে।

প্রথম আলো: বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান মিয়ানমার সফর করেছেন। আপনি কি আশাবাদী যে দ্বিপক্ষীয়ভাবেও একটা বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে?

মুনিরুজ্জামান: আমাদের দ্বিপক্ষীয় চুক্তি কিন্তু এখনো বজায় রয়েছে। সেই চুক্তি থেকে কিন্তু বাংলাদেশ-মিয়ানমার কেউ পিছিয়ে যায়নি, কিন্তু বিভিন্ন কারণে তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এর পুরো দায় সংগত কারণে মিয়ানমারকে নিতে হবে। বাংলাদেশের তরফ থেকে যে ধরনের যোগাযোগ মিয়ানমারের সঙ্গে রক্ষা করে চলার কথা, সেটা বাংলাদেশ রক্ষা করে চলছে। আমাদের সেনাবাহিনীর প্রধানের সফরের ফলাফল আমরা এখন পর্যন্ত জানি না। পরে জানা গেলে আমরা বিশ্লেষণ করে দেখতে পারব, এই সফর থেকে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন এসেছে কি না।

প্রথম আলো: ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধন আইনকে কীভাবে দেখছেন? দুই দেশের সম্পর্কে চিড় ধরেছে কি?

মুনিরুজ্জামান: আসামে ২০ লাখ নাগরিকের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ায় আমি বেশি উদ্বিগ্ন। এর বাইরে আমি দেখতে পাচ্ছি, তাদের নাগরিকদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করানোর একটা চেষ্টা হয়েছে। ভারতের নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের প্রভাব শুধু ভারতের ভেতরে পড়বে তা–ই নয়, এটা আঞ্চলিকভাবে পড়বে। তাই একে কোনোভাবেই আমাদের হালকাভাবে দেখা উচিত নয়।

প্রথম আলো: এনআরসি, কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল, নাগরিকত্ব সংশোধনী, অযোধ্যার বাবরি মসজিদ নিয়ে রায়—সব দ্রুত ঘটছে। আপনি কি এসব ঘটনার মধ্যে কোনো পরম্পরা দেখতে পান?

মুনিরুজ্জামান: এটা ঘটছে কারণ, বিজেপি একটা বড় ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে। তারা সেই নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়ন করছে। তবে প্রতিবেশীরাই নয়, ভারতের বিভিন্ন রাজ্যও উদ্বেগ প্রকাশ করছে।

প্রথম আলো: বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ভবিষ্যৎ আপনি কী দেখেন?

মুনিরুজ্জামান: বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আছে, কিন্তু এর মধ্যেও কখনো কখনো টানাপোড়েন হতে পারে। এখন দু–একটি বিষয়ে একটা বিরূপ চাপ দেখা যাচ্ছে। তবে এটা সাময়িক বলে আমি মনে করছি, স্থায়ী হবে বলে মনে হয় না।

প্রথম আলো: মিয়ানমার একটি নির্দিষ্ট ধর্মের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিল, তারপরে ভারতও প্রায় অনুরূপ একটা পদক্ষেপ নিল। এই দুইয়ের মধ্যে মিল-অমিল এবং তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব এই অঞ্চলে কীভাবে পড়বে বলে মনে করেন?

মুনিরুজ্জামান: দুটি দেশই আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র। সেখানে ধর্মভিত্তিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে, এর ভিত্তিতে তারা রাষ্ট্রীয় নীতিমালায় পরিবর্তন এনেছে। এসব পরিস্থিতি অবশ্যই আমাদের ওপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। বাংলাদেশের উগ্র মতবাদের গোষ্ঠীগুলো এটাকে কাজে লাগাতে পারে, উসকে দিতে পারে। এই আশঙ্কা থেকে আমাদের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। আমরা যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে পেরেছি, এ ধরনের নেতিবাচক পরিস্থিতির কারণে তা যেন কোনোভাবে বিঘ্নিত না হয়।

প্রথম আলো: আপনি যে পরিস্থিতির কথা বলছেন, তা মোকাবিলায় সাধারণত দুটো কৌশল গ্রহণ করা হয়ে থাকে। একটি হলো বিষয়টিকে সম্পূর্ণরূপে সন্ত্রাস দমনের জায়গা থেকে দেখা, যাকে কাউন্টার টেররিজম বলা হয়; অন্যটি হলো রাজনৈতিকভাবে। আপনি কী মনে করেন?

মুনিরুজ্জামান: আপনি যে দ্বিতীয় কৌশলের কথা বলেছেন, আমি তার ওপরে জোর দিতে চাই। এ ধরনের পরিস্থিতিতে আমাদের জাতীয় সত্তার যে কতগুলো মূল্যবোধ রয়েছে, অর্থাৎ যে সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ বা নীতির ওপর ভিত্তি করে আমরা এতটা পথ এগিয়েছি, সেই পথে আমাদের যেতে হবে।

প্রথম আলো: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিছুদিন আগে বলেছেন, রোহিঙ্গা সংকটের সঙ্গে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার সম্পর্ক রয়েছে। এখন আবার ভারতের সঙ্গে যদি পরোক্ষভাবে হলেও কিছুটা সম্পর্কের ক্ষয় ঘটে, তাহলে বাংলাদেশ কী করবে?

মুনিরুজ্জামান: আশু সমাধানের কোনো আলামত দেখি না। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে রাজি করাতে বন্ধুদেশগুলোর সঙ্গে কথা বলা এবং তাদের এটা বোঝানো যে এটা বাংলাদেশের একার সমস্যা নয়। কালক্রমে এটা আঞ্চলিক নিরাপত্তার প্রতি হুমকিতে রূপ নিতে পারে। এ ধরনের বেশ কিছু আলামত আমরা দেখতে পাচ্ছি। অভ্যন্তরীণভাবে প্রথমত, স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সম্পর্কের বড় ধরনের অবনতি ঘটেছে। দ্বিতীয়ত, মিয়ানমার থেকে ইয়াবা পাচারের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের বেশ কিছু লোক জড়িত হয়ে যাচ্ছে। তৃতীয়ত, বেশ কিছুদিন ধরেই এই অঞ্চলে ক্ষুদ্রাস্ত্র পাচার হয়, এর সঙ্গে যদি রোহিঙ্গাদের কিছু লোক জড়িত হয়ে যায়, সেটা নিরাপত্তা হুমকিতে নতুন মাত্রা যোগ করবে। চতুর্থত বলতে চাই, বিভিন্ন স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক মানব পাচারকারী দল ইতিমধ্যে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের মধ্য থেকে মানব পাচারের জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে এবং অনেক ক্ষেত্রে সাফল্য পেয়েছে। মানব পাচার একটি গর্হিত কাজ এবং আমাদের দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী। গত বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে মানব পাচারের রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, তাতে বাংলাদেশকে তারা টি আর টু ওয়াচলিস্টে রেখেছে। এর অর্থ হচ্ছে আমরা ঠিক খাদের প্রান্তে আছি। এরপরে যদি আমরা মানব পাচারের ক্ষেত্রে এক ধাপ নেমে যাই, তাহলে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের আইনের আওতায় যেসব পদ্ধতি রয়েছে, তার মধ্যে পড়ে যাব। বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা অটোমেটিক চলে আসবে।

প্রথম আলো: এর মধ্যে কি বাণিজ্যিক কোনো নিষেধাজ্ঞা থাকতে পারে?

মুনিরুজ্জামান: বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা আসবে। তাই বলছি, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার প্রতি রোহিঙ্গারা ইতিমধ্যে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে। স্থিতিশীলতার ওপর বড় ধরনের চাপ আসছে। আরও একটা বড় আশঙ্কা হচ্ছে, এই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্য থেকে উগ্র মতবাদের দল এবং সন্ত্রাসী গোষ্ঠী তাদের জনবল সংগ্রহ করার জন্য প্রচেষ্টা চালাবে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে উগ্রবাদ ছড়ানোর ক্ষেত্রটি তৈরি আছে। তারা এমন একটা বড় জনগোষ্ঠী, যারা তাদের কোনো ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছে না, যেখানে তাদের সমাধানের কোনো পথ নেই। এসব পরিস্থিতিই বিভিন্ন উগ্রবাদী গোষ্ঠীর জন্য তাদের মতবাদ ছড়িয়ে দিতে সহায়ক হয়।

