ক্ষমতাঘেঁষা নয়, স্বাধীন শিক্ষক সমিতি চাই

এবারের ডিসেম্বর বেশ শীত সঙ্গে করেই চলছে। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা আছেন নির্বাচনী আমেজে। শীতকে খুব একটা আশকারা না দিয়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি নির্বাচনের প্রার্থীরা নীল-সাদা রঙের কাগজে নিজেদের প্যানেলের তালিকা নিয়ে ভোট চাইছেন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ-সমর্থিত শিক্ষকদের নীল দল এবং বিএনপি ও জামায়াতপন্থী শিক্ষকদের সাদা দল। দলগত প্রচারণার বাইরে ব্যক্তিগতভাবে ভোট চাওয়াও চলছে। ভোটাররা প্রার্থীদের বিনয়ী হাসিমুখের সালামের বিনিময়ে মাথা নাড়ছেন, শীত কিংবা চা-কফিতে চুমুক দেওয়ার পাশাপাশি প্রার্থীদের নিয়ে আলাপ পাড়ছেন, প্রার্থীদের সঙ্গে কখনো হাসিঠাট্টা করছেন। ফোনের স্ক্রিনে কিছুক্ষণ পরপর ভেসে আসছে ভোট প্রদানের বিনীত অনুরোধ সংবলিত বার্তা, বিনয়ে মোড়ানো নানা বাক্য। এর সঙ্গে আছে ফোন এবং ই-মেইলে ভোট চাওয়া।

আগামীকাল ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় নির্বাচন—শিক্ষক সমিতি নির্বাচন। প্রতিবছর ডিসেম্বর মাসে শিক্ষকদের ট্রেড ইউনিয়ন খ্যাত এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এক বছরের জন্য নির্বাচিত হন শিক্ষক নেতৃত্ব। কয়েক বছর আগপর্যন্ত এটিই ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন। কারণ, শিক্ষক সমিতি শিক্ষকদের দাবিদাওয়া পেশের পাটাতন। শিক্ষক সমিতিই ছিল ‘সাধারণ’ শিক্ষকদের আঁকড়ে থাকা জমিন, শিক্ষকেরা এটিকে তাঁদের শক্তি মনে করতেন; যদিও এটি সেই তেজস্বী চরিত্র ও ঋজুতা অনেক আগেই হারিয়ে গেছে। তবে আদর্শিকভাবে শিক্ষক সমিতির কাজ ট্রেই ইউনিয়নের হলেও এই সময়ে এসে এটি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের বি টিম হিসেবে কাজ করছে।

দুই বছর ধরে এই নির্বাচন নীল ও সাদা দলের মধ্যেই সীমিত থাকছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে আওয়ামী, বিএনপি সমর্থনের বাইরে বাম ঘরানার অনেক ‘পাবলিক তারকা’ শিক্ষকের গোলাপি দল এবারও নেই নির্বাচনী মাঠে। বছর কয়েক আগেও কয়েক দফা নীলের সঙ্গে থেকে নির্বাচন করেছে গোলাপি দল। তবে সেখানেও মন-মতের নানা পার্থক্য দেখা দেয়। ফলাফল, গোলাপি এখন আর নেই নির্বাচনে।

বর্তমানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দুঃসময়ে সবচেয়ে বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারত যে পাটাতন, সেটি শিক্ষক সমিতি। কিন্তু বেশ কয়েক বছর থেকেই প্রশাসনের বিভিন্ন পদে থাকা বিভিন্ন শিক্ষকই হচ্ছেন শিক্ষক সমিতির নেতা। একই শিক্ষকেরা বিভিন্ন পদে থাকছেন, তাঁদের রাখা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ কাঠামো হলো সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেটের কোনো সদস্য যদি শিক্ষক সমিতির নেতা থাকেন, তাহলে দেনদরবারগুলো কে কার সঙ্গে করবেন? শিক্ষক সমিতির এবারের নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ-সমর্থিত শিক্ষকদের প্যানেল নীল দল থেকে মোট ১৫ জন প্রার্থীর মধ্যে ৫ জন আছেন বিভিন্ন হলের প্রাধ্যক্ষ এবং রয়েছেন ৪ জন নির্বাচিত ডিন। এই ৯ জনের মধ্যে কেউ কেউ সিনেট এবং সিন্ডিকেট সদস্যও। সাদা দলের প্রার্থীরাও বেশির ভাগই বিএনপির সময়ের নির্বাচিত ডিন, প্রাধ্যক্ষ, সিন্ডিকেট ও সিনেট সদস্য। দুই দলের মনস্কতা একই। একই শিক্ষক যদি একাধিক পদে থাকেন, তাহলে কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা পাবে? স্বাভাবিকভাবেই কোনো না কোনো কাঠামো অকার্যকর হয়ে পড়বে।

