অন্ধকার সুড়ঙ্গের শেষে চাই আলোর রশ্মি

প্রথম আলোসহ দেশের প্রায় সব গণমাধ্যমে খবরটি এসেছে। তা হলো দুই সিটি নির্বাচনে অতীতের পুনরাবৃত্তি চান না কমিশনার মাহবুব তালুকদার। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে ৩০ জানুয়ারি ভোট গ্রহণের দিন নির্ধারণ করে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। এরই ধারাবাহিকতায় সংশ্লিষ্ট নির্বাচন কর্মকর্তাদের দুই দিনব্যাপী প্রশিক্ষণের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মাহবুব তালুকদার এসব কথা বলেছেন। সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরিতে ‘জিরো টলারেন্স’ দেখাতে তিনি নির্বাচন কর্মকর্তাদের আহ্বান জানিয়েছেন। মাহবুব তালুকদার আরও বলেছেন, অতীতে যেসব সিটি করপোরেশন নির্বাচন হয়েছে, তার মধ্যে কুমিল্লা ও রংপুরে কমিশনের সাফল্য ছিল। তাঁর ভাষায় বেশি দিন ‘আপনার রূপে আপনি বিভোর’ থাকা হয়নি। পরবর্তী পাঁচটি সিটি নির্বাচনের মধ্যে তিনটিতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তিনি সংশ্লিষ্ট ছিলেন। তাঁর ভাষায়, বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তিনি এককভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। আর গাজীপুর ও খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচন সম্পর্কে প্রতিবেদন তৈরি করতে গিয়ে এ তিন নির্বাচনের স্বরূপ সন্ধান করা হয়েছে।

মাহবুব তালুকদার বলেন, ‘এই তিন সিটি করপোরেশনের নির্বাচন আমার কাছে মোটেই সুখকর নয়। আসন্ন ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিগত ওই তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি দেখতে চাই না।’ এরপর তিনি বলেন, সবাই অংশ নিলে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হওয়ার পথ সুগম হয়। রুদ্ধ হয় অনিয়মের পথ। হতাশ দেশবাসী অবাক বিস্ময়ে এসব ক্ষেত্রে কমিশনের দৃশ্যমান ব্যর্থতা এমনকি পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ লক্ষ করেছে। তাঁর মতে, কমিশন আইনগতভাবে স্বাধীন। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে এটা নির্বাচন প্রক্রিয়ার কাছে বন্দী। এই জন্য তিনি সে প্রক্রিয়ার সংস্কার দাবি করেছেন।

অনেক দেরিতে হলেও একজন নির্বাচন কমিশনারের এ উপলব্ধি দেশের নির্বাচন ব্যবস্থাপনার হাল অবস্থার একটি ক্ষীণ চিত্র সামনে আনল। তবে দায়িত্বশীল পদে আসীন রয়েছেন বলে হয়তো এতটা খোলামেলা করে অনিয়ম ও অগ্রহণযোগ্যতার চিত্রটি ব্যাখ্যা করেননি। তা-ও আমরা তাঁকে অন্তত এটুকুর জন্য সাধুবাদ জানাব। সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন থাকবে বরিশালের সিটি নির্বাচন পরিচালনার সার্বিক দায়িত্বে থেকে অব্যবস্থা দূরীকরণের জন্য কী ব্যবস্থা নিয়েছিলেন? কিছু যে নেননি, তা তো সবারই জানা। তা ছাড়া গত ডিসেম্বরের শেষের জাতীয় নির্বাচন সম্পর্কে বা তিনি এ ফোরামে বা অন্য কোথাও কোনো কথা বলেননি কেন? এর মান ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে তিনি কি সন্তুষ্ট? এ কমিশনের দায়িত্ব গ্রহণের মেয়াদ প্রায় তিন বছর। এখানে কিছু কিছু ক্ষেত্রে মাহবুব তালুকদারকে প্রতিবাদী মনে হলেও তিনি কি নির্বাচন ব্যবস্থাটিকে যথাযথ পথে চালাতে তেমন কোনো অবদান রেখেছেন? আমরা তো দেখছি না। অবশ্য কাজটা তাঁর একার নয়। গোটা কমিশনের। এখনকার কথাগুলো আরও আগে বললে কিছুটা আলোড়ন সৃষ্টি হতে পারত।

এ কমিশনের মেয়াদকালে আর জাতীয় নির্বাচন হবে না। দেশবাসী নীরব থাকলেও সবই দেখে। কমিশনকে সংবিধান ও নির্বাচনসংক্রান্ত আইন নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দিয়েছে। তালুকদার বলেছেন, কমিশন নির্বাচন প্রক্রিয়ার হাতে বন্দী। অথচ এই প্রক্রিয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমেই কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে পারে। আইনি ক্ষমতা থাকতেও তা ব্যবহার না করাকে আমরা কমিশনের অক্ষমতা কিংবা ইচ্ছাকৃত পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ বলে ধরে নিতে পারি। তাঁদের বেতন-ভাতা ও সুবিধাদির জন্য জনগণের করের টাকা যাচ্ছে। কমিশনের জনবল স্ফীত হচ্ছে দিন দিন। সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মূল নিয়ামক কর্মকর্তা রিটার্নিং অফিসাররা নির্বাচন কমিশনের লোক। তাহলে এ ক্ষেত্রে লক্ষণীয় ব্যর্থতা কেন? আর মাহবুব তালুকদারই নিজ দায়িত্বে থাকা বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তাঁর ক্ষমতার সর্বোচ্চ প্রয়োগ করলেন না কেন? অনেকেই জানেন তিনি সুলেখক। কার্যকাল শেষে নির্বাচন কমিশনের দিনগুলো কিংবা এ ধরনের অন্য কোনো শিরোনামে একটি বই উপহার দিলেই কি তিনি তাঁর ওপর অর্পিত সাংবিধানিক দায়িত্ব অবজ্ঞার দায় থেকে রেহাই পাবেন? অবশ্য আবারও বলতে হয়, কাজটা গোটা কমিশনের। তবে যেহেতু তিনি পৃথক একটি জানালা খুলে জনদাবির প্রতি সংবেদনশীলরূপে পরিচিত হতে চান, তাই তাঁকে এত প্রশ্ন।

