এইচআইভি প্রতিরোধ কর্মসূচিতে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজনীয়তা ও করণীয়

>
১৪ ডিসেম্বর ২০১৯, প্রথম আলোর আয়োজনে এবং জাতীয় এইডস/এসটিডি কন্ট্রোল, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নেতৃত্বে সেভ দ্য চিলড্রেন ও ইউএনএফপিএর সহযোগিতায় ‘এইচআইভি প্রতিরোধ কর্মসূচিতে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজনীয়তা ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক হয়।
১৪ ডিসেম্বর ২০১৯, প্রথম আলোর আয়োজনে এবং জাতীয় এইডস/এসটিডি কন্ট্রোল, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নেতৃত্বে সেভ দ্য চিলড্রেন ও ইউএনএফপিএর সহযোগিতায় ‘এইচআইভি প্রতিরোধ কর্মসূচিতে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজনীয়তা ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক হয়।
১৪ ডিসেম্বর ২০১৯, প্রথম আলোর আয়োজনে এবং জাতীয় এইডস/এসটিডি কন্ট্রোল, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নেতৃত্বে সেভ দ্য চিলড্রেন ও ইউএনএফপিএর সহযোগিতায় ‘এইচআইভি প্রতিরোধ কর্মসূচিতে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজনীয়তা ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত আলোচকদের বক্তব্য সংক্ষেপে এই ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হলো।

আলোচনা

আব্দুল কাইয়ুম

বাংলাদেশে এইচআইভির বর্তমান অবস্থা জনসংখ্যার তুলনায় আশঙ্কাজনক নয়। বর্তমানে এর হার শূন্য দশমিক ০১ শতাংশের নিচে। এটি পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায় সবচেয়ে কম।

এইচআইভি হয়তো নির্মূল করা সম্ভব নয়। কিন্তু এটি যাতে না ছড়ায়, সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। এইচআইভি বিষয়ে সরকারও অনেক বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।

মো. নজরুল ইসলাম
মো. নজরুল ইসলাম

মো. নজরুল ইসলাম
বাংলাদেশে প্রথম এইচআইভি শনাক্তকরণ পরীক্ষার সঙ্গে জড়িত ছিলাম। ১৯৮৫ সালের ২৬ অক্টোবর জাতীয় এইডস নির্মূল কমিটি গঠিত হয়। তখন থেকেই অর্থের অভাব থাকায় আমরা অল্প পরিসরে কাজ করেছি। একপর্যায়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশে একটি জরিপ করার জন্য দেশের জনসংখ্যাকে আচরণের ভিত্তিতে কয়েকটি গোষ্ঠীতে ভাগ করি। তারপর ল্যাবরেটরি স্থাপন করি।

১৯৮৭ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত ১৪ হাজার এইচআইভি টেস্ট করে আক্রান্ত একজনকেও পাইনি। ১৯৯০ সালের জরিপে দুজন আক্রান্ত ব্যক্তিকে শনাক্ত করতে পেরেছিলাম। তাঁদের মধ্যে একজন মারা গেছেন। অন্যজনকে পরবর্তী সময়ে তাঁর ইচ্ছানুুসারে আরেকজন এইচআইভিতে আক্রান্ত নারীর সঙ্গে বিয়ে দিই। তাঁদের দুটো সন্তান হয়েছিল। দুটি শিশুই ছিল এইচআইভি নেগেটিভ। এটা আমাদের জন্য একটি বড় অর্জন ছিল।

ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদক গ্রহণকারীরা এইচআইভি–ঝুঁকিতে সবচেয়ে বেশি থাকে। একই সিরিঞ্জে অনেকেই ইনজেকশন দেওয়ার মাধ্যমে ভাইরাস ছড়ায়।

এ ক্ষেত্রে যারা এই সিরিঞ্জ দিয়ে ইনজেকশন নিল, তারা সবাই ঝুঁকিতে থাকে। এর মাধ্যমে হেপাটাইটিস সি ভাইরাস ছড়াতে পারে। তাই এটি যাতে না ছড়ায়, এ জন্য যারা আক্রান্ত, তাদের চিহ্নিত করা জরুরি।