আমরা ইতিমধ্যেই দেখতে পাচ্ছি, রাখাইন প্রদেশে আরাকান আর্মি নামে একটা গোষ্ঠী সশস্ত্র সংগ্রাম চালাচ্ছে এবং তারা যে এখানে এসে তাদের অনুকূলে সাহায্য নেওয়ার চেষ্টা করবে না, সেটা সম্পূর্ণরূপে নাকচ করে দেওয়া যায় না। একটি মানবিক সমস্যা নিরাপত্তা সমস্যায় রূপান্তরিত হওয়ার জন্য সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত হয়ে আছে। মিয়ানমার ও তার মিত্রদের বোঝাতে হবে, এটা ঘটলে শুধু আমাদের স্বার্থ বিঘ্নিত হবে তা নয়, এর সঙ্গে আঞ্চলিক স্থিতির প্রশ্নও সরাসরি জড়িত। তাই মিত্রদের উচিত হবে কোনোভাবে তাদের প্রভাব খাটিয়ে এই সমস্যার সমাধানে মিয়ানমারকে বাধ্য করা।

প্রথম আলো: বাংলাদেশের যে কূটনৈতিক শক্তি ও সামর্থ্য, তা দিয়ে কতটুকু করা সম্ভব?

মুনিরুজ্জামান: এটা স্বীকার করতে হবে যে আমরা এই সমস্যায় কিছুটা কূটনৈতিক একাকিত্বের মধ্যে শুরুতেই পড়ে গেছি। এর কারণ হলো বড় দেশগুলোর কেউ সরাসরি আমাদের সমর্থনে এগিয়ে আসেনি। তারা সবাই মিয়ানমারের পক্ষে থেকে কাজ করেছে। এ ছাড়া আরেকটি লিটমাস টেস্টে যান, তাহলে দেখবেন রাখাইনে আরাকান আর্মি সশস্ত্র সংগ্রাম চালাচ্ছে, তা সত্ত্বেও সেখানে বহু দেশি বিনিয়োগ করছে। ভারত সেখানে তার সামরিক সহায়তা বৃদ্ধি করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে একটি বহুজাতিক নৌমহড়া সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয়েছে দক্ষিণ চীন সমুদ্র ও ভারত মহাসাগর এলাকায়। সেখানে কথা ছিল মিয়ানমারকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে না, কিন্তু সেটা ঘটেছে। সব দেশই তাদের নিজের স্বার্থের এমন পথে এগোচ্ছে, যা আমাদের স্বার্থের সঙ্গে মিল হচ্ছে না। এটা কি আমাদের কূটনৈতিক দুর্বলতা বা ব্যর্থতা, সেটা আপনারা বিশ্লেষণ করে দেখতে পারেন। তবে এই উপলব্ধি প্রয়োজন যে কূটনৈতিক অবস্থানটা আরও শক্তিশালী ও জোরদার করতে হবে। নতুন সম্ভাবনা হলো আদালতে একটা শুনানি শুরু হয়েছে, তাতে একটা নতুন মোমেন্টাম তৈরি হয়েছে। এটাকে কাজে লাগিয়ে আমাদের নতুন কিছু কূটনৈতিক উদ্যোগ নিতে হবে।

প্রথম আলো: বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে কি?

মুনিরুজ্জামান: রোহিঙ্গা সমস্যা প্রশ্নে এখানে সব দল ও মতের সমন্বয়ে একটা জাতীয় মতামত আছে। এখানে আমি কারও মধ্যে দ্বিমত দেখতে পাইনি, তাই এ বিষয়ে থাকা জাতীয় সমর্থন কাজে লাগিয়ে নতুন কিছু করার জন্য আমি সুপারিশ করছি। সমস্যা সমাধানের বিষয়টি অনেকটাই আন্তর্জাতিক রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। রাখাইনের বর্তমান পরিস্থিতি যে দুটি বৃহৎ শক্তির দ্বন্দ্বের একটি ক্ষেত্র, তা আমরা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। এখানে চীনের যে বলয় সৃষ্টি হয়েছে, তাকে রুখতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি পরিষ্কার প্রচেষ্টা রয়েছে। রাখাইন প্রদেশে ভারতের কৌশলগত স্বার্থ খুবই স্পষ্ট। সেখানে কালাদান বহুমুখী মহাসড়ক স্থাপনা করছে ভারত। সুতরাং আজকের রাখাইন পরিস্থিতিকে একটা বৃহত্তর পরিসরে দেখতে হবে। তিনটি বৃহৎ শক্তির স্বার্থ ও দ্বন্দ্বের বিষয়গুলোকে বিবেচনায় নিতে হবে।

প্রথম আলো: নেপাল, মালদ্বীপ এবং সবশেষ শ্রীলঙ্কায় যে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন এসেছে, তার আলোকে আপনি যে ভূরাজনৈতিক বিষয়ে কথা বলেছেন, সেটি কতটা বাংলাদেশের জন্য স্বস্তির?

