নদী রক্ষা

সারা দেশে অবৈধ নদী দখলকারীদের উচ্ছেদ অভিযান চলছে। এই প্রক্রিয়াকে সার্থক রূপ দিতে হলে দুটি পদক্ষেপ নিতে হবে। এর একটি আইন সংশোধন করে নদী ট্রাইব্যুনাল গঠন করা। অন্যটি হলো ডেপুটি কমিশনারদের (ডিসি) মাধ্যমে ১৯৫০ সালের রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনের ১৪৯ ধারার ৪ উপধারার অধীনে বেহাত হওয়া নদীর জমি উদ্ধার করা। এই বিধানটি দ্বারা ডিসিরা বৈধ উপায়ে অথচ প্রতারণা করে নেওয়া নদীর জমি চুক্তি বা কোনো দলিল সরাসরি বাতিল করতে পারবেন। সরল বিশ্বাসে করা কোনো চুক্তি বা দলিল বাতিল করতে হলে ডিসি তা পাঠাতে পারেন ল্যান্ড আপিল বোর্ডে।

এই বিধানটি আসলে আড়াই হাজার বছর আগে প্রণীত জাস্টিনিয়ান কোডের নীতি ধারণ করে আছে। এর মূল কথা হলো নদী, জলাধার ও বায়ু হলো চিরকালের জন্য জনগণের সম্পত্তি। এটা আপনা–আপনি রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রের পক্ষে কখনো কেউ জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে, নিয়মনীতি মেনে বা না মেনে যদি নদীর কোনো অংশ বিক্রি বা ইজারা দেন, তাহলে তা বৈধ হবে না। সব পরিস্থিতিতে তা এখতিয়ারবহির্ভূত বা গোড়া থেকে বাতিল বলে গণ্য হবে।

 আমরা জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে ধন্যবাদ দিই যে, তারা আইনের এই বিষয়টিকে সামনে এনেছে। যদিও ২০১৫ সালে ভূমি মন্ত্রণালয় ১৪৯ ধারা প্রয়োগে এক পরিপত্র দিলেও ডিসিরা তার অনুশীলন করছেন না। গত শনিবার নদী রক্ষা কমিশনের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে কমিশন বলেছে, আগামী এক বছরের মধ্যে উচ্ছেদ অভিযান শেষ হবে। কিন্তু এটা টেকসই অর্থে অর্জন করা কঠিন হবে। কারণ, দেশের ৬৪ জেলায় ৪৯ হাজারের বেশি দখলদার চিহ্নিত হয়েছে। কিন্তু তাদের দখলে থাকা জমিগুলোর সীমানা খুব নির্দিষ্ট আছে, তা বলা যায় না।

তা ছাড়া, এই উচ্ছেদ অভিযানের অভিজ্ঞতা দীর্ঘ মেয়াদে সুখকর হবে, তা বলা যায় না। সামনে আইনি চ্যালেঞ্জ থাকতে পারে। অবৈধ দখলকারীরা সাধারণত প্রভাবশালী হন। কমিশন দেখেছে, শীতলক্ষ্যা ও মেঘনায় নদীর তীর ভেতর থেকে ৩৮০ মিটার থেকে ৫০০ মিটার পর্যন্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দখল করে রেখেছে। এর আগে আমরা বুড়িগঙ্গা ও তুরাগের মতো নদ–নদী থেকে অবৈধ দখলদার উচ্ছেদে উচ্চ আদালতের হস্তক্ষেপের পরেও তা অকার্যকর থাকতে দেখেছি।

আমরা মনে করি, আইনে ফাঁক রেখে উচ্ছেদ অভিযান কার্যকর করা হলে তা ভবিষ্যতে অহেতুক জটিলতা তৈরি করতে পারে। সাম্প্রতিক কালে নদী রক্ষা কমিশন বরিশাল, পটুয়াখালী ও নারায়ণগঞ্জসহ কয়েকটি জেলার ডিসিদের সঙ্গে কথা বলেছে। এর সারকথা হলো, প্রজা স্বত্ব আইনটির ওই বিধান প্রয়োগ করার অধিকার ডিসিদের আছে। কিন্তু অনেক ডিসিই তা অবগত নন। তবে দু-একটা ক্ষেত্রে এই বিধান প্রয়োগ করে সুফল মিলেছে। যেমন চাঁপাইনবাবগঞ্জের ডিসি ইতিমধ্যে এই বিধানের আওতায় প্রায় ৪০ একর নদীর জমি উদ্ধার করেছেন। আমরা মনে করি, এই বিষয়ে মন্ত্রিসভা বিভাগ থেকে যদি জোরালো তাগিদ যায়, তাহলে সারা দেশে ডিসিরা দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে একটি সাড়া ফেলতে পারেন।

এ ছাড়া নদী রক্ষা কমিশন বিদ্যমান আইনের খসড়া সংশোধন করবে বলে জানিয়েছে। প্রস্তাবিত সংশোধনীতে তারা ভ্রাম্যমাণ আদালতকে যুক্ত করা এবং নদী রক্ষা ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রস্তাব দেবে। ট্রাইব্যুনাল গঠনে যদিও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়–সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির সুপারিশ রয়েছে, তদুপরি আইন সংশোধন একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া এবং এমন উদাহরণও আছে যে, বিশেষ আইনে ট্রাইব্যুনাল গঠনে বছরের পর বছর কেটে গেছে। আমরা তাই মনে করি, আইনের অধীনে দ্রুত সুফল পেতে চাইলে নদী রক্ষায় ওই বিধানটি প্রয়োগ করা হোক।