অন্যের জন্য কিছু করি

ইদানীং আমি নিয়মিত অন্যের জন্য কিছু করিনি বলে অপরাধবোধে ভুগছি। এখন মনে হচ্ছে, প্রতিদিন, প্রতি সপ্তাহে, অন্তত প্রতি মাসে আমার অন্যের জন্য কিছু করা উচিত ছিল।

পাঠক, আপনারা হয়তো বলবেন, আপনি সরকারে কাজ করেছেন, শিক্ষকতা করেছেন, এগুলো কি অন্যের জন্য কিছু করা নয়? না, আপনারা ভুল বলেননি, ঠিকই আছে; কিন্তু অন্যের জন্য কিছু করা এসব কাজের মূল প্রণোদনা ছিল না। আমি এসব কাজ করেছি নিজের জীবিকার জন্য, যাতে আমি পরিবারের ভরণপোষণ করতে পারি, ছেলে–মেয়ের পড়ার খরচ, পরিবারের স্বাস্থ্যসেবা, আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের আতিথেয়তার ব্যয় বহন করতে পারি। 

আপনারাও অামার সঙ্গে একমত হবেন যে আমাদের মতো বেশির ভাগ মানুষই সারা জীবন নিজেদের সন্তান, পরিবারের অন্য সদস্য, আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের জন্য ভেবে কাটিয়ে দিই। আমরা ভাবি, যা আয় করি, তা কেবল নিজেদের, আমাদের সন্তান, পরিবারের অন্যান্য সদস্য ও বন্ধুবান্ধবের জন্য। আমাদের সম্পদের ক্ষেত্রেও ঠিক তা-ই; কিন্তু এটা সত্যিই কি ঠিক? তবে কি বৃহত্তর সমাজের আমাদের আয় ও সম্পদের ওপর কোনোই দাবি নেই? আপনারা আবার বলতে পারেন, আমরা তো কর ও জাকাত দিই, ফলে অন্যরা উপকৃত হয়। সেটা ঠিক আছে, কিন্তু এখানে আমি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কোনো বিনিময় প্রত্যাশা না করে অপরিচিতজনের জন্য কিছু করার কথা বলছি। 

আমাদের সব আয় আমাদের নিজের, পরিবার ও বন্ধুবান্ধবের জন্য, ধারণাটি সঠিক নয়। কেন তা খুলে বলছি। ধরুন, আপনি একাকী একটি নির্জন দ্বীপে আছেন। এবার আপনি সম্পদ অর্জন করার চেষ্টা করুন। কোনোভাবেই তা অর্জন করা সম্ভব নয়। বৃহত্তর সমাজ ও অপরিচিত লোক আমাদের সৃষ্ট পণ্য ও সেবার চাহিদা সৃষ্টি করে এবং আমাদের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য ও সেবা সরবরাহ করে আমাদের আয়-উপার্জন ও সম্পদ সৃষ্টিতে সহায়তা করে থাকে। আমি কেবল অর্থ ও সম্পদের কথা বলছি না, আমাদের সময় ব্যবহারের কথাও বলছি। কতটা সময় আমরা অন্য মানুষের, অপরিচিত মানুষের কাজে ব্যয় করে থাকি? আয় ও সম্পদের মতো বৃহত্তর সমাজ ও অপরিচিতজনদের আমাদের সময়ের ওপর দাবি আছে, নয় কি? 

গত গ্রীষ্মে আমি ও আমার স্ত্রী দিলরুবা ওয়াশিংটন ডিসিতে ফ্যারাগাট ওয়েস্ট সাবওয়ে স্টেশনসংলগ্ন একটি প্রবীণ নিবাসে একজন আত্মীয়কে দেখতে যাই। খাওয়া, পরা, চিকিৎসা নিয়ে তাঁর কোনো অভিযোগ ছিল না। তবে একমাত্র অভিযোগ, প্রবীণ নিবাসের বাইরের কোনো লোকজনের সঙ্গে দেখা না হওয়া। এর একটিমাত্র ব্যতিক্রম ছিল। প্রতি মাসে ৪০ বছরের কাছাকাছি বয়সের এক অপরিচিত ককেশীয় যুবক সপ্তাহের ছুটির দিনে তাঁকে দেখতে আসেন, কথা বলেন, খবরাখবর নেন, দুপুর কিংবা রাতের খাবার খেতে, টুকিটাকি কাজ করতে বাইরে নিয়ে যান। তাঁকে নানাভাবে সাহায্য করেন। কোনো কারণে ছুটির দিনে অঙ্গরাজ্য বা দেশের বাইরে থাকলে বা অন্য কোনো কারণে তিনি না আসতে পারলে অন্য দিন এসে তা পুষিয়ে দেন। পরে একদিন টিভি দেখে আমার আত্মীয় জানতে পারেন, যুবকটি একটি কয়েক বিলিয়ন ডলারের যোগাযোগ কোম্পানির প্রধান নির্বাহী। শত দাপ্তরিক ও ব্যক্তিগত ব্যস্ততা সত্ত্বেও যুবকটি তাঁর অর্থ ও সময় একজন আগন্তুকের জন্য ব্যয় করে চলেছেন। 