মুনিরুজ্জামান: পুরো অঞ্চলে একটা পরিবর্তনের হাওয়া আমরা দেখতে পাচ্ছি, যাতে দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাববলয়টা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। নেপালের সঙ্গে চীনের আজকের যে সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, অতীতে এ রকম কখনো ছিল না। নেপালের সঙ্গে তারা যে ধরনের যোগাযোগব্যবস্থা স্থাপন করতে যাচ্ছে, তেমনটা তারা আগে কখনো পরিকল্পনা করেনি। একইভাবে মালদ্বীপে নতুন সরকার আসার ফলে চীনের যে প্রভাববলয় ছিল, সেটা কিছুটা কমলেও পুরোটা বদলে যায়নি। শ্রীলঙ্কায় রাজাপক্ষে সরকারের সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। বর্তমানে একই দল আবার ক্ষমতায় ফিরে এসেছে। কাজেই দেখতে হবে, চীনের সঙ্গে তারা সম্পর্কটা আবার পুনঃস্থাপন করে কি না। এককথায় বলতে গেলে, দক্ষিণ এশিয়ায় যে অঞ্চলটি রয়েছে, সেখানে চীনের প্রভাব দিন দিন বেড়েই চলেছে এবং এই অগ্রগতি প্রতিবেশী ভারতের জন্য সুখকর নয়।

প্রথম আলো: ভারতের অবস্থানটি তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে?

মুনিরুজ্জামান: ভারতের দিক থেকেও আমি একটা দ্বৈতনীতি লক্ষ করি। একদিকে মার্কিন কৌশলগত নীতিগুলোর প্রতি ভারতের ঝুঁকে থাকা। মনে হচ্ছে এই অঞ্চলে যেসব মার্কিন কৌশল গ্রহণ করা হবে, ভারত তার অগ্রভাগে থাকবে। এই অঞ্চলে মার্কিন নিরাপত্তা কৌশল বাস্তবায়নে ভারত ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব পালন করবে; কিন্তু আমরা ভারতকে যখন প্রকৃত পদক্ষেপ নিতে দেখি, তখন তা অনেকটা বাস্তবসম্মত প্রতীয়মান হয়। এর কারণ হলো, এই অঞ্চলের দুটি বৃহৎ দেশ, একটি ভারত অন্যটি চীন এবং তারা তাদের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই একটা সহযোগিতামূলক সম্পর্ক ধরে রাখবে। ভারতীয় পত্রপত্রিকায় লেখালেখি থেকে দেখা যায় যে তারা মনে করছে, দুটি দেশের যে উত্থান ঘটছে, সেখানে তারা পরস্পরের পরিপূরক হতে পারে। দেশ দুটি এমন কোনো বিরোধে যেতে পারে না, যা তাদের সংঘাতে জড়িয়ে ফেলতে পারে। এমন কিছু ঘটলে সব থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এই দুই দেশই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই সরাসরি বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হবে না। এই বাস্তব উপলব্ধি থেকে ভারত এমন একটা পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে চাইছে, সেখানে চীনের সঙ্গে তারা একটা কার্যকর ভালো সম্পর্ক বজায় রেখে চলতে পারবে। তার ফল হিসেবে আমরা দেখতে পাচ্ছি, অল্প কয়েক বছর আগের মাত্র ৫ বিলিয়ন ডলারের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য এখন ৮০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে গেছে এবং তারা এখন আশা করছে যে আগামী তিন-চার বছরে এটা ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে।