মো. শামিউল ইসলাম
মো. শামিউল ইসলাম

মো. শামিউল ইসলাম
বর্তমানে আমরা ২৩টি জেলার ২৮টি কেন্দ্রে এইচআইভি পরীক্ষা করতে পারছি। মানুষের সঙ্গে কথা বলে আস্থা তৈরি করতে হবে। এ জন্য পরীক্ষার পাশাপাশি তাদের পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। বর্তমানে যে রোগ নিয়ন্ত্রণে আছে, পরবর্তীকালে সেটিই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। এটি হতে পারে ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার জন্য।

আমরা সবাই জানি, ইনফ্লুয়েঞ্জা একটা সাধারণ রোগ। কিন্তু এই রোগের যদি কোনো নতুন ধরনের আবির্ভাব ঘটে, তাহলে সারা পৃথিবীতে রোগটি ছড়াতে এক ঘণ্টা লাগবে।

এইচআইভি রোগটি লুকানোর প্রবণতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে যে এটি একটি রোগ মাত্র। যদি আমরা এটিকে অপরাধের পর্যায়ে নিয়ে যাই, তাহলে মানুষ সেবা নিতে আসবে না।

এইচআইভিকে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে সংযুক্ত করার জন্য দেড় বছর ধরে চেষ্টা চলছে। প্রসূতিদের পরীক্ষায় সিফিলিসকে যোগ করা হয়েছে। এভাবে এর মধ্যে এইচআইভিকে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি নিয়েও ভাবতে হবে।

তাহলে আমরা একটি বড় অংশের রোগটি নির্ণয় করতে পারব। আর যাদের শনাক্ত করা হবে, তাদের বাকি জীবন ভালো করে বাঁচার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সরকার সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে এ রোগের চিকিৎসা দিচ্ছে। এ সেবা পৃথিবীর অধিকাংশ ধনী দেশেও নেই।

 আমাদের একটি ভ্রান্ত বিশ্বাস হলো, এইচআইভি শুধু অনিরাপদ যৌন সম্পর্কের মাধ্যমে ছড়ায়। এটি সত্য নয়। এর আরও অনেক কারণ রয়েছে।

শামীম জাহান
শামীম জাহান

শামীম জাহান
১৯৮৯ সালে প্রথম কাজ শুরু করার পর থেকে এ পর্যন্ত আমরা ৩০ বছর পার করেছি। এ সময়ের মধ্যে আমাদের অর্জন অনেক। আমরা বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে শঙ্কিত নই। আমাদের কিছু গবেষণামূলক কাজ হয়েছে, যা আমাদের ভবিষ্যৎ পথচলাকে মসৃণ করবে। জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ কিশোর-কিশোরী। তাদের এইচআইভি–সংক্রান্ত ধারণা ও সচেতনতা অনেক কম। তারা প্রজনন স্বাস্থ্য–সম্পর্কিত বিষয়গুলোতেও অতটা সচেতন নয়। আমরা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা থেকে মাত্র ১১ বছর দূরে আছি। এ ১১ বছরে আমাদের অনেকগুলো কাজ করতে হবে। তার মধ্যে একটি বড় কাজ হলো সর্বজনীন স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা।

রাহাত আরা নূর
রাহাত আরা নূর

রাহাত আরা নূর
সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় একটি লক্ষণীয় পরিবর্তন এসেছে। বিশেষ করে এইচআইভি ও যৌন–প্রজনন স্বাস্থ্যব্যবস্থার মধ্যে সংযোগের বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ এইচআইভি ও যৌন প্রজনন স্বাস্থ্যব্যবস্থার মধ্যে সমন্বয় করতে হবে।

এইচআইভি প্রতিরোধ, চিকিৎসা ও পরামর্শের ক্ষেত্রে সাধারণ জনগণের জন্য অনেক সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থা রয়েছে। ঝঁকিপূর্ণ জনসংখ্যার জন্য আমাদের বিশেষভাবে ভাবতে হবে। আমাদের ঝঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী হলো যৌনকর্মী, শিরায় মাদক গ্রহণকারী, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ, কিশোর–কিশোরী।

