'দুখী মানুষের মুখে হাসি' নববর্ষের অঙ্গীকার

পঞ্চাশের মন্বন্তরের একটা ভয়াবহ ছবি আমরা পাই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা গল্প ‌‘দুঃশাসনীয়’তে। হাতিপুর নামের একটি গ্রাম, যার অধিবাসীর অধিকাংশই মারা গেছে দুর্ভিক্ষে। সেখানে দিনের বেলা কোনো নারী ঘর থেকে বেরোতে পারে না। তারা ঘর থেকে বের হয় রাতে, ছায়ামূর্তির মতো, ডোবাপুকুরে বাসন মাজে, ঘাট থেকে কলসি কাঁখে পানি নিয়ে ফেরে। তারা দিনে বের হতে পারে না কারণ, কারও পরনে কাপড় নেই। ‘কোনো ছায়ার গায়ে লটকানো থাকে একফালি ন্যাকড়া, কোনো ছায়ার কোমরে জড়ানো থাকে পাতার সেলাই করা ঘাঘরা, কোনো ছায়াকে ঘিরে থাকে শুধু সীমাহীন রাত্রির আবছা আঁধার।’ এই গল্প পড়ে স্তব্ধ হয়ে থাকি। মনকে সান্ত্বনা দিই, এখন ১৪২৬ সাল। ১৩৫০ সালের কাহিনি, মানে প্রায় পৌনে এক শ বছর আগের কথা। এখন আর এই দারিদ্র্য নেই বাংলাদেশের গ্রামে।

ডা. রশিদ-ই-মাহবুব বিএমএর সাবেক সভাপতি। তাঁর সঙ্গে দেখা হলো মুন্সিগঞ্জে, অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশনের কৃতী শিক্ষার্থী সংবর্ধনার অনুষ্ঠানে। তিনি গল্প করছিলেন। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮০ সালে তিনি ছিলেন রংপুরে। বললেন, ‘শোনেন, আপনাদের রংপুরের ঘটনা। এক লোক তাঁর বউকে নিয়ে এসেছেন হাসপাতালে। বউটা মরে গেছেন। তখন লোকটা মরা বউয়ের শাড়ি খুলে নিয়ে পালিয়ে যেতে থাকেন। লোকজন তাঁকে ধরে ফেলে। লোকটা বলেন, তাঁর ঘরে মেয়ে আছে, সেই মেয়ের কোনো কাপড় নেই, বউ তো মারা গেছেন, তাঁর তো আর শাড়ি লাগবে না। এই শাড়ি তিনি মেয়ের জন্য নিয়ে যাচ্ছেন।’

এই গল্প শুনেও কেঁপে উঠি। তারপর আবার সান্ত্বনা দিই নিজেকে, এটাও আজ থেকে ৪৩ বছর আগের ঘটনা। এত দিনে রংপুর অঞ্চলের মঙ্গা দূর হয়ে গেছে। দেশের সব মানুষ এখন খেতে পায়, সব মানুষ এখন কাপড় পরে, পায়ে একটা কিছু জুতা–স্যান্ডেল আছে।

কিন্তু পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপের ফল সেই সান্ত্বনাকে যেন এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিতে চায়। সারা দেশে দারিদ্র্য কমছে, কিন্তু দেশের ২৩টি জেলায় দারিদ্র্যের হার উল্টো বেড়ে গেছে। দেশের সবচেয়ে গরিব ১০টি জেলা হলো কুড়িগ্রাম, রংপুর, দিনাজপুর, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, জামালপুর, কিশোরগঞ্জ ও মাগুরা।

কুড়িগ্রামে ২০১০ সালে গরিব মানুষ ছিল শতকরা ৬৩ দশমিক ৭১, ২০১৬ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৭০ দশমিক ৮। দিনাজপুরের অবনতি স্তম্ভিত করে দেওয়ার মতো, ৩৭ দশমিক ৩ থেকে দারিদ্র্য এখন ৬৪ দশমিক ৩। বলা হচ্ছে, কুড়িগ্রামে প্রায় ৩০ ভাগ মানুষ তিন বেলা ঠিকমতো খাবার পায় না। 

দেশে প্রবৃদ্ধি ৬ ভাগের বেশি, এই প্রবৃদ্ধি দারিদ্র্য কমাবে, এই ছিল কথা। কিন্তু ২৩ জেলায় দারিদ্র্য বেড়ে গেল কেন? অর্থনীতিবিদেরা ফাঁপরে পড়েছেন, তাঁরা এই নিয়ে গবেষণা করছেন, কথা বলতে শুরু করেছেন। খবরের কাগজে পড়লাম, ড. বিনায়ক সেন প্রবৃদ্ধির উচ্চহার সত্ত্বেও দারিদ্র্য বৃদ্ধির কারণ হিসেবে আয়ের বৈষম্যকেই দায়ী করেছেন।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর এই জরিপই বলছে, ‘যেমন দেশের সব মানুষের মোট আয়ের ৩৮ শতাংশই করে ওপরের দিকে থাকা ১০ শতাংশ ধনী মানুষ। ছয় বছর আগে তাদের আয়ের পরিমাণ ছিল মোট আয়ের ৩৫ শতাংশের মতো। অন্যদিকে এখন মোট আয়ের মাত্র ১ শতাংশের সমান আয় করে সবচেয়ে গরিব ১০ শতাংশ মানুষ। ছয় বছর আগেও এর পরিমাণ ছিল মোট আয়ের ২ শতাংশ।’ (প্রথম আলো, ৩০ মে ২০১৮)।

‌গরিব আর ধনীর মধ্যে পার্থক্য যে ক্রমে বাড়ছে, ভীষণ রকমভাবে বাড়ছে, তা আমরা খালি চোখেই দেখতে পাই। কারও কারও কত যে টাকা হয়েছে, তাঁরা টাকা দিয়ে কী করবেন, বুঝতে পারছেন না। বিদেশে টাকা পাচার হচ্ছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি প্রকাশিত তথ্য, ২০১৫ সালে বাণিজ্যে কারসাজির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ছয় বিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। এটা এক বছরে বাংলাদেশে আসা বিদেশি সাহায্যের তিন গুণ।

আর আছে অপচয়। যাঁদের টাকা বালিশের ভেতর রাখতে হয়, তাঁদের ছেলেমেয়েদের বিয়েতে এখন ছয়–সাতটা অনুষ্ঠান হয়। কত ভালোই না হতো, যদি এই টাকা দেশে বিনিয়োগ করা হতো। শিল্প-কলকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্যে বিনিয়োগ হতো!

আমাদের অধিকাংশ বড়লোক লুটেরা বড়লোক। কেউ কেউ আত্মসাৎ করেছেন ব্যাংকের টাকা, ঋণ নিয়েছেন আর ফেরত দেননি। তাই সেই টাকা বিনিয়োগ করে লাভ তুলে আনার দিকে তাঁদের মনোযোগ নেই। কেউ কেউ করেছেন দুর্নীতি। বালিশ–কাণ্ড তার সামান্য উদাহরণ। এই সব টাকা শিল্পে, কলকারখানায়, ব্যবসা-বাণিজ্যে বিনিয়োগ হয় না। পাচার হয়, নয়তো বিলাস-ব্যসনে ব্যয় হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘টাকা বানানো একটা রোগ, অসুস্থতা। এ রোগে একবার আক্রান্ত হলে শুধু বানাতেই ইচ্ছে করে।’ 

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে। জনগণের অর্থ ভোগ-বিলাসে ব্যয় হবে না। জনগণের অর্থ জনগণের জন্য ব্যয় হবে। কেউ বিলাসবহুল জীবনযাপন করবে, ভোগ-বিলাস করবে আর সৎ মানুষ সরল জীবন যাপন করে কষ্ট পাবে—তা হবে না।’ (প্রথম আলো, ৩০ নভেম্বর ২০১৯)।