এই পরস্পর নির্ভরশীলতা থেকে বের হয়ে ভারত পুরোপুরি চীনের বিরুদ্ধে যাবে বলে আমি মনে করি না। যদিও তাদের সম্পর্কে একটা টানাপোড়েন থাকবে। সীমান্ত নিয়ে যে মতপার্থক্য রয়েছে, সেটাও বজায় থাকবে। কিন্তু তারা এমন পরিস্থিতির দিকে যাবে না, যেখানে তারা মুখোমুখি হতে পারে। দুই বছর আগে আমরা দোকলাম পরিস্থিতি দেখেছিলাম, তখন তারা কিছুটা মুখোমুখি অবস্থানে চলে এসেছিল। তারপর ইউহানে দ্বিপক্ষীয় শীর্ষ সম্মেলনে তাদের কাছাকাছি আসতে দেখি। একই রকম শীর্ষ সম্মেলন এবার ভারতে অনুষ্ঠিত হলো। তাই তারা তাদের সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে বাস্তবসম্মত একটা রাস্তা বের করে ফেলেছে। তবে ভারত তার নিজের স্বার্থে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও সহযোগিতা করবে।

প্রথম আলো: তাহলে এই বৃহৎ শক্তি সমীকরণের মধ্যে বাংলাদেশ কোথায়? সে কি তাহলে স্যান্ডউইচ হবে? এই বাস্তবতায় রোহিঙ্গা পরিস্থিতি সামাল দেওয়া বাংলাদেশের জন্য কি বেশ কঠিন নয়?

মুনিরুজ্জামান: আমি মনে করি, বাংলাদেশ সরকারের যদি একটা সাফল্যের তালিকা তৈরি করা হয়, তাহলে সবার ওপরে থাকবে কূটনীতিতে ভারসাম্য তৈরি করতে পারা। চীনের সঙ্গে আমরা ‘কৌশলগত সম্পর্ক’ রক্ষা করে চলেছি। একই সঙ্গে ভারতের সঙ্গেও আমরা ‘গভীর সম্পর্ক’ রক্ষা করে চলেছি। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গেও ‘সুসম্পর্ক’ বজায় রেখেই আমরা এগোচ্ছি। বর্তমান বিশ্বের সব থেকে বড় দুটি কৌশলগত পদক্ষেপের একটি চীনের উদ্যোগে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ বা বিআরআই। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে এসেছে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি। আমাদের বড় সাফল্য হচ্ছে কোনো একটি দেশের সঙ্গে এককভাবে মিত্র হয়ে কাজ না করে সবার সঙ্গে একই সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রেখে কাজ করা। তাই দুটোতেই রয়েছে বাংলাদেশ। আমার বিশ্লেষণে, বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক কৌশলগত অবস্থানের কারণে আমাদের গুরুত্বটা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অনেক বেশি মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারত মহাসাগরঘেঁষা বঙ্গোপসাগরে পৌঁছানোর জন্য আমাদের দেশের ভেতর দিয়ে খুবই একটা গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা যাচ্ছে। আমরা দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়া এবং দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে একটা সেতুবন্ধ। সবকিছু মিলিয়ে আমাদের অবস্থানগত গুরুত্বটা যদি আমরা সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারি, তাহলে সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে কাজ করতে পারব।

প্রথম আলো: বাংলাদেশের যে এত গুরুত্ব, সেটা বিবেচনায় বৃহৎ দেশগুলো বাংলাদেশে অনিচ্ছা সত্ত্বেও কী দিয়েছে বা বাংলাদেশ কী আদায় করতে পেরেছে?

মুনিরুজ্জামান: আমরা যে সুবিধা অর্জন করছি না, সেটা আমি মানতে রাজি নই। বিআরআইতে যুক্ত হওয়ার কারণে আমরা চীনের কাছ থেকে ৪০ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি পেয়েছি। যার মধ্যে ২৬ মিলিয়ন ডলার অবকাঠামো তৈরি ও ১৪ বিলিয়ন ডলার হবে যৌথ বিনিয়োগ। এটা একটা বড় ধরনের অর্জন। এ ছাড়া চীনের কাছ থেকে আমরা বড় ধরনের বিনিয়োগের সুবিধা পেয়েছি। চীনের অর্থায়নে চট্টগ্রামে বড় ধরনের অর্থনৈতিক জোন তৈরি করা হচ্ছে। সেখানে বিভিন্ন চীনা কারখানা স্থানান্তর হবে। চীনা সামরিক সহায়তা অব্যাহত রয়েছে। ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে আমরা বড় ধরনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে পেরেছি। তৈরি পোশাকে আমরা ডিউটি ফ্রি এবং কোটা ফ্রি সুবিধা নিশ্চিত করতে পেরেছি। এ ছাড়া আরও অনেক সুবিধা আমরা পেয়েছি এবং তা আরও বৃদ্ধি করা যেতে পারে বলে আমি মনে করি। যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকেও আমরা বড় ধরনের সাহায্য পাচ্ছি। এটা যে শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সেটা নয়। আমরা বিভিন্ন ধরনের সামরিক সহযোগিতা পাচ্ছি। সন্ত্রাস দমনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে আমরা অর্থনৈতিক এবং বড় ধরনের কারিগরি সহায়তা পেয়েছি। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় আমরা তাদের কূটনৈতিক সাহায্য পেয়েছি।