এইচঅাইভি রোধ করতে চাইলে এইচআইভি এবং যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যব্যবস্থার মধ্যে কার্যকর সমন্বয় প্রয়োজন। এ সমন্বয় হবে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার পর্যায়ে। অন্যদিকে স্বাস্থ্যনীতি, স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও অর্থ সরবরাহের মধ্যেও একটা সমন্বয় প্রয়োজন।

আহমেদুল কবীর
আহমেদুল কবীর

আহমেদুল কবীর
এইচআইভি রোগের ধরন ও আচরণ সম্পর্কে আমাদের ভালো ধারণা থাকতে হবে। প্রচলিত নিয়মে যাদের সম্পর্কে ধারণা করা হয়, এর বাইরেও একটা ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী আছে।

উদাহরণস্বরূপ, টার্গেট গ্রুপের মধ্যে যৌনকর্মীরা থাকলেও তাঁদের খদ্দেররা নেই। কিন্তু তাঁরা অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ একটি শ্রেণি। প্রবাসী শ্রমিকেরা অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। তাঁদের শনাক্ত করা বেশ কষ্টকর। তাঁদের চিকিৎসার জন্য এক জায়গায় পাঠানো হলে মাঝপথে তাঁরা হারিয়ে যান।

এইচআইভি যৌন আচরণের মাধ্যমে ছড়ায়, প্রথমে এটা স্বীকার করে নিতে হবে। কারণ, বর্তমানে রক্ত আদান-প্রদান ও আইভি ড্রাগের ব্যবহার অনেক কম। রক্ত আদান-প্রদানে যুক্তরাষ্ট্রে এক লাখ মানুষের মধ্যে একজনও এইচআইভিতে আক্রান্ত হয় না।

সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও যৌন আচরণের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত করা অনেক কঠিন কাজ। তাঁদের মধ্যে অনেক ধরনের লোক থাকেন। তাঁদের প্রত্যেকের যৌন আচরণে রয়েছে ভিন্নতা। এ বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ, যৌন আচরণের সঙ্গে বাকি কারণগুলো ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সব স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এইচআইভি পরীক্ষার সুবিধা সম্প্রসারিত করতে হবে।

মো. আমিনুল ইসলাম মিঞা
মো. আমিনুল ইসলাম মিঞা

মো. আমিনুল ইসলাম মিঞা
বাংলাদেশে এইচআইভি এইডস নিয়ে অনেক কাজ হচ্ছে। এখন এটি সরকারের মূলধারার পরিকল্পনার মধ্যে এসেছে। ২০১৭ সালে ছয়টি কেন্দ্র দিয়ে শুরু করলেও এখন অ্যান্টি রেট্রোভাইরাল ট্রিটমেন্টের (এআরটি) কেন্দ্রের সংখ্যা ১০। এ ছাড়া ছয়টি কম্প্রিহেনসিভ

ড্রপ ইন সেন্টার থেকে এআরটি সেবা দেওয়া হচ্ছে। এসব সেন্টারে রোগনির্ণয়ের পাশাপাশি চিকিৎসাও দেওয়া হয়। বাংলাদেশে এইচআইভি নির্ণয় ও চিকিৎসাসুবিধা বিস্তার লাভ করেছে। এ বছর আমাদের রোগনির্ণয়ক্ষমতা বেড়েছে। ফলে আগের থেকে বেশি এইচআইভি শনাক্ত করতে পারছি। তার মানে এটা নয় যে এইচআইভিতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে, বরং এটি নির্দেশ করে, আমাদের নির্ণয় করার পরিমাণ বেড়েছে।

আমরা এখন জেলা পর্যায়ে কাজ করছি। ক্রমাগত উপজেলায়ও যাব। উপজেলা স্বাস্থ্যকর্মীদের সচেতন করতে পারলে তাঁরা মাঠপর্যায়ে কাজ করতে পারবেন। এইচআইভিকে সম্পূর্ণ নির্মূল করা যাবে না, এটা সত্যি।

