গরু যে বাঁচে না বাপ

ব্রহ্মপুত্র ভাঙছেই। চলতি বছরের বন্যার পর গাইবান্ধা জেলার কামারজানি ইউনিয়নের কুন্দেরপাড়ার প্রায় অর্ধেকটা চলে গেছে নদে। কোনোমতে চরের একমাত্র উচ্চবিদ্যালয়টি এখনো টিকে আছে। প্রথম আলোর উপকরণ সহযোগিতায় গ্রামবাসী আর ছাত্রছাত্রীদের স্বেচ্ছাশ্রমে তৈরি বাঁশের বাঁধের কল্যাণে এবারের মতো টিকে গেলেও ভবিষ্যতে টিকবে কি না, কেউ জানে না। বাঁধটা এই শীতে আবার বাঁধতে হবে। চরভাঙা মানুষ এখন সেই স্কুলের মাঠেই গাদাগাদি করে বসবাস করছে। গত আট বছরে তিনবারের ভাঙায় সামসু বয়াতি এখন কুন্দেরপাড়ায় বাস্তুহারা। তাঁর ঘরে ঢুকে দেখি, একটা গরুর সারা গায়ে নিম-নিশিন্দার পাতা জড়িয়ে রাখা হয়েছে। জাঁকিয়ে শীত পড়লে গরুর গায়ে চটের চাদর জড়াতে দেখেছি, কিন্তু নিম-নিশিন্দার জামা পরাতে দেখিনি কখনো।

আমার ভ্যাবাচেকা ভাব দেখে বয়াতি জানান, তাঁর শেষ সম্বল গরুগুলোকে বাঁচানোর আর কোনো পথ জানা নেই। অনেক দিন থেকেই গরুর এই নতুন রোগের কথা তিনি শুনছিলেন, কিন্তু এখন তাঁর গরু ভুগছে এই রোগে। গায়ে প্রথমে বসন্তের মতো গুটি দেখা যায়। এরপর এক-দুই দিনের মধ্যেই গরুর পুরো শরীরেই গুটিগুলো বড় হয়ে ঘায়ে পরিণত হয়। এ সময় গরুর গায়ে খুব জ্বর (তাপমাত্রা) ওঠে, গরু খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দেয়। অনেক সময় গরুর বুকের নিচে পানি জমে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। কোনো কোনো সময় ক্ষত থেকে মাংস খসে পড়ে। চিকিৎসা কিংবা রোগের লক্ষণ জানা না থাকায় বেশ কিছু গরু মারা গেছে। গরুর মালিক সবাই এখন আতঙ্কিত। বয়াতি শুনেছেন, মশা এই রোগ ছড়াচ্ছে , তাই তিনি নিজের বুদ্ধিতে মশা-মাছি থেকে আক্রান্ত গরুটি বাঁচানোর জন্য নিম-নিশিন্দার জামা পরিয়েছেন।

শুধু চর কুন্দেরপাড়ায় নয়, এই আতঙ্কের রোগ এখন ছড়িয়ে পড়েছে দেশের দিকে দিকে। নওগাঁর রানীনগরে, চট্টগ্রাম জেলার মিরসরাই ও চন্দনাইশ উপজেলায়, গাইবান্ধা সদর ও সাঘাটা উপজেলায়, দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটে, নাটোরের বাগাতিপাড়ায় একই ধরনের রোগের অব্যাহত বিস্তার উদ্বেগজনকভাবে বেড়েই চলেছে। আমাদের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর গরুর এই রোগকে বলছে ভাইরাসজনিত চর্মরোগ। নাম দিয়েছে লাম্পি স্কিন রোগ বা লাম্পি স্কিন ডিজিজ।

এখন পর্যন্ত এটি গরু আর মহিষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে। এই রোগের ভাইরাসের প্রধান বাহক হিসেবে মশা–মাছিকে দায়ী করা হয়। অন্যান্য কীটপতঙ্গের মাধ্যমেও ভাইরাসটি আক্রান্ত গরু থেকে অন্য গরুতে ছড়িয়ে পড়তে পারে। আক্রান্ত গরুর লালা খাবারের মাধ্যমে অথবা খামারে কাজ করা মানুষের কাপড়ের মাধ্যমে এক গরু থেকে অন্য গরুতে ছড়াতে পারে। আক্রান্ত গাভির দুধ খেয়ে বাছুর এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। আক্রান্ত গরুতে ব্যবহার করা সিরিঞ্জ থেকে এই ভাইরাস বাহিত হতে পারে। আক্রান্ত ষাঁড়ের বীর্য এই রোগের অন্যতম বাহন হতে পারে।

