ভুয়া হলফনামায় বাল্যবিবাহ

সেই কবে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন বলেছিলেন, ‘বর দুর্লভ হইয়াছে বলিয়া কন্যাদায় এ কাঁদিয়া মরি কেন? কন্যাগুলিকে সুশিক্ষিতা করিয়া কার্যক্ষেত্রে ছাড়িয়া দাও, নিজের অন্ন-বস্ত্র উপার্জন করুক।...আমরা সমাজেরই অর্ধ অঙ্গ। আমরা পড়িয়া থাকিলে সমাজ উঠিবে কীরূপে?’

আক্ষেপের বিষয়, বেগম রোকেয়ার সেই আক্ষেপ এখনো আমাদের বহন করতে হচ্ছে। যাদের মন-শরীর কিছুই তৈরি হয়নি, তাকে বাল্যবিবাহের যূপকাষ্ঠে বলি দেওয়া হচ্ছে এই একবিংশ শতাব্দীতেও।

এই অনাচার বন্ধে আইন হয়েছে; কিন্তু দুর্ভাগ্য, আইন সম্পর্কে অধিকাংশের ভাবনা এই যে, আইন যদি নিজের সুবিধার্থে হয়, তাহলে মানব, না হলে ফাঁকি দেব। বাল্যবিবাহ বন্ধের আইনেও তাই ফাঁকফোকর খোঁজা হচ্ছে। ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ে নিষিদ্ধ করায় এখন অ্যাফিডেভিটের মাধ্যমে কাগজে–কলমে নাবালিকার বয়স বাড়িয়ে নেওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।

প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, ময়মনসিংহের নান্দাইলে জন্মনিবন্ধনের ভুয়া সনদ ব্যবহারের পাশাপাশি নোটারি পাবলিকের হলফনামা ব্যবহার করে বাল্যবিবাহের আয়োজন করা হচ্ছে। নোটারি পাবলিকের হলফনামা ব্যবহার করে স্কুলপড়ুয়া শিশুদের বিয়ের আয়োজন চলছে। এ ধরনের একাধিক বিয়ে অনুষ্ঠিত হলেও প্রশাসন তা ঠেকাতে পারেনি।

জন্মসনদে ঘষামাজা করে বয়স বাড়ানোর ঘটনাও ধরা পড়েছে। কোনো কাজি (নিকাহ নিবন্ধক) যখন এই ধরনের বিয়ে পড়াতে চান না, তখন কোনো নিবন্ধন ছাড়াই ‘কবুল’ এবং দোয়ার মাধ্যমে বিয়ে সম্পন্ন করা হচ্ছে। ভুয়া জন্মসনদ ও বিতর্কিত হলফনামার মাধ্যমে বাল্যবিবাহের ঘটনা শুধু যে নান্দাইলেই ঘটছে তা নয়, সারা দেশেই কমবেশি এই ধরনের বিয়ে হচ্ছে।

এই বেআইনি কার্যক্রম বন্ধে এগিয়ে আসতে হবে প্রশাসনকেই। বিশেষ করে যাঁরা ভুয়া জন্মসনদ ও মিথ্যা তথ্যকে নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে সত্য বানিয়ে বাল্যবিবাহের আয়োজনে জড়িত, তাঁদের সবার বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতেই হবে। দণ্ড না দিয়ে শুধু ধূমপানের কুফল বর্ণনা করে জনসমক্ষে ধূমপান যেমন ঠেকানো যাবে না, তেমনি কঠোর সাজা ছাড়া বাল্যবিবাহের আয়োজন বন্ধ করা যাবে না। পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতামূলক প্রচার চালিয়ে যেতেই হবে।

আজও সমাজের নানা স্তরে মেয়েদের জীবনে বিয়ে নামক বিষয়টিকে যে কারণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে ধরে নেওয়া হয়, তা হলো ‘কন্যাদায়’। এ কারণেই বিয়ে ঠেকাতে গিয়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রশাসনকে অভিভাবকদের কাছ থেকে যে যুক্তি শুনতে হয় তা হলো, ‘ভালো পাত্র’ হাতছাড়া করতে চাননি। যেন জগতের সর্বশেষ ‘ভালো পাত্রটি’ই তাঁদের বাড়ির মেয়ের জন্য পড়ে আছে। আবার অনেক অভিভাবক বাল্য বয়সে মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার কারণ হিসেবে নিরাপত্তাহীনতার অজুহাত তোলেন। কিন্তু তাঁরা একবারও ভেবে দেখেন এ অবস্থায় মেয়েটিকে আরও বেশি অনিরাপদ অবস্থানে ঠেলে দেওয়া হলো।

এই মানসিকতা থেকে ‘কন্যাদায়গ্রস্ত’ পিতা-মাতাকে বের করে আনতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।