দিলরুবা ও আমি অপরাধবোধ থেকে আমাদের খানিকটা জমি, ভবন, অর্থ ও সময় দিয়ে অন্যের জন্য কিছু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ধামরাইয়ের শৈলান গ্রামে পরিবার–পরিত্যক্ত ৫০ জন দুস্থ মানুষের জন্য একটি প্রবীণ নিবাস গড়ে তুলছি। যেখানে তাঁদের বিনা মূল্যে থাকা, আহার, পোশাক, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসুবিধা ও ওষুধ দেওয়া হবে, যাতে তাঁরা তাঁদের জীবনের শেষ বিকেলবেলা শান্তিতে ও আনন্দে অতিবাহিত করতে পারেন। উল্লেখ্য, এ নিবন্ধের শিরোনাম ‘অন্যের জন্য কিছু করি’ শৈলান প্রবীণ নিবাসের মূলমন্ত্র। 

আমরা সেখানে স্থানীয় স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের প্রবীণদের সঙ্গে সময় কাটাতে, তাঁদের সাহায্য করতে, তাঁদের জন্য গান গাইতে, নববর্ষ ও ঈদের শুভেচ্ছা কার্ড বানাতে, একসঙ্গে খাবার খেতে উদ্বুদ্ধ করব। যাতে শৈশব থেকেই তাদের মধ্যে অন্যের জন্য কিছু করার অভ্যাস গড়ে ওঠে। আমরা আমাদের চিকিৎসক বন্ধু ও আত্মীয়স্বজনকে তাঁদের সময় ও দক্ষতা দিয়ে নিবাসের বাসিন্দাদের কষ্ট লাঘব করার জন্য আহ্বান জানাব। আমাদের বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনের ছেলেমেয়েদের নিয়ে এসে তাঁদের সঙ্গে আহার ও অন্যান্য কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করে তাঁদের নিঃসঙ্গতা দূর করতে আমন্ত্রণ জানাব। 

আমি আপনাদেরও বলছি, আর দেরি না করে অন্যদের জন্য কাজে নেমে পড়ুন। আমাদের মতো দেরি করবেন না। আপনাদের অর্থ, সম্পদ ও সময়ের খানিকটা প্রতিদিন, প্রতি সপ্তাহে, অন্তত প্রতি মাসে অন্যদের জন্য কাজে লাগান। আমাদের প্রচেষ্টা প্রয়োজনের সিন্ধুতে এক ফোঁটা বারি মাত্র। শতকোটি মানুষ আপনার সাহায্যের পথ চেয়ে আছে—ক্ষুধা নিবারণ, আশ্রয়, চিকিৎসা, চলাফেরায় সহায়তার জন্য। তাঁদের অনেকেই ছেলেমেয়েদের পড়াতে, মেয়েদের বিয়ে দিতে পারছেন না, বেকারত্ব বা একাকিত্ব কাটাতে আপনার সহায়তা চান। প্রবীণ নিবাস ছাড়াও আরও অনেক কিছু করার আছে। উদাহরণস্বরূপ শিশু সেবাকেন্দ্রের কথা বলা যেতে পারে। আমাদের দরিদ্র নারীরা ঘরের বাইরে কাজ করছেন। ভালো কথা, কিন্তু তাঁদের ছেলেমেয়েদের কে দেখবে? আমাদের নানা ধরনের দক্ষতা ও সম্পদ আছে। আসুন, এ সৌভাগ্য, সম্পদ ও আমাদের সময়ের একটা অংশ প্রতিদিন, প্রতি সপ্তাহে, অন্তত প্রতি মাসে অন্যের জন্য ব্যয় করি। আমাদের দেখাদেখি আমাদের সন্তান ও তাদের সন্তানেরাও অন্যের জন্য কিছু করতে শিখবে। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সেটা কী দারুণ একটা উত্তরাধিকারই–না হবে!

মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সাবেক সচিব ও অধ্যাপক