 জানা যায়, লাম্পি স্কিন রোগটি ১৯২৯ সালে আফ্রিকার জাম্বিয়াতে প্রথম দেখা দেয়। পরে আফ্রিকা মহাদেশের প্রায় সব দেশেই এটা ছড়িয়ে পড়ে। এরপর ২০১৩ সালে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে এবং ২০১৪-১৫ সালে আজারবাইজান, আর্মেনিয়া, কাজাখস্তানসহ আশপাশের দেশে এ রোগ দেখা দেয়। ২০১৬ সালে গ্রিস, সাইপ্রাস, বুলগেরিয়া, সার্বিয়া, কসোভোসহ ওই এলাকার অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ২০১৯ সালে চীন ও ভারতে আক্রান্তের পরেই বাংলাদেশে রোগটি অতি সম্প্রতি দেখা দিয়েছে।

 গরুর লাম্পি স্কিন ডিজিজ কেবল এক-দুটি গরু পালা গৃহস্থের সমস্যা নয়, বড় বড় খামারিও এখন সন্ত্রস্ত-ভীত। কড়া নিয়ম আর হুঁশিয়ারির মধ্যে থেকেও ডেইরি ফার্মগুলো প্রমাদ গুনছে। তারা এই রোগের একটা প্রতিবিধানের জন্য সরকারের সঙ্গে দেনদরবার শুরু করেছে। বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় কমিটি ৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের সঙ্গে দেখা করে লাম্পি স্কিন ডিজিজ ও অন্যান্য সমস্যা নিয়ে তাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কথা জানায়।

এরপর ৭ ডিসেম্বর ২০১৯ ‘লাম্পি স্কিন ডিজিজ নিয়ে আতঙ্ক নয়, প্রয়োজন সচেতনতা’ শিরোনামে একটি সেমিনারের আয়োজন করা হয়। এই অনুষ্ঠানে দেশের নানা প্রান্ত থেকে আতঙ্কিত প্রায় ৪৫০ জন খামারি উপস্থিত হন। তবে সেমিনার থেকে তাঁরা কোনো আশা নিয়ে ফিরতে পারেননি। তাঁদের বলা হয়েছে, ভয়ের কিছু নেই, সবুর করুন, ঠিকমতো চিকিৎসা করালে রোগ ভালো হয়ে যাবে। ঠিকমতো চিকিৎসা বলতে কী বোঝানো হয়েছে, তার কোনো ব্যাখ্যা নেই।

প্রাণিসম্পদ চিকিৎসকদের মধ্যেও চিকিৎসাপদ্ধতি নিয়ে দোটানা। এখন পর্যন্ত আক্রান্ত গরুকে অ্যান্টি-অ্যালার্জিক ইনজেকশন দিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। সব জায়গায় যে এটা কাজ করছে, তা বলা যাবে না। মিরসরাই উপজেলার ১১ নম্বর মঘাদিয়া ইউনিয়নের মধ্যম মঘাদিয়া এলাকার নুর উদ্দিন জানিয়েছেন, চিকিৎসকের মাধ্যমে চিকিৎসা করলে কিছুটা কমলেও পুরোপুরি সুস্থ হয়নি তাঁর গবাদিপশু। একই উপজেলার পূর্ব গোভনিয়া এলাকার নিজামউদ্দিন জানান, উপজেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয় থেকে ওষুধ খাওয়ানোর পরও ক্ষত শুকাচ্ছে না।

যেহেতু রোগটি মশার মাধ্যমে ছড়াচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে, তাই আক্রান্ত গরুটি আলাদা করে রাখার পরামর্শ দিচ্ছেন প্রাণী চিকিৎসকেরা। তাঁরা বলছেন, রোগাক্রান্ত গরুকে অবশ্যই মশারির মধ্যে রাখতে হবে। আক্রান্ত গরুর জ্বর হলে দ্রুত প্যারাসিটামল-জাতীয় ওষুধ খাওয়াতে হবে। আর এভাবে চার থেকে পাঁচ দিন অতিবাহিত হলে যদি ক্ষতের জায়গা বেশি খারাপ হয়, তাহলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

নতুন কোনো রোগের প্রাদুর্ভাব ও বিস্তার ঘটলে চিকিৎসকেরা অপ্রস্তুত পরিস্থিতিতে পড়েন। এই অপ্রস্তুতি দূর করার দায়িত্ব প্রাণিসম্পদ দপ্তর, প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর। ধারাবাহিক গবেষণার মাধ্যমে গবাদিপশুর রোগ প্রতিরোধের প্রক্রিয়াকে হালনাগাদ রাখার কোনো বিকল্প নেই। কাজটা সময়মতো করতে না পারলে বিপত্তি সংকটে রূপ নিতে পারে। লাম্পি স্কিন ডিজিজের কোনো প্রতিষেধক এখন পর্যন্ত উদ্ভাবিত না হওয়ায় সংশ্লিষ্টদের বেশি সাবধান থাকা প্রয়োজন। প্রতিষেধক নেই, তাই এই রোগ বিস্তার বন্ধের সহজ পদ্ধতিগুলো চিহ্নিত করে গণমাধ্যমের সহযোগিতায় মানুষকে নিয়মিত জানিয়ে দিতে হবে।

গওহার নঈম ওয়ারা: ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মী