এসব অসৎ মানুষের অসৎ আয়ের প্রবৃদ্ধি আমাদের গরিব মানুষকে আরও গরিব করছে, বড়লোককে আরও বড়লোক করছে। এ থেকে সমাধানের পথও আমাদের জানা—ব্যাংক লুট বন্ধ করতে হবে, বিদেশে টাকা পাচার বন্ধ করতে হবে, দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। বিনায়ক সেন যেমনটা বলেন, ‘সরকার সামাজিক সুরক্ষা খাতে প্রতিবছর যেভাবে বরাদ্দ বাড়াচ্ছে, তাতে দারিদ্র্য বিমোচন হবে না। এ সময় তিনি জিডিপির অনুপাতে কর আদায়ের হার বাড়ানোর পরামর্শ দেন।’ (কালের কণ্ঠ, ২৯ এপ্রিল ২০১৯) ধনীদের ওপরে কর বাড়াতে হবে, কর ফাঁকি, শুল্ক ফাঁকি বন্ধ করতে হবে।

অঞ্চলভিত্তিক দারিদ্র্য দূর করার জন্য বিশেষ ধরনের কর্মসূচি দরকার। কী করতে হবে, তা নিয়ে অনেক গবেষণাও আছে। কুড়িগ্রামের জন্য কী করতে হবে, তা কুড়িগ্রামবাসীর মুখস্থ। নারায়ণগঞ্জে দারিদ্র্যের হার ২ দশমিক ৬ আর কুড়িগ্রামে ৭০ দশমিক ৮। এ থেকেই বোঝা যায়, শিল্প-কলকারখানা ও বাণিজ্য ছাড়া দারিদ্র্য দূর হবে না। আর দিনাজপুরে গরিবি ছয় বছরে দ্বিগুণ হওয়ার কারণও হলো কেবল কৃষির ওপরে নির্ভরতা। কৃষিপণ্যের দাম নেই, কিন্তু উৎপাদন খরচ বেশি। কাজেই অনগ্রসর এলাকাগুলোয় শিল্পায়ন করতে হবে। স্থলবন্দর চালু করা, নদীবন্দর চালু করা, নেপাল-ভুটান এবং ভারতের উত্তর–পূর্ব রাজ্যগুলোয় রপ্তানি বৃদ্ধিতে এই স্থল ও নদীবন্দরগুলোকে চালু করতে পারলে অবস্থার নাটকীয় উন্নতি সম্ভব। সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক করে তুলে নেপাল-ভুটানের জন্য ব্যবহার করা গেলেও অবস্থার উন্নতি হওয়া সম্ভব। 

কী করতে হবে, তা স্থানীয় মানুষ জানে। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক গবেষকেরাও পথ বাতলে দিতে পারবেন। কিন্তু আসল কথা, এই বেদনা আমরা বুঝতে পারি কি না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সব সময় বলতেন বাংলার গরিব–দুখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর কথা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তাঁর প্রতিটি ভাষণে দেশের গরিব–দুখী সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।

সরকার শুধু বড়লোকদের জন্য নয়। রাষ্ট্র শুধু ধনী এবং নগরবাসীর জন্য নয়। দেশের প্রতিটি অঞ্চলের গরিব–দুখী সাধারণ মানুষের জন্য ভাবতে হবে, তাদের দোরগোড়ায় উন্নয়নকে নিয়ে যেতে হবে। প্রতিটি গ্রামকে উন্নয়নের একেকটা কেন্দ্র করে তুলতে হবে, প্রতিটি অঞ্চলের সমান উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে। শেখ হাসিনার নিজের চিন্তার মধ্যে গ্রাম একটা উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করে রাখে। এ নিয়ে তাঁর বইয়ে বিশেষ লেখা আছে।

কিন্তু ধনতন্ত্র একটা একচক্ষু মত্তহস্তী। তা সব মানবিকতা, সবটুকু সবুজ, আমাদের ধানখেত, নদী, বন, বাতাস, পানি—সবকিছুকে নষ্ট ধ্বংস করতে চায়। প্রধানমন্ত্রীর ভাষায়, ‘টাকা বানানো একটা রোগ, অসুস্থতা।’ এই রোগে যখন ধনিক শ্রেণি আক্রান্ত হয়, তখন নিয়মকানুন সবকিছুই তারা ভেঙেচুরে একাকার করতে চায়।

প্রবল রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়া এই সর্বনাশা রোগের প্রকোপ থেকে মানুষ আর প্রকৃতিকে বাঁচানো যাবে না।

বৈষম্য দূর করাই হোক ২০২০ সালের নববর্ষের অঙ্গীকার—নিউ ইয়ারস রেজল্যুশন।

আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক