ঢাকার দুই সিটি: রাতের ভোট ও দিনের ভোট

তফসিল ঘোষণার আগে থেকে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে জল্পনা চলছিল। তফসিল ঘোষণার পর সেই জল্পনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শঙ্কা। এবার সত্যি সত্যি ভোট হবে, না আগের মতো? নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা বরিশাল, খুলনা ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনের পুনরাবৃত্তি চান না। তিনি বরিশালের দায়িত্বে ছিলেন। আর বাকি দুটিতে অন্যদের সঙ্গে সহদায়িত্ব পালন করেছেন। এ কারণেই হয়তো তাঁর মনোবেদনাটা বেশি।

ঢাকার দুই সিটির আগের নির্বাচনটি হয়েছিল ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। নির্বাচনের আগে বিএনপির লাগাতার অবরোধ কর্মসূচি চলছিল। সেই কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী জ্বালাও-পোড়াওয়ের ঘটনা ঘটে। অনেক মানুষ মারা যায়। তখনো বিএনপি রাজপথে ছিল। এখন বিএনপি রাজপথে নেই। দলীয় চেয়ারপারসন জেলে। তারপরও বিএনপি সিটি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। আশা করা যায়, শীতের ঠান্ডা সত্ত্বেও নির্বাচনী হাওয়া গরম হবে। তবে সেই গরম হাওয়া সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা দেবে কি না, বলা কঠিন।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হেরে গেলে মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়বে না। এটি যদি তাঁর মনের কথা এবং সরকারি দলের মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ হয় হয়, দেশবাসী স্বাগত জানাবে। বাংলাদেশের মানুষ বহুদিন সুষ্ঠু নির্বাচন থেকে বঞ্চিত। আগে নির্বাচন ছিল উৎসব। এখন নির্বাচন মানে আতঙ্ক।

অর্থনীতিতে আমাদের অনেক অর্জন আছে। বাংলাদেশ এখন আর তলাবিহীন ঝুড়ি নয়। স্বল্পোন্নত দেশের বৃত্ত ছাড়িয়ে উন্নয়নশীল দেশের পথে এগোচ্ছি। আমাদের গড় আয়ু ও গড় আয় দুটোই বেড়েছে। কিন্তু রাজনীতি ও গণতন্ত্রের সূচক ক্রমেই নিচে নামছে। আমরা গণতান্ত্রিক শাসনের দাবি করি, কিন্তু একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারি না। নির্বাচনী প্রতিষ্ঠান ও প্রক্রিয়া ধ্বংসের কিনারে এসে ঠেকেছে। গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর যে জাতীয় নির্বাচন হলো, তা আইনত সিদ্ধ হলেও নৈতিকতার বিচারে পাস করতে পারেনি।

শুধু কি জাতীয় নির্বাচন? এর আগে ও পরের প্রায় সব নির্বাচনই প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত। এ কারণেই মাহবুব তালুকদার সিটি নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচন কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ কর্মশালায় বলেছেন, ‘আমরা বরিশাল, খুলনা ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনের পুনরাবৃত্তি দেখতে চাই না।’ তাঁর ভাষায়, এই কমিশনের অধীনে ৭টি সিটি করপোরেশন নির্বাচন হয়েছে। এর মধ্যে কুমিল্লা ও রংপুর নিয়ে কোনো বিতর্ক হয়নি। সিলেটও উতরে গেছে। কিন্তু খুলনা, বরিশাল ও গাজীপুরের নির্বাচন পুরো নির্বাচনী ব্যবস্থাকে কলঙ্কিত করেছে।

নির্বাচনের পর আর কেউ জিজ্ঞেস করেন না, ‘আপনার ভোট দিয়েছেন কি না।’ জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনার ভোটটি রাতে হয়েছে, না দিনে।’ দিনের ভোটের জন্য নির্বাচন কমিশনের দরকার হয়। রাতের ভোটের জন্য নির্বাচন কমিশনের দরকার হয় না। সে ক্ষেত্রে এই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটির প্রয়োজন আছে কি না, সেটাও বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কমিশন জানিয়েছে, ৩০ জানুয়ারি ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হবে এবং এবার সব কেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহার করা হবে। ইভিএম নিয়ে বিএনপির আপত্তি আছে। তবে আপত্তিটা মেশিন নিয়ে যতটা না, তার চেয়ে বেশি মেশিন চালানোর মানুষ নিয়ে। বিভিন্ন মহলের প্রতিবাদ উপেক্ষা করে গত জাতীয় নির্বাচনে অনেকটা জোর করেই ইভিএম চালু করেছিল ইসি। এবারে তারা সব কেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহারের কথা বলছে। ইভিএম ব্যবহার দোষের কিছু নয়। কিন্তু ইভিএম-এ যে ভোট কারচুপি হবে না, তার নিশ্চয়তা কী। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে ইসি সেই নিশ্চয়তা দিতে পারেনি।

