নারীর নিরাপত্তা নিয়ে পরামর্শ এবং কিছু প্রশ্ন

প্রথম আলোর ফাইল ছবি
প্রথম আলোর ফাইল ছবি

বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে চলন্ত বাসে এবং গণপরিবহনে নারীর নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা বেড়েই চলছে। এ কারণে বাসে চলাচলকারী নারীরা প্রতি মুহূর্তে হুমকির মুখে আছেন। বাংলাদেশে বাসে নারী নিপীড়ন ক্রমাগত বাড়ছেই। ২০১৩ থেকে এখন পর্যন্ত চলন্ত বাসে ঘটে যাওয়া ধর্ষণ বা ধর্ষণচেষ্টার ঘটনা ২৯টি। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সূত্র অনুযায়ী, ২০১৩ সালে দুটি, ২০১৫ সালে চারটি, ২০১৬ সালে তিনটি, ২০১৭ সালে ছয়টি, ২০১৮ সালে ছয়টি ও ২০১৯ সালে আটটি ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে প্রায় ১৩ শতাংশ নারীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। 

গণপরিবহনে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য এবার নারীদের জন্য কিছু পরামর্শ প্রকাশ করল বাংলাদেশ পুলিশের জনসংযোগ বিভাগ। এগুলো হলো: কোনো গাড়িতে যাত্রীসংখ্যা পাঁচ-সাতজনের কম হলে সেই গাড়িতে ভ্রমণের বিষয়ে সতর্ক থাকা অথবা অধিক যাত্রীসংবলিত গাড়ির জন্য অপেক্ষা করা। ক্লান্তি থাকা সত্ত্বেও একা ভ্রমণের সময় গাড়িতে না ঘুমানো। গাড়িতে ওঠার সময় গাড়ি যাত্রীতে পূর্ণ থাকলেও বিভিন্ন স্টপেজে যাত্রী নামতে নামতে যদি যাত্রীসংখ্যা ১০-এর কাছাকাছি পৌঁছে যায়, তাহলে গাড়ি থেকে নামার আগপর্যন্ত অত্যন্ত সতর্ক থাকা। এমন পরিস্থিতিতে গাড়ির যেকোনো সুবিধাজনক সিটে বসার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, যেখান থেকে চালকের সহকারী, কন্ডাক্টর, চালকসহ অন্যান্য যাত্রীর ওপর সজাগ দৃষ্টি রাখা যায়। প্রয়োজনে পরিবারের কাউকে অথবা নির্ভরযোগ্য কাউকে মোবাইল ফোনে কল করে একটু উচ্চ শব্দে (গাড়ির ভেতরে থাকা অন্য যাত্রীদের শুনিয়ে শুনিয়ে) গাড়ির নাম, বর্তমান অবস্থান এবং গন্তব্যস্থল সম্পর্কে জানিয়ে রাখার উপদেশও আছে। 

কিছু প্রশ্নকে সঙ্গে নিয়েই পুলিশের জনসংযোগ বিভাগকে ধন্যবাদ জানাই বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য। যেমন পরামর্শমালায় আরও আছে, কোনো স্টপেজে যাত্রীসংখ্যা আরও কমে পাঁচের নিচে চলে আসার উপক্রম হলে সেটি গন্তব্যস্থল না হলেও অন্য যাত্রীদের সঙ্গে সেই স্টপেজেই নেমে পড়া এবং পরিবারের কাউকে মোবাইলে কল করে সেখানে এসে নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করা। নিতে আসা ব্যক্তিটি ওই স্থানে না আসা পর্যন্ত সঙ্গে থাকার জন্য যাত্রীদের মধ্য থেকে আপনার দৃষ্টিতে নির্ভরযোগ্য কাউকে অনুরোধ করা। এখন কথা হলো, গন্তব্য এলাকা থেকে কত দূরে এসে বাসটি পাঁচজন যাত্রী হবে, এটি কীভাবে বোঝা যাবে? যিনি নিতে আসবেন তিনি কখন পৌঁছাবেন, সেটিও এ দেশে বলা কঠিন। প্রতিটি পরিবারে এই রকম কল পেয়ে ছুটে আসা মানুষ আছে কি না, তা-ও চিন্তায় রাখা দরকার। 

এ ছাড়া তখনকার সময়, দিন-রাত, এলাকা, রাস্তাঘাট, সেই এলাকার যানবাহনের প্রকৃতি, মূল সড়ক থেকে কত দূরে, এগুলো বিবেচনায় না এনে এ রকম পরামর্শ বিতরণ ঠিক কতটা কাজে আসবে, বলা কঠিন। এ ছাড়া আছে গাড়িতে যাত্রীর সংখ্যা পাঁচের কাছাকাছি থাকা অবস্থায় যদি গাড়ির ভেতরে থাকা কারও মধ্যে অস্বাভাবিক কোনো চঞ্চলতা দেখা যায় এবং প্রয়োজন ছাড়াই গাড়ির দরজা এবং জানালা বন্ধ করে দিতে দেখলে, তাহলে দেরি না করে সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে কল করে পুলিশের সাহায্য নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। দেখা গেছে, এই ধর্ষণ বা ধর্ষণের চেষ্টা ২৫ শতাংশ আঞ্চলিক সড়কে এবং ২৫ শতাংশ রাজধানী বা নগরীর অভ্যন্তরীণ সড়কে সংঘটিত হয়েছে। অপরাধ সংঘটনস্থল সাধারণত স্টেশন থেকে বেশ কিছুটা দূরেই ছিল, যেখানে পথচারী বা টহলরত পুলিশ কম থাকে। 

এখন প্রশ্ন হলো, কোনো নারী কল দিলেন সহযোগিতার জন্য, পুলিশ আসতে আসতেই তিনি ধর্ষণ কিংবা যৌন হয়রানির শিকার হলেন, হয়তো পুলিশ ধর্ষণকারীকে গ্রেপ্তার করে পারল, কিন্তু ধর্ষণ কিংবা যৌন হয়রানি কি ঠেকাতে পারবে? ভুক্তভোগীদের ৬৫ শতাংশ রাত ৮টা থেকে ১১টার মধ্যে, ২৫ শতাংশ স্বামী বা পুরুষ সঙ্গী থাকা সত্ত্বেও মধ্যরাতে এবং ১০ শতাংশ দিনের বেলায় সংঘবদ্ধ আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন। এখানে আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো গণপরিবহনে নারীদের প্রায় ৬৮ শতাংশ রাত ৮টা থেকে ১১টার মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ২৭ শতাংশ স্বামী বা পুরুষ সঙ্গী থাকা সত্ত্বেও মধ্যরাতে ধর্ষণ অথবা যৌন হয়রানির শিকার হন। প্রায় ১২ শতাংশ দিনের বেলাতেই মাইক্রোবাস এবং বাসে সংঘবদ্ধ আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন। 

অবস্থা পর্যবেক্ষণে মনে হচ্ছে, এখন গণপরিবহনে চড়ে নারীকে কম্পিউটার হয়ে যেতে হবে। প্রতিটি উপদেশে নারীর দায় এবং দায়িত্বের প্রতি জোর দেওয়া হচ্ছে, যা একভাবে যৌন নিপীড়ককে এবং যৌন নিপীড়নকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। কারণ, এখানে যৌন নিপীড়নমনস্কতা নিয়ে কিছু বলা নেই। ঠিক একই বিষয় আমরা লক্ষ করেছিলাম অষ্টম শ্রেণির গার্হস্থ্যবিজ্ঞানের সপ্তম অধ্যায়ে ৬৫ নম্বর পৃষ্ঠায় পাঠ-৩-এ। সেখানে যৌন নিপীড়ন থেকে রক্ষার সতর্কতা ও কৌশল বর্ণনা করা হয়েছে। যেখানে যৌন হয়রানি বা নিপীড়ন থেকে রক্ষার কৌশল হিসেবে পাঠ্যপুস্তকে বলা হয়েছে, ‘বাড়িতে কখনোই একা না থাকা, অন্যকে আকর্ষণ করে এমন পোশাক না পরা, পরিচিত কিংবা অপরিচিত ব্যক্তি গায়ে হাত দিলে তাকে এড়িয়ে যাওয়া বা পরিত্যাগ করা, পরিচিত-অপরিচিত কারও সঙ্গে একা বেড়াতে না যাওয়া, মন্দ স্পর্শ টের পেলে অবশ্যই তা সঙ্গে সঙ্গে মা-বাবাকে জানানো এবং পাড়ার বখাটে দলের হয়রানিতে সরাসরি প্রতিক্রিয়া না করে কৌশলে উপেক্ষা করা।’ 

যৌন হয়রানি বা ধর্ষণের শিকার হবেন নারী আর তাঁকেই এটি ঠেকানোর দায়িত্ব নিতে হবে, রাষ্ট্রীয় জায়গা থেকে যদি এটি ভাবা হয়, তাহলে আসলে এই ধরনের নিপীড়ন বন্ধ হবে না। পুরুষের পুরুষতান্ত্রিক আচরণ কীভাবে ঠিক করতে হবে, কীভাবে সেটি নজরদারিতে আনতে হবে, কী কী ধরনের পদক্ষেপ পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে নেওয়া যেতে পারে, এ বিষয়ে আলোচনা হওয়া জরুরি। নারী কারাতে শিখছেন, বক্সিং শিখছেন সেটি গুরুত্বপূর্ণ; কিন্তু পুরুষের আচরণকে আলোচনায় না এনে শুধু নারীকে কেন্দ্র করেই যৌন নিপীড়ন কিংবা ধর্ষণ ঠেকানোর কর্মসূচি আদৌ যে খুব একটা কাজের কাজ হবে না, তা নিশ্চিত।

জোবাইদা নাসরীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক
[email protected]