ভারতের নাগরিকত্ব বিতর্কে বাংলাদেশ
নাগরিকত্ব আইনের নতুন সংশোধনী নিয়ে ভারত এখন উত্তাল। আসামে পরীক্ষামূলকভাবে জাতীয় নাগরিকত্বের তালিকা প্রকাশ থেকে যে কথিত অভিবাসন প্রতিরোধ কার্যক্রম ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সরকার শুরু করেছে, তারই উচ্চতর বা দ্বিতীয় ধাপ হচ্ছে এই নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনী (সিএএ)। এই আইনগুলোর পেছনে যে লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য আছে, তা-ও বেশ পরিষ্কার। মূলত মুসলমান অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ। এটি ভারতে বসবাসরত নাগরিকদের মধ্যে যাঁরা একটি নির্দিষ্ট সময়ের আগে দেশটিতে জন্মসূত্রে ছিলেন, প্রমাণ করতে পারবেন না তাঁদের অনাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করা, আর নতুন করে মুসলমান কোনো অভিবাসীকে দেশটিতে থাকতে না দেওয়া।
বিজেপি সরকার অবশ্য তার উদ্দেশ্যকে একটু ঘুরিয়ে বলেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের ব্যাখ্যায় বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে নিপীড়নের শিকার ওই সব দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের যাঁরা ভারতে আশ্রয় চান, তাঁদের মানবিক কারণে আশ্রয় দেওয়াই হচ্ছে তাঁদের এই সংশোধনীর উদ্দেশ্য। গত মে মাসের নির্বাচনের আগেও নির্বাচনী প্রচারে অমিত শাহ এবং বিজেপি নেতাদের একই ধরনের অঙ্গীকার ছিল। তবে তখন তাঁরা বক্তৃতায় শুধু বাংলাদেশের কথাই বলেছেন।
এর আগে অটল বিহারি বাজপেয়ির নেতৃত্বে বিজেপি যখন ক্ষমতায় ছিল, সেই সময়ও তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আদভানি দুই কোটি (টোয়েন্টি মিলিয়ন) অবৈধ বাংলাদেশি ভারতে বসবাস করছেন বলে অভিযোগ করেছিলেন। যদিও লন্ডনে এক সংবাদ সম্মেলনে আমি যখন তাঁর উদ্ধৃত সংখ্যার কাগজে-কলমে কী প্রমাণ আছে জানতে চেয়েছিলাম, তখন তিনি বলেছিলেন যে সংখ্যাটি বহুদিন আগে থেকেই তাঁরা শুনে এসেছেন। ওই সংখ্যার রহস্য অনুদঘাটিতই থেকে গেছে। অমিত শাহের আগে যিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন, সেই রাজনাথ সিংও বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অভিবাসনের কথা বলেছেন এবং তা বন্ধের জন্য সীমান্তজুড়ে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন।
বিজেপির এই আইনের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন হচ্ছে, তার সবচেয়ে লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ছাত্র-তরুণেরা বিপুল সংখ্যায় এর বিরোধিতায় সরব হয়েছেন এবং সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছেন। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিরোধী দলগুলো তো বটেই, এমনকি সরকারের বর্তমান ও সাবেক সহযোগীদেরও অনেকে আইনটি সমর্থন করছেন না। আইনটির বিরোধিতাকারীরা মোটামুটি একবাক্যে বলছেন যে এই আইনটি সাম্প্রদায়িক, সংবিধানবিরোধী এবং তা ভারতের অসাম্প্রদায়িক চরিত্রকে পুরোপুরি বদলে দিচ্ছে। আন্দোলনে দেশটিতে ইতিমধ্যেই ২২ জনের মতো প্রতিবাদকারীর প্রাণহানি ঘটেছে, আহত হয়েছেন বহু এবং গ্রেপ্তারের সংখ্যাও কম নয়। আন্দোলন দমনে নানা ধরনের নিবর্তনমূলক পদক্ষেপ জারি করেও এক সপ্তাহেরও বেশি সময়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব হয়নি। জম্মু-কাশ্মীরে টানা চার মাসের মতো ইন্টারনেট-সংযোগ বন্ধ রাখার কারণে ইতিমধ্যেই রাজনৈতিক কারণে ইন্টারনেট বন্ধ রাখার বিশ্ব রেকর্ডের অধিকারী দেশটির সবচেয়ে বড় রাজ্য উত্তর প্রদেশসহ বিভিন্ন রাজ্যে আংশিক বা পুরোপুরিভাবে এই সেবা বন্ধ রেখেছে। সংবাদমাধ্যমের ওপরও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২২ ডিসেম্বর দিল্লির রামলীলা ময়দানে এক জনসভায় বলেছেন, সারা দেশে এনআরসি করার কোনো পরিকল্পনা নেই। তাঁর এই ঘোষণা উত্তেজনা কমানোর চেষ্টা বলে অনেক বিশ্লেষক মন্তব্য করেছেন, কিন্তু তাঁর এই ঘোষণা বিশ্বাসযোগ্যতা পায়নি। ২৩ ডিসেম্বর নাগাদ অন্তত এক ডজন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা ঘোষণা করেছেন, তাঁরা তাঁদের রাজ্যে এনআরসি হতে দেবেন না।
আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে এবং জনমত গঠনের লক্ষ্যে এরই মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আইনগুলোর বিষয়ে বেশ কিছু ব্যাখ্যা হাজির করা হয়েছে। এমনকি যে তিনটি দেশের কথিত নিপীড়িত সংখ্যালঘুদের আশ্রয় দেওয়া সহজ করার কথা আইনে বলা হয়েছে, ওই সব দেশের কতজনকে দেশটি নাগরিকত্ব দিয়েছে, সেই হিসাবও সরকারিভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। সরকারের ব্যাখ্যায় তিনটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেছেন, নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য ১৯৭১ সালের আগে নিজের বা মা-বাবা অথবা পিতামহ বা মাতামহের ভারতে জন্মের সনদ দেখানোর প্রয়োজন হবে না। অন্য সাক্ষ্য-প্রমাণেও চলবে। আসামের ক্ষেত্রে নাগরিক রেজিস্টারে নাম তালিকাভুক্ত করতে এটি বাধ্যবাধক করা হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আগে যাঁরা ভারতে গিয়ে আশ্রয় চেয়েছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে আইনটি প্রযোজ্য হবে। তৃতীয়ত, গত ছয় বছরে ভারত এই তিনটি দেশের যাঁদের নাগরিকত্ব দিয়েছে, তা হলো ২ হাজার ৮৩০ জন পাকিস্তানি, ৯১২ জন আফগান এবং ১৭২ জন বাংলাদেশি। যাঁদের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছে, তাঁরা সবাই যে সংখ্যালঘু ধর্মীয় গোষ্ঠীর নয়, সে কথাও মুখপাত্র তাঁর টুইটে উল্লেখ করেছেন। তিনি আরও জানিয়েছেন, ১৯৬৪ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে ভারত ৪ লাখ ৬১ হাজার ভারতীয় বংশোদ্ভূত তামিলকে নাগরিকত্ব দিয়েছে।
ভারতের সরকারি কোনো পরিসংখ্যানে বাংলাদেশিদের সে দেশে নাগরিকত্ব লাভের সংখ্যায় বড় ধরনের কোনো অভিবাসন স্রোতের প্রতিফলন নেই। ছয় বছর আগে কি এই হার অনেক বেশি ছিল? এই প্রশ্নের কোনো উত্তর ভারত সরকার এখনো প্রকাশ করেনি। সংখ্যাটা বড় হলে তা প্রকাশ না করার কোনো কারণ নেই। প্রতি দশকে একবার করে যে জনশুমারি হয়, সেই শুমারিতে সব বাসিন্দার হিসাব থাকার কথা। সুতরাং অভিবাসী হিসেবে যাঁরা সেখানে ছিলেন, তাঁদের চিহ্নিত হয়ে যাওয়ার কথা। এরপর আছে ইমিগ্রেশনে পাসপোর্টের প্রবেশ এবং বহির্গমনের হিসাব। সেখান থেকেও হিসাব বের হওয়ার কথা যে কতজন দেশটিতে বৈধপথে ঢুকে আর বের হননি। তৃতীয় যে পথ অবৈধভাবে চলাচল, সেটি বন্ধের জন্য কাঁটাতারের বেড়া বসছে তো প্রায় এক দশক ধরে। সুতরাং চোরাইপথে হাজার হাজার অভিবাসন হওয়ার সম্ভাবনাও কম। অথচ বাংলাদেশের কথিত অভিবাসনকামীদের ঠেকানোর কথা বলেই ভারতে এই রাজনৈতিক উত্তেজনা। স্মরণ করা যেতে পারে যে আসামে বাংলাভাষী মুসলমানদের বিতাড়নের উদ্দেশ্যে যে এনআরসির সূচনা, তাতে অনাগরিক হিসেবে চিহ্নিত ১৯ লাখের অর্ধেকেরও বেশি বাংলাভাষী হিন্দু হওয়ায় রাজ্যটির হিন্দুত্ববাদী সরকার নিজেরাই ওই এনআরসি বাতিল করে নতুন করে নাগরিকত্ব যাচাইয়ের দাবি তুলেছে। সেখানেও লাখ লাখ কথিত বাংলাদেশির সন্ধান মেলেনি।
ভারত তাদের আইনে কী সংশোধনী আনবে, সেটা ভারতের নিজস্ব বিষয় ঠিকই। কিন্তু সেই আইন সংশোধনের জন্য বাংলাদেশিদের প্রতি অযৌক্তিক ও অবমাননাকর অভিযোগ তোলা হয়, তখন সে বিষয়ে নিশ্চুপ থাকা কীভাবে সমর্থনযোগ্য? নিজ দেশের নাগরিকদের মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব কার? ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধন আইন তখন কি আর সে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় থাকে? আর সাম্প্রদায়িক বিভাজন ও বৈষম্যের বিষয়গুলোই বা উপেক্ষণীয় হয় কীভাবে?
ভারতে বাংলাদেশিদের অবৈধ অভিবাসনের এই অভিযোগ ও অপপ্রচারের জবাবে বাংলাদেশ মাঝেমধ্যে যে মৃদু প্রতিবাদ করেনি, তা নয়। কিন্তু আগ বাড়িয়ে এমন কথাও বলা হয়েছে, যাতে ধারণা হয়, অভিযোগটি আমরা মেনে নিচ্ছি। বলা হয়েছে, নাগরিকত্বের প্রমাণ দিলে বাংলাদেশ কথিত বাংলাদেশিদের গ্রহণ করবে। জাতীয় পরিচয়পত্র ও জন্মসনদ নেওয়ার মতো বিষয়গুলো তো হাল আমলের অগ্রগতি। অতীতে ৩০-৪০ বছর আগে এগুলোর কথা কেউ কখনো ভেবেছেন, না তা সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করেছেন যে ভবিষ্যতে কেউ তাঁর নাগরিকত্ব অস্বীকার করবে। কাগজপত্র ছাড়া লাখ লাখ বাংলাভাষী মুসলমান অনাগরিক হিসেবে হয়রানির শিকার হবেন—এমন আশঙ্কা কোনোভাবেই নাকচ করে দেওয়া যায় না।
আর সে রকম হলে সম্প্রতি অল্প কিছু কথিত বাংলাদেশিকে যেভাবে সীমান্তের এপারে ঠেলে দেওয়া হয়েছে, সেভাবে অন্যদেরও ঠেলে দেওয়া হলে তা বন্ধ করা কি সম্ভব হবে? রাজনৈতিক কারণে যেমন তা অসম্ভব হতে পারে, তেমনি মানবিক কারণেও হতে পারে। সুতরাং এই বাস্তবতায় কোনো ধরনের নমনীয়তা কাম্য নয়। প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর নরেন্দ্র মোদি যে বলেছিলেন ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’। সেই কথাটির আলোকে আমরা কি কখনো তাঁকে বলেছি যে সীমান্তে কাঁটাতার বসিয়ে এবং চলাচল কঠোর করে সবার বিকাশ হয় না? অভিবাসনের রাজনীতিতে প্রতিবেশীকে হেয় করলে তা বরং ক্ষতির কারণ হয়।
ভারতের সংবাদমাধ্যমে অনেক বিশ্লেষকই কোনো ধরনের রাখঢাক ছাড়াই বলেছেন যে মোদি সরকারের এই নাগরিকত্ব আইনের মাধ্যমে দেশটি তার প্রতিবেশীদের মধ্যে সবচেয়ে কাছের রাষ্ট্রটির সঙ্গে অন্যায় করছে। মোটাদাগে তাঁরা সবাই বলেছেন, এই আইনের কারণে সৃষ্ট রাজনৈতিক সংকট ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কের ওপর অবশ্যই প্রভাব ফেলবে। আমাদের কর্তাব্যক্তিদের এ নিয়ে কোনো চিন্তাভাবনা আছে কি না, তা বোঝা যাচ্ছে না।
কামাল আহমেদ: সাংবাদিক