বিগত বছরের নায়ক কে?
চন্দ্রশেখর আজাদ বাংলাদেশে সামান্যই পরিচিত। ‘আজাদ’ অর্থ মুক্ত। চন্দ্রশেখর আজাদ প্রকৃতই এক মুক্তির দর্শন নিয়ে হাজির দক্ষিণ এশিয়ায়। ওই রাজনৈতিক দর্শনের গোড়াপত্তন বাংলাদেশের বরিশালে, যোগেন মণ্ডলের হাতে।
আজাদের বয়স এখন ৩৪। ইতিমধ্যে অনেক বছর জেল খেটে ফেলেছেন। উত্তর প্রদেশের দলিত ‘ভিম আর্মি’র স্বঘোষিত প্রধান তিনি। ভিম আর্মি দলিত মুক্তির জন্য কাজ করছে। আজাদ মনে করছেন উচ্চবর্গের বিভেদবাদী রাজনীতি থেকে ‘মুক্তি’ আসতে পারে কেবল দলিত-মুসলমান-আদিবাসীদের ঐক্যের মাধ্যমে।
যোগেন মণ্ডলও একই কথা বলতেন ১৯৪৭-এ ভূখণ্ড ভাগাভাগির সময়। ধর্মের ভিত্তিতে নয়, মেরুকরণ চেয়েছিলেন আদর্শের ভিত্তিতে। যে আদর্শ বঞ্চনার অবসান ঘটায়, বহুত্ববাদকে নিরাপত্তা দেয়। এভাবেই যোগেন মণ্ডল-আম্বেদকরের ঐতিহাসিক মৈত্রী গড়ে উঠেছিল সেদিন। যে মৈত্রীর ফসল আম্বেদকরের ভারতীয় সংবিধান প্রণয়নের সুযোগ পাওয়া। সেই সংবিধান রক্ষার জন্যই আজ আবার একই আদর্শের আওয়াজ তুলেছেন ভারতের তরুণেরা।
চন্দ্রশেখর আজাদ এ মুহূর্তে ভারতীয় পুলিশের হেফাজতে। ২১ ডিসেম্বর দিল্লির জামে মসজিদ চত্বর থেকে আটক হন। আগের দিন শুক্রবার এই চত্বরেই তিনি ভারতের নতুন নাগরিকত্ব আইন ও সম্ভাব্য নাগরিকপঞ্জির বিরুদ্ধে বিক্ষোভের ডাক দিয়েছিলেন। বিপুল মানুষ জড়ো হয়েছিল সেখানে হিন্দু দলিত ও মুসলমানদের যৌথ প্রতিবাদে। সেখানে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে সভাস্থলে হাজির হয়ে চন্দ্রশেখর বলে ওঠেন, ‘আমার নাম আজাদ, আমরা বন্দী হব না।’
এ যেন এক রাজনৈতিক রেনেসাঁ
সমগ্র ভারতে অসাধারণ এক তরঙ্গ তুলে এই ‘আজাদ’ ও ‘আজাদি’র সুনামি চলছে এ মুহূর্তে। সাম্প্রতিক চিলি, লেবানন, হংকং, বাগদাদের পাশাপাশি ভারতীয় তারুণ্যের এই নবতরঙ্গ বিশ্বকে অবাক করেছে। এটা ঘটছে এমন এক দেশে, যেখানে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু নির্বাচনী গণতন্ত্রকে অতিক্রম করে আরও অধিক কিছু চাইছেন এই তরুণেরা। সাম্য, মৈত্রী ও সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য জীবনদানের ঝুঁকি নিচ্ছেন তাঁরা। ঐতিহাসিক ধর্মীয় বিভেদের তিক্ততা অতিক্রম করে হারাতে বসা বহুজনবাদী আদর্শবাদের নবজন্ম ঘটিয়েছে এই নবীন শক্তি।
১২০ কোটি মানুষের দেশে এই রাজনৈতিক রেনেসাঁর মূল্য বিপুল। ২০১৯-এর বৈশ্বিক নায়ক নিঃসন্দেহে এই আদর্শবাদ। এই আদর্শবাদী তরুণেরা প্রমাণ করছে ব্রিটেনে বরিস জনসনের বিজয়, যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পের আরেক দফা বিজয়ের প্রত্যাশা কিংবা বিশ্বজুড়ে ছোট ছোট জনসন ও ট্রাম্পদের দাপটের অসাধারণ এক ভবিষ্যতের গোড়াপত্তন ঘটাচ্ছেন ভারতের চন্দ্রশেখর ও কানহাইয়া কুমারেরা। এঁরা দেখাতে চাইছেন তরুণেরা একদিনের ‘ভোটার’ হয়ে বাঁচতে অনিচ্ছুক। ভোটের রাজনীতির বাইরেও তাঁদের বিস্তর কথা আছে। অনেক স্বপ্ন আছে। সেই স্বপ্নের প্রতীকী নাম ‘আজাদি’।