আর এসব কারণেই এখন শিক্ষক সমিতির নেতাদের ‘বিবৃতি’ দেওয়াও নির্ভর করে প্রশাসনের সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তি এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের পছন্দ-অপছন্দের ওপর। এ জন্যই আমরা অনেকে শিক্ষক সমিতির সভায় কয়েক দফায় অনুরোধ জানিয়েছিলাম, যেসব শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন প্রশাসনিক দায়িত্বে আছেন, তাঁরা দয়া করে যেন শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে না দাঁড়ান। বিশ্ববিদ্যালয়ে দলভিত্তিক রাজনৈতিক ঝোঁক কমিয়ে আনার এটা একটা পথ। অনেক একাডেমিক ও প্রশাসনিক পদে রাজনৈতিক নিয়োগ থেকে বের হয়ে আসা জরুরি। এসব চাওয়ার কোনোটিই পূরণ হয়নি। যার কারণে শিক্ষক সমিতিকে এখন আর ‘আমাদের শিক্ষক সমিতি’ দাবি করার সুযোগ কমই।

মনে রাখা প্রয়োজন, শিক্ষক সমিতি যে শুধু ১৫ জনের একটি কমিটি তা নয়, একটি বড় ক্যানভাস। এই ক্যানভাস বাংলাদেশের শিক্ষার মানচিত্রের ক্যানভাস। এই পরিস্থিতিতে শিক্ষক সমিতির কাছে আমাদের চাওয়ার পরিসরটি অনেক বড়। গত কয়েক বছরে শিক্ষক সমিতির ভাষায় তাদের বড় দুটি সাফল্য হলো: বঙ্গবন্ধু স্কলারশিপের চাকা আবার ঘোরানো এবং শিক্ষকদের জন্য ৫ শতাংশ সুদে ৭৫ লাখ টাকা পর্যন্ত গৃহঋণের বন্দোবস্ত করা। এর পাশাপাশি বাড়ানো হয়েছে ‘প্রান্তিক’ সুবিধা। তবে এটি শিক্ষা ব্যবস্থাপনার সার্বিক মান বাড়ানোর জন্য যথেষ্ট নয়, এটি আমরা সবাই নিশ্চিতভাবেই জানি।

আমরা চাই, শিক্ষক সমিতির বৃহৎ পরিসরে ক্রিয়াশীল থাকবে মুক্তচিন্তার মানুষের বিভিন্ন ধরনের শিক্ষার উদ্যোগ ও ভাবনা। শিক্ষকনেতারা সেগুলো আমলে নেবেন, সেগুলো নিয়ে এগোবেন। সেখানে থাকবে না কোনো ধরনের প্রশাসনিক অথবা ক্ষমতার ভয়। শুধু নির্বাচনের সময়ই ভোটারদের ভোট প্রত্যাশা নয়, নির্বাচনের পরও তাঁদের সঙ্গে থাকতে হবে, যোগাযোগ রাখতে হবে তাঁদের নির্বাচিত নেতৃত্বকে। শিক্ষকনেতারা সব শিক্ষকের সঙ্গে বসবেন, দলীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে তাঁদের কথা শুনবেন, শিক্ষার পরিবেশ ও সমস্যা নিয়ে ভাববেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাবেন। এক বছর ধরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংকটকালে শিক্ষক সমিতির ভূমিকা মোটেও আর আশাবাদী করে না। কারণ, এখন কোনো একটি সহিংস ঘটনার প্রতিবাদে একটি বিবৃতি দিতেও শিক্ষক সমিতিকে তাকিয়ে থাকতে হয় ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের মনোভাবের দিকে। আহা, আমাদের শক্তি কতটাই ফাঁপা, কতটা ভোঁতা।

মতাদর্শিক দেনদরবারের বৈঠকে বারবার মাথা ঠোকা আমরা তবু আশা করি, স্বপ্ন দেখি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির হাত ধরেই বিশ্ববিদ্যালয়ে সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনা নতুন মাত্রা পাবে। যে কমিটি নির্বাচিত হবে, তার প্রতি অগ্রিম শুভকামনা ও অভিনন্দন। আশা করি, তাঁরা শিক্ষা ব্যবস্থাপনার সংস্কৃতি নিয়ে প্রতিনিয়তই প্রশ্ন তুলবেন, আলোচনা করবেন, শিক্ষক সমিতির ট্রেড ইউনিয়ন মেজাজ ফিরিয়ে আনবেন।

জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]