কিন্তু এ রোগ যাতে আর বিস্তার লাভ না করে, সে বিষয়ে আমাদের সচেতন থাকতে হবে।

জুলিয়া আহ্‌মেদ
জুলিয়া আহ্‌মেদ

জুলিয়া আহ্‌মেদ
টাঙ্গাইলের যৌনপল্লিতে কিশোরী যৌনকর্মীদের সঙ্গে আলোচনায় তারা বলেছে, সেখানে কনডমের ব্যবহার ঠিকমতো হয় না। এইচআইভি পজিটিভ একজন যৌনকর্মী আমাকে বলেছেন, তিনি অনেক বিপদে আছেন। কারণ, তিনি এআরটি সেবা পাচ্ছেন না।

বাংলাদেশ সরকার এইচআইভি/এইডসের বিষয়ে অনেক বেশি সচেতন। এসব রোধে সরকার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এ কারণে এইডসে আক্রান্ত হওয়ার হার অনেক কম। সরকারের পাশাপাশি অনেক সংগঠন এবং এনজিও একই লক্ষ্যে কাজ করছে।

সামিনা চৌধুরী
সামিনা চৌধুরী

সামিনা চৌধুরী
৯০ শতাংশ সম্ভাব্য এইচআইভি আক্রান্ত ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা, চিহ্নিত ব্যক্তিদের ৯০ শতাংশকে চিকিৎসাসেবার আওতায় আনা এবং চিকিৎসাধীন ৯০ শতাংশের ভাইরাসের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা, যা ৯০-৯০-৯০ কর্মকৌশল হিসেবে পরিচিত। আমরা এটাকে সামনে রেখেই অগ্রসর হচ্ছি।

এইচআইভিকে নির্মূল করা সম্ভব নয়। এটি আসতেই থাকবে, আর প্রতিরোধ করতে হবে। এ বিষয়টি নিয়ে বিবেচনায় রেখেই কর্মকৌশল প্রণয়ন করতে হবে। মা থেকে শিশুর মধ্যে জন্মের সময় এইচআইভি ছড়াতে পারে। এ জন্য জন্ম–পূর্ব যত্ন নেওয়া অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়ের মধ্যে এইচআইভি থাকলে তা শনাক্ত করতে হবে। যাদের এইচআইভি শনাক্ত হবে, তাদের কাউন্সেলিং করতে হবে। এ জন্য জেলা-উপজেলা ও মেডিকেল কলেজগুলোয় একটি করে কাউন্সেলিং কর্নার স্থাপন করতে হবে।

বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অনেক বেশি শক্তিশালী একটি মাধ্যম। অধিকাংশ মানুষ এর সঙ্গে সম্পৃক্ত। একে কার্যকরভাবে ব্যবহার করে সচেতনতা সৃষ্টি করা সম্ভব।

মো. মিজানুর রহমান
মো. মিজানুর রহমান

মো. মিজানুর রহমান
প্রতিটি ইউনিয়নে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্র রয়েছে। এমসিএইচ সার্ভিসেস ইউনিটের পরিকল্পনার অধীনে এখানে কৈশোরবান্ধব স্বাস্থ্যসেবা কর্নার স্থাপন করা হয়েছে। এসব কর্নারে তাদের পৃথকভাবে পরামর্শসেবা দেওয়া হয়। যৌনবাহিত রোগ, বয়ঃসন্ধিকালীন পরিবর্তন এবং যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে তাদের পরামর্শ দেওয়া হয়।

স্বাস্থ্য কর্নারে মূলধারার শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কিছুটা থাকলেও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতি লক্ষণীয়। এভাবে একটি বড় অংশ সেবার বাইরে থেকে যায়। তাই তাদের এ কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।

এস এম সামসুজ্জামান
এস এম সামসুজ্জামান

এস এম সামসুজ্জামান
এইচআইভিতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ২০১৮ সালে এইচআইভিতে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা ৮৬৯ ছিল। ২০১৯ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯১৯–তে। পাশাপাশি এইচআইভিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে। ২০১৮ সালে এইচআইভিতে মৃত্যুর সংখ্যা ১৪৮ ছিল। ২০১৯ সালের নভেম্বর পর্যন্ত তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭০–এ। এ সংখ্যাবৃদ্ধিতে শনাক্তকরণে ক্ষমতাবৃদ্ধির একটা প্রভাব থাকলেও একে হালকাভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। আক্রান্ত রোগীদের অধিকাংশই প্রবাসী শ্রমিক। একসময় মনে করা হতো এইচআইভির প্রভাব শহরেই সবচেয়ে বেশি। কিন্তু এখন গ্রামেও এটি ছড়িয়ে পড়ছে। আক্রান্ত রোগীকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণের মধ্যে রাখা সরকারের নীতিতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