তাই এসব বড় দেশের কাছ থেকে আমরা সাহায্য পাই না, সেটা নয়। তবে এই সাহায্যের মাত্রাটা আমরা ধীরে ধীরে আরও বৃদ্ধি করতে পারি। তবে তিনটি বড় রাষ্ট্রের কাছ থেকে আমরা যে বিভিন্ন সহায়তা পাচ্ছি, সেটা আমাদের মানতে হবে।

প্রথম আলো: রোহিঙ্গা ইস্যুতে স্পষ্টতই দুটি দেশের কাছ থেকে আমরা কাঙ্ক্ষিত সহায়তা পাচ্ছি না।

মুনিরুজ্জামান: আমরা সেটা পাচ্ছি না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে পেলেও আমাদের ঘরের কাছের দুই বৃহৎ রাষ্ট্রের কাছ থেকে আমরা প্রত্যাশিত সাহায্য এখনো পাইনি। তারা যদিও মানবিকভাবে সাহায্য করেছে। এর বাইরে তারা আমাদের অবস্থানকে সমর্থন করেনি। এ জন্য তাদের নতুন করে যুক্ত করে এ বিষয়ে আমাদের ভাবতে হবে।

প্রথম আলো: রোহিঙ্গা দিয়েই শেষ করি। কানাডীয় অধ্যাপক জন প্যাকার বলেছেন, অমুসলিম দেশগুলোর উচিত আইসিজেতে নতুন দরখাস্ত নিয়ে যাওয়া।

মুনিরুজ্জামান: আমি এ রকম কোনো আশু সম্ভাবনা দেখছি না। একই সঙ্গে আইসিজেতে নতুন নতুন মামলা করলে কার্যকর ও ফলপ্রসূ কিছু পাওয়া যাবে, সেটাও আমি দেখছি না। আপনি জানেন যে এখানে কোনো ব্যক্তিকে দোষারোপ করা যাবে না। আর রায় বাস্তবায়নে আদালতের এখতিয়ার নেই। রায়ের পরে এটা আবার জাতিসংঘের কাছে ফেরত যাবে। মিয়ানমার রায় বাস্তবায়ন না করলে এটা নিরাপত্তা পরিষদে নিতে হবে। সুতরাং বিষয়টি শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক রাজনীতির ওপর নির্ভর করবে। যদি কেউ ভেটো দেয়, তাহলে সেটা সেখানেই শেষ।

প্রথম আলো: চীন ও রাশিয়া আগে ভেটো দিয়েছে, তার আর নড়চড় আশা করেন না?

মুনিরুজ্জামান: এখন পর্যন্ত আমি এর কোনো পরিবর্তন লক্ষ করছি না। তবে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যদি জনমত ব্যাপকভাবে পরিবর্তন হয়, সেটা আলাদা। এখন যেটা হতে যাচ্ছে, সেটা হয়তোবা একটা নৈতিক বিজয় হবে। দ্বিতীয় যেটা হবে, যদি আমরা অন্তর্বর্তীকালীন কোনো সিদ্ধান্ত পাই, সেখানে হয়তো সাময়িকভাবে একটা প্রতিকার পাওয়া যাবে কিছু ক্ষেত্রে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের অনুকূলে একটা মোমেন্টাম তৈরি হয়েছে। ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে মিয়ানমার আদালতে অনেক দোষ স্বীকার করে নিয়েছে। সেখানে তারা কিন্তু বলছে, হয়তো যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়েছে, কিন্তু গণহত্যা হয়নি। আমি আশা করি যে কখনো আইসিসিতেও শুনানিটা শুরু হবে। কার্যত রাষ্ট্রপ্রধানই যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়েছে বলে প্রকারান্তরে স্বীকার করে নিয়েছেন। এগুলো হচ্ছে অর্জন।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

মুনিরুজ্জামান: ধন্যবাদ।