নির্বাচনী কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ কর্মশালায় মাহবুব তালুকদার আরও বলেছেন, ‘...পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তিনটির বিষয়ে আমি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলাম। বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আমি এককভাবে দায়িত্ব পালন করি এবং গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন ও খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচন সম্পর্কে আমি প্রতিবেদন তৈরি করতে গিয়ে এই তিনটি নির্বাচনের স্বরূপ সন্ধান করি। কিন্তু এই তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনের অভিজ্ঞতা আমার কাছে মোটেই সুখকর নয়। আসন্ন ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে বিগত ওই তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি দেখতে চাই না।’

নির্বাচন কমিশনের বাইরের কেউ এ ধরনের কথা বললে আমরা ‘বাতকি বাত’ ধরে নিতাম। কিন্তু কথাটি বলেছেন একজন কমিশনার। যিনি পাঁচ সদস্যের নির্বাচন কমিশনারের একজন। আর নির্বাচন কমিশনেরই দায়িত্ব নাগরিকদের ভোটাধিকার রক্ষা করা। ভোটাধিকার রক্ষা মানে তাঁরা নির্বিঘ্নে কেন্দ্রে গিয়ে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে নিরাপদে বাড়ি ফিরে যেতে পারবেন। কেউ বাধা দেবে না। হাঙ্গামা করবে না। কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন সেই কাজটি শুরু থেকে করতে ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি নির্বাচনে ‘পুকুর চুরি’ হওয়ার পরও তাঁরা নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে বলে গীত গেয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, বিরোধী দলের প্রার্থীর এজেন্ট কেন্দ্রে না এলে কিছু করণীয় নেই। কিন্তু কেন ওই এজেন্টরা কেন্দ্র যেতে পারেন না, কারা এজেন্টদের গাড়িতে তুলে নিয়ে নির্বাচনী এলাকার বাইরে রেখে আসেন, সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজেন না। কাউকে জিজ্ঞাসা করার মুরোদ রাখেন না। নির্বাচন কমিশন চোখের সামনে যা ঘটে, তা দেখতে পায় না। যা তাদের দেখানো হয় সেটাই দেখতে অতি উৎসাহ দেখায়।

এই বাস্তবতায় যখন একজন নির্বাচন কমিশনার বলেন, ‘ঢাকা সিটি নির্বাচনে বরিশাল, খুলনা ও গাজীপুরের পুনরাবৃত্তি দেখতে চাই না’, তখন তাঁকে সাধুবাদ জানাতে হয়। তবে তিনি যেই সাংবিধানিক পদে আছেন, সেখানে বসে শুধু ‘পুনরাবৃত্তি দেখতে চাই না ’ বললেই তাঁর দায়িত্ব ও কর্তব্য শেষ হয়ে যায় না। নির্বাচন কমিশনার হিসেবে তাঁর দায়িত্ব সুষ্ঠু নির্বাচন করা।

সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অনিয়ম কারচুপি শুধু নূরুল হুদা কমিশনের আমলেই হয়নি; এর আগে কাজী রকিবউদ্দীনের নেতৃত্বে গঠিত কমিশন ঢাকার দুই ও চট্টগ্রামে নির্বাচনের নামে মহা কেলেঙ্কারি করেছিল। ভোটাররা কেন্দ্রে যাওয়ার আগেই তাঁদের ভোট দেওয়া হয়ে গিয়েছিল। আমাদের নির্বাচন কমিশনগুলো সুষ্ঠু নির্বাচন না দিতে পারলেও কারচুপির নির্বাচনের নতুন নতুন মডেল উপহার দিয়েছে।

নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার হয়তো বিবেকতাড়িত হয়ে কিছু সত্য কথা বলেছেন। কিন্তু তাতে নির্বাচন কমিশনের চরিত্র বদলাবে বলে মনে হয় না। তিনি যেদিন সুষ্ঠু নির্বাচন করার জন্য নির্বাচনী কর্মকর্তাদের সদুপদেশ দিলেন, তার এক দিন পর আরেকজন কমিশনার বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে আনা মামলা প্রসঙ্গে বলেছেন, কারও বিরুদ্ধে আগের ফৌজদারি মামলা থাকলে তাঁদের কিছু করার নেই। আইন নিজের গতিতে চলবে। কিন্তু আইন নিজের গতিতে চললে তো ভোটকেন্দ্রে বিশেষ প্রার্থীর সমর্থকেরা ‘ভোট সন্ত্রাস’ করতে পারতেন না। আইন নিজের গতিতে চললে নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরোধী দলের শত শত নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে গায়েবি মামলা হতে পারত না। আইন নিজের গতিতে চললে দিনের ভোট রাতেই সম্পন্ন হতে পারত না।

সুষ্ঠু নির্বাচনের পূর্বশর্ত ভয়মুক্ত পরিবেশ ও সব দল ও প্রার্থীর জন্য মাঠ সমতল করা। কে এম নূরুল হুদার কমিশন আগের নির্বাচনগুলোতে সেই কাজটি করতে পারেনি। এবারে পারবেন কি?

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]