দলিত চন্দ্রশেখর আজাদের মতোই আজকের ভারতের আরেক নায়ক কানহাইয়া কুমার। ‘আজাদি’র স্লোগানের পুনর্জন্ম ঘটেছে কানহাইয়ার বাগ্মিতায়। গবেষক হিসেবে তিনি জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করেছেন ‘উপনিবেশিকতা থেকে আফ্রিকার উত্তরণ’ নিয়ে। অধ্যাপক হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এ মুহূর্তে পুরোদস্তুর এক রাজনীতিবিদ হয়ে গেছেন। বিহারে নির্বাচন করতে গিয়ে ৭০ লাখ রুপি গণচাঁদা তুলে দেখিয়েছেন ভারতজুড়ে আদর্শবাদী তরুণদের পারস্পরিক সংহতির গভীরতা। সেই সূত্রেই এখন ক্যাম্পাস থেকে ক্যাম্পাসে ঘুরছেন কানহাইয়া। নতুন এক ভবিষ্যতের পক্ষে তরুণ-তরুণীদের জাগরণ ঘটাচ্ছেন।
যদিও নাগরিকত্ব আইন ও নাগরিকপঞ্জি নিয়েই ভারতে চলতি বিক্ষোভ হচ্ছে। কিন্তু এটা সরাসরি রাজনৈতিক এক পালাবদলের স্মারক। যে পালাবদল নতুন ভবিষ্যতে প্রত্যাবর্তন করতে চাইছে। বুড়ো সমাজের জন্য যেটা অপরিহার্য। এটা কেবল বিজেপি বা আরএসএসকে আঘাত করছে না এবং কোনো পেশাগত দাবির জমায়েতও এটা নয়। চলতি অসন্তোষের সামাজিক তাৎপর্যের পরিসর আরও বড়। আরও ব্যাপক। কেবল নাগরিকত্ব আইন ও নাগরিকপঞ্জির কারিগরি আলাপ দিয়ে এই আন্দোলনকে বুঝতে যাওয়া খণ্ডিত হবে।
ওই তর্জনীর ভাষা যদি আমরা বুঝে থাকি
বিশ্বের জনসংখ্যার ১৮ ভাগ রয়েছে ভারতে। বিপুল সেই জনসংখ্যার তিন ভাগের দুই ভাগের বয়স ৩৫-এর নিচে। ভোটে যাঁরা ‘নির্বাচিত’ হচ্ছেন তাঁদের বয়স গড়ে ৫৫-এর মতো। ৮০ কোটি ভারতীয় এখন ৩৫-এর কম বয়সী হলেও লোকসভায় মাত্র ১-২ ভাগ এমপি ওই বয়সী। নেতা ও জনতার বয়সের এই বিপুল ব্যবধানে লুকিয়ে আছে বিপুল রাজনৈতিক পার্থক্য। সিএএ ও এনআরসি-বিরোধী বিক্ষোভের উৎস রয়েছে ওই পার্থক্যের গভীরেও। বিক্ষোভকারীদের বড় সমস্যা,Ñতাঁদের দলীয় পরিচয় নেই। তাঁদের পাশে আম্বানি-টাটা কেউ নেই। তাঁরা রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ। কিন্তু তাঁরা প্রথাগত নেতৃত্বের চাইতে অনেক উদ্দীপনাময়, সৃজনশীল, নৈতিকভাবে শক্তিশালী, পরিশ্রমী এবং রাজনৈতিকভাবে সচেতন। মিছিল-সমাবেশগুলোতে বিপুল সংখ্যায় ছাত্রীদের দেখা যাচ্ছে সাহসের সঙ্গে সামনের সারিতে লাঠির বিপরীতে তর্জনী উঁচিয়ে দাঁড়াচ্ছেন। নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে সমাজের দমবন্ধ অবস্থার পরিবর্তন যেন তাঁর জন্যই বেশি জরুরি।
রাজপথে বয়ে চলা ‘দলহীন’ অগণন ভারতীয় তারুণ্যের চলতি পদযাত্রায় সেখানকার সব বিরোধী দলেরও উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ রয়েছে। কারণ ওই ‘বিরোধী দল’ও আদর্শিকভাবে বুড়ো হয়ে গেছে। সাম্য ও মৈত্রীর প্রশ্নে তাদের আছে দোদুল্যমানতা, আছে ক্ষমতার মোহ—ভোটের হিসাব-নিকাশ। কিন্তু তারুণ্য চাইছে পরিবর্তন। এই পরিবর্তন পরিবারতন্ত্র ও সামন্ততন্ত্র থেকে; দলীয় শৃঙ্খলা নামক কর্তৃত্ববাদ থেকে। রাজনৈতিক আমলাতন্ত্র থেকেও। নেতৃত্ব ও জনপ্রতিনিধিত্বের বংশানুক্রমিকতার আবেদন ফিকে হয়ে যাচ্ছে নবীনদের কাছে। দশকের পর দশক গুটিকয়েক