শতভাগ প্রসূতি মাকে এইচআইভি শনাক্তকরণ পরীক্ষার আওতায় আনতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় প্রত্যেক শিক্ষার্থীর এইচআইভি টেস্ট বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে।

সাবেরা সুলতানা
সাবেরা সুলতানা

সাবেরা সুলতানা
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, স্বাস্থ্য হলো সার্বিকভাবে শারীরিক, মানসিক ও সামাজিকভাবে ভালো থাকা। কেবল রোগের উপস্থিতিকে বোঝায় না। তাই যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্যকে এইচআইভি প্রতিরোধ কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সবকিছুই হয়তো আমাদের কৌশলপত্রে আছে। কিন্তু আমরা সেটি বাস্তবায়ন করতে পারছি না। আমাদের রোগ পর্যবেক্ষণকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। পাশাপাশি সঠিক তথ্যের সরবরাহ জরুরি। এইচআইভিকে সরকারের মূলধারার পরিকল্পনাগুলোর মধ্যে নিয়ে আসতে হবে।

আমাদের প্রজনন স্বাস্থ্যসেবাকে মানসম্মতভাবে স্কুল-কলেজের পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করলেই হবে না, পাশাপাশি একে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। স্কুল-কলেজে এ–সংক্রান্ত অধ্যায়গুলো ভালো করে পড়ানো হয় না। শিক্ষকেরা প্রজনন–সংক্রান্ত এসব অধ্যায় শিক্ষার্থীদের বাসায় পড়ে নিতে বলেন। এটি অনেক ক্ষতিকর। এমনিতেই আমাদের তরুণ প্রজন্ম প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে অনেক কম জানে।

মো. আসাদুল ইসলাম
মো. আসাদুল ইসলাম

মো. আসাদুল ইসলাম
অনেকেই মনে করেন, রক্ত আদান-প্রদানে এইচআইভি ছড়ায় না। এটি একটি ভুল ধারণা। রক্তের মাধ্যমে এটি অবশ্যই ছড়ায়। ব্লাড ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এ–সংক্রান্ত প্রচারণা হচ্ছে। মানুষ এখন অনেক বেশি সচেতন, তারা আর রক্ত কেনে না, সবাই নিজের রক্ত দেয়। আর দাতাদের থেকে রক্ত নেওয়ার সময় তারা জেনে নেয় যে পরীক্ষাগুলো ঠিকভাবে করা হয়েছে কি না। এটা তাদের সচেতনতার বহিঃপ্রকাশ। এটা সংক্রমণ প্রতিরোধে ভূমিকা রেখেছে।

এইচআইভির ক্ষেত্রে রোগনির্ণয় পরীক্ষাগুলোকে আরও সহজলভ্য করতে হবে। এইচআইভিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য কাউন্সেলিং অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। রোগনির্ণয়ের আগে ও পরে উভয় সময়েই কাউন্সেলিং করতে হয়। এ সেবা প্রতিটি উপজেলা, জেলা ও মেডিকেল কলেজগুলোতে থাকতে পারে।

রাশেদ মোহাম্মদ খান
রাশেদ মোহাম্মদ খান

রাশেদ মোহাম্মদ খান
এইচআইভিসহ এ–সংক্রান্ত কিছু জটিলতা প্রতিরোধে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সরকারি হাসপাতালগুলোতে অনেক ভিড়ের মধ্যেই এসব রোগী আসে। ফলে তাদের সামাজিকভাবে হেয় হতে হয়। পাশাপাশি তাদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা এ ক্ষেত্রে থাকে না। তাদের সঠিকভাবে আমরা পরামর্শ দিতে পারি না। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে তাদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা করতে হবে।

আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হবে এইচআইভি প্রতিরোধ, প্রতিকার নয়। কারণ, প্রতিকারে ব্যবহৃত ওষুধ অনেক দামি। আস্তে আস্তে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা বেড়ে গেলে নিয়মিত ওষুধ সরবরাহ অনিশ্চিত হয়ে যাবে। অনেক সময় এইচআইভি ভাইরাস সুপ্তাবস্থায় থাকে। সে সময় টেস্টের ফলাফল কিন্তু নেগেটিভ আসবে। কিন্তু সে এইচআইভিতে আক্রান্ত। তাই এ ধরনের রোগীদের বলে দিতে হবে যে তারা যেন আবার নির্দিষ্ট একটি সময় পরে এসে পুনরায় পরীক্ষা করায়।

আলেয়া আক্তার
আলেয়া আক্তার

আলেয়া আক্তার
বর্তমানে ড্রপ ইন সেন্টারে (ডিআইসি) শুধু এইচআইভি নিয়ে সেবা দেওয়া হয়। আর মেয়েরা ডিআইসিতে যেতে বেশি স্বচ্ছন্দবোধ করে। ড্রপ ইন সেন্টারে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। তাহলে মেয়েরা একই সঙ্গে সব সেবার আওতায় চলে আসবে। এইচআইভিতে তরুণ প্রজন্ম অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এই প্রজনন স্বাস্থ্যের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া প্রয়োজন।

সাইফ উল্লাহ মুন্সী
সাইফ উল্লাহ মুন্সী

সাইফ উল্লাহ মুন্সী
অনেকে মনে করেন, যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়টি শুধু নির্দিষ্ট একটা জনগোষ্ঠীর জন্য প্রয়োজন। এটা সঠিক ধারণা নয়। এ ধারণা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। তা না হলে সমন্বয় করতে পারব না। ফলে সেবাও পাব না। আমাদের নিজেদের প্রয়োজনে সমন্বয় করতে হবে। অভিবাসী জনসংখ্যাকে নিয়ে অনেক কম পরিমাণে কাজ হয়। প্রবাসীদের এ রোগের ঝুঁকি অনেক বেশি। এইচআইভি, হেপাটাইটিস, টিবি নিয়ে গঠিত জাতীয় পরিকল্পনাগুলোর মধ্যে সমন্বয় করতে হবে। যক্ষ্মা, এইচআইভি, হেপাটাইটিস পরীক্ষা একই যন্ত্র দিয়ে সম্ভব হচ্ছে। তাই এ ক্ষেত্রে কর্মসূচির মধ্যে সমন্বয় বাড়ালে আর্থিক সাশ্রয় হবে। প্রতিটি হাসপাতালে ইনফেকশন ক্লিনিক স্থাপন করতে হবে।

সায়মা খান
সায়মা খান

সায়মা খান
নারী যৌনকর্মীরা বহু ধরনের নির্যাতনের শিকার হন। যৌনকর্মীদের মধ্যে শতকরা ৫০ ভাগ নির্যাতনের শিকার হন। অপবাদ বা বৈষম্যের শিকার হন ৭০ ভাগ।

যৌনকর্মীরা এইচআইভির ঝুঁকিতে সবচেয়ে বেশি থাকেন। তাঁদের মধ্যে যৌন রোগের প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি। সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে যৌনকর্মীরা বৈষম্যের শিকার হন। সেবার ক্ষেত্রে বৈষম্য হলে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জন দুরূহ হবে। এইচআইভিকে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এইচআইভিকে আলাদা করে ভাবলে হবে না। এদের মধ্যে সমন্বয় প্রয়োজন। যৌনবাহিত রোগের মধ্যে এইচআইভিসহ গনোরিয়া ও সিফিলিসের মতো রোগ রয়েছে।