পরিবার উপমহাদেশ শাসন করলেও স্বাধীনতা-সাম্য-সামাজিক ন্যায়বিচার নয়, তারা ভোটার বাড়াতে চেয়েছে ধর্ম, বর্ণ কিংবা জাতিবাদী শ্রেষ্ঠত্বের মিথকে ব্যবহার করে। এভাবে রাজনীতিকে নোংরা যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করা হয়েছে। তরুণদের আদর্শবাদ আবার রাজনীতিকে স্বাস্থ্যকর এক ইমেজ দিতে চাইছে। কেবল ভারতেই নয়, পাকিস্তানেও মনজুর পাশতিনসহ অনেক তরুণকে এ রকম আদর্শবাদী রাজনীতি নিয়ে একের পর এক লংমার্চ করতে দেখেছি আমরা বছরের শুরুতে।
অনেক ধরনের আদর্শ নিয়ে এই তারুণ্য একত্র হচ্ছে। এর সংকীর্ণ বা কোনো একক চরিত্র নেই। তবে অসুস্থ বর্তমানের চিকিৎসা হিসেবে তাঁরা রাজনীতি থেকে গোষ্ঠীতন্ত্র, বর্ণবাদ, ধর্মীয় বিভাজন, কর্তৃত্ববাদ ও পরিবারতন্ত্র সরাতে চাইছেন। এঁরা সবাই ‘অ্যাকসিডেন্টাল পলিটিশিয়ান’। এরা সবাই সামাজিক অসাম্য দেখতে দেখতে ক্লান্ত। কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধির জয়ধ্বনিতে তাঁরা বিরক্ত।
উপমহাদেশের রাজনৈতিক এই নবতরঙ্গের বৈশ্বিক তাৎপর্যও কম নয়। তবে এসব জন-আন্দোলন দলীয় পরিচয়হীন সাংগঠনিক মূর্তি নিয়ে কতটা দীর্ঘস্থায়ী হবে, সেটা দেখার বিষয়। লাঠির বর্বরতা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু ইতিমধ্যে তারা বিগত বছরের নায়কে পরিণত হয়েছে। ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ হলে এরা ভবিষ্যতে কীভাবে জড়ো হবেন, সেটা অনিশ্চিত। বিগত শতাব্দীর ষাট ও সত্তরের দশকের পর এ বছরই কেবল বিশ্বজুড়ে তারুণ্যের এত বড় আদর্শবাদী জাগরণ দেখা গেল। বাংলাদেশে রাজনৈতিক নিস্তব্ধতার মাঝেই বুয়েটে আবরার হত্যার প্রতিবাদে দেশব্যাপী অদলীয় এক ছাত্র জাগরণ দেখেছিল বাংলাদেশ কিছুদিন আগে। যে স্ফুলিঙ্গ শিক্ষাঙ্গন থেকে কর্তৃত্ববাদের অবসান চাইছিল।
তরুণদের এই আদর্শবাদী পুনর্জাগরণকে দেশে-দেশে রাজনৈতিক দলগুলো কীভাবে মোকাবিলা ও ধারণ করবে, তার ওপরই এসব দেশের তথাকথিত স্থিতিশীলতা অনেকখানি নির্ভর করবে। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু ভবনে যেভাবে আলো নিভিয়ে ছাত্র প্রতিনিধিদের পেটানো হয়েছে, সেটা নিশ্চয়ই এই আদর্শবাদকে দীর্ঘ মেয়াদে থামাতে পারবে না। ভারতের চন্দ্রশেখর আজাদ, কানহাহিয়া কুমার থেকে পাকিস্তানের মনজুর পাশতিন ও বাংলাদেশের নুরুল হক নুর পর্যন্ত সব আলোচিত মুখ একটা পালাবদলের কথা জানাচ্ছে আমাদের। কোথা থেকে এই পালাবদলের যাত্রা, সেটা আমরা জানি। কিন্তু তরুণেরা কোথায় পৌঁছাবেন সেটা কেউই জানে না। তবে ইতিহাস সাক্ষী, দক্ষিণ এশিয়ায় সব বড় পালাবদলের শুরু রাজনীতিমনস্ক তরুণ-তরুণীদের হাতেই ঘটেছে। এই পালাবদল বাংলাদেশেই বোধ হয় জরুরি। জরিপ জানাচ্ছে (২৩ ডি., প্রথম আলো), ‘প্রতি পাঁচ তরুণের চারজনই এখানে জীবনের লক্ষ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন’ এ মুহূর্তে। আদর্শবাদী জাগরণ ছাড়া এই উদ্বেগের কালো মেঘ সরাতে কে পারবে?
আলতাফ পারভেজ: গবেষক