নাসিমা সুলতানা
নাসিমা সুলতানা

নাসিমা সুলতানা
একসময় যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা বলতে শুধু পরিবার পরিকল্পনা আর মাতৃস্বাস্থ্যকে ধরা হতো। কিন্তু এখন এর মধ্যে অনেকগুলো বিষয়কে সংযুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে মাতৃস্বাস্থ্য, নবজাতকের স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা, যৌন সহিংসতা, যৌন নিপীড়ন, এইচআইভি, জরায়ু ক্যানসার, যৌনবাহিত রোগ, গর্ভপাত, বয়ঃসন্ধিকালীন স্বাস্থ্য ও কিশোর স্বাস্থ্যকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মানবাধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলে নারীর অধিকারকে নিশ্চিত করতে হবে। আর নারীর অধিকারকে নিশ্চিত করতে পারলেই যৌন প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে।

আমরা বিভিন্ন বিভাগ ও মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে কার্যকর যোগাযোগ স্থাপন করছি। তাদের সঙ্গে সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তুলেছি। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সাহায্যে স্কুলের শিক্ষার্থীদের যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন করা হচ্ছে। পাঠ্যপুস্তকে যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য মানসম্মতভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

যৌন স্বাস্থ্য অধিকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো যে যখন কনডম চাইবেন, তাঁকে তখন তা সরবরাহ করতে হবে। আমাদের দেশে হয়তো এই বিষয়কে বাজেভাবে নেওয়া হয়। এ দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। অবিবাহিতদের কনডম সরবরাহ করা হয় না। এটি ঠিক নয়। নানা কারণে একজন বিয়ে না–ই করতে পারেন। এ জন্য তাঁর যৌন স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন থাকার সুযোগ থাকবে না? আমরা তাঁদের বাদ দিয়ে খুব বেশি দূর অগ্রসর হতে পারব না।

ফিরোজ চৌধুরী

আলোচনায় এইচআইভি প্রতিরোধ কর্মসূচিতে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজনীয়তা ও করণীয়সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় এসেছে। সমন্বিতভাবে কাজ করলে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হবে। আলোচনায় অংশগ্রহণের জন্য প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।

যাঁরা অংশ নিলেন

নাসিমা সুলতানা: অতিরিক্ত মহাপরিচালক, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

মো. নজরুল ইসলাম: সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

মো. শামিউল ইসলাম: পরিচালক, এমবিডিসি অ্যান্ড লাইন ডিরেক্টর টিবি–এল অ্যান্ড এএসপি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

মো. আমিনুল ইসলাম মিঞা: পরিচালক, জাতীয় এইডস/এসটিডি কন্ট্রোল, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

সাইফ উল্লাহ মুন্সী: চেয়ারম্যান ও অধ্যাপক, ভাইরোলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

এস এম সামসুজ্জামান: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ডিএমসি)

মো. আসাদুল ইসলাম: অধ্যাপক, ডিপার্টমেন্ট অব ট্রান্সফিউশন মেডিসিন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

আহমেদুল কবীর: অধ্যাপক, ডিপার্টমেন্ট অব মেডিসিন, ডিএমসি; মহাসচিব, বাংলাদেশ সোসাইটি অব মেডিসিন

মো. মিজানুর রহমান: উপপরিচালক, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর

সায়মা খান: কান্ট্রি ম্যানেজার, ইউএনএইডস

রাশেদ মোহাম্মদ খান: অধ্যাপক ও প্রধান, চর্ম ও যৌনরোগ বিভাগ, ডিএমসি

সামিনা চৌধুরী: স্ত্রীরোগ ও ধাত্রীবিদ্যা বিশেষজ্ঞ, সেন্ট্রাল হসপিটাল ও সভাপতি, ওজিএসবি

শামীম জাহান: পরিচালক, হেলথ, নিউট্রিশন অ্যান্ড এইচআইভি/এইডস সেক্টর, সেভ দ্য চিলড্রেন

রাহাত আরা নূর: টেকনিক্যাল অফিসার, জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল

সাবেরা সুলতানা: ন্যাশনাল প্রফেশনাল অফিসার, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা

জুলিয়া আহ্‌মেদ: বিশেষজ্ঞ, যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার

আলেয়া আক্তার: সাধারণ সম্পাদক, সেক্স ওয়ার্কারস নেটওয়ার্ক অব বাংলাদেশ

সূচনা বক্তব্য

আব্দুল কাইয়ুম: সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো

সঞ্চালনা

ফিরোজ চৌধুরী: সহকারী সম্পাদক, প্রথম আলো