গত কিছুদিনের সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোতে বেশ কিছু অনিয়ম সুস্পষ্টভাবে লক্ষণীয় হয়েছে। এসব অনিয়ম ফলাফলকে প্রভাবিত করতে যথেষ্ট। যেমন সরকারি দলের বিপরীতে মূল প্রতিদ্বন্দ্বীর সম্ভাব্য সমর্থক নেতা-কর্মীদের নানামুখী হয়রানি। প্রতিটি স্থানে তাঁদের নামে কিংবা বেনামে করা মামলায় গ্রেপ্তার ছিল একটি নিয়মিত বিষয়। তদুপরি তাঁদের এলাকাছাড়া করতেও ব্যাপক চাপে রাখা হয়। চাপ দেওয়া হয় তাঁদের স্বজন-পরিজনদেরও। আর ওই প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণায় দৃশ্যমানভাবে দেওয়া হয় বাধা। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার একটি অংশ ও সরকার সমর্থক নেতা-কর্মীরা হয়ে যান একাত্ম। এসব অভিযোগ কমিশনে এসেছে বারবার। কমিশন এ ক্ষেত্রে প্রায় নীরব অথবা দায়িত্বহীন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। তাদের আন্তরিকতা সম্পর্কে যদি সন্দেহ না-ও করা হয়, তাহলেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দৃশ্যমান ব্যর্থতা ভুলে যাওয়ার নয়। বিরোধী দলের প্রার্থী হয়ে পড়েন অসহায়। নির্বাচনে প্রার্থীদের একটি সাংগঠনিক ভিত থাকতে হয়। তাঁদের প্রচার-প্রচারণার জন্য দিতে হয় যৌক্তিক সময়। এর অনুপস্থিতিতে ভোটের দিনে নির্বাচন কেন্দ্রে থাকে না তাঁদের এজেন্ট। থাকলেও বের করে দেওয়ার বিস্তর অভিযোগ আছে। এরপর ইচ্ছাকৃতভাবে সিল মারা হয় ব্যালটে। আর প্রিসাইডিং কর্মকর্তা থেকে রিটার্নিং কর্মকর্তা সবাই তা মেনেও নেন। গোনাগুনতি করে ফলাফল বিবরণী পাঠিয়ে দেওয়া হয় কমিশনে। এ অবস্থায় ভোটের ফলাফল ভিন্নরূপ হবে, এমনটা আশা করা যায় না। অবশ্য বিরোধী দলের প্রার্থী জিতলেই নির্বাচন সুষ্ঠু হয় এমনটা নয়। রংপুরে জাতীয় পার্টির প্রার্থী জয়ী হয়েছেন স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়।

মাহবুব তালুকদার আসন্ন ঢাকা সিটি নির্বাচনের গুরুত্ব সংশ্লিষ্ট নির্বাচন কর্মকর্তাদের কাছে তুলে ধরেছেন। রাজধানীর এ দুটো নির্বাচনের প্রতি নজর থাকবে দেশ-বিদেশের গণমাধ্যমসহ অনেক সংস্থার। অবশ্য অনেকের আচরণ দেখে মনে হয় তারা মেঘনাদবধ কাব্যের এ দুটো লাইন সর্বদা স্মরণে রাখেন:
রাবণ শ্বশুর মম, মেঘনাদ স্বামী,—
আমি কি ডরাই, সখী, ভিখারি রাঘবে?

এমনটা চলতে থাকলে বিপর্যয় হবে। আর সে ক্ষেত্রে কমিশন তার ক্ষমতা কার্যকরভাবে প্রয়োগ করতে পারলে অপসারিত হবে বাধা। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার ওপর কমিশনের পূর্ণাঙ্গ ও নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার বিধান সংবিধানে রয়েছে। এটা কতটা করতে পারলেন, তা বোঝা যাবে চূড়ান্ত পরিণতিতে। এখানে সব দল-মতের প্রার্থীদের আইনানুগভাবে প্রচারকাজে কেউ বাধা না দিক, এটা নিশ্চিত করা কমিশনের দায়িত্ব। বিরোধী দলের প্রার্থী কিংবা তাঁদের কর্মী-সমর্থকদের হালে সংগঠিত হওয়া, বড় ধরনের কোনো অপরাধের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা না থাকলে গ্রেপ্তার কিংবা ভিন্ন কোনো রূপ হয়রানির বিরুদ্ধে কমিশন কঠোর নির্দেশ ও নিবিড় তদারক করতে পারে। তাদের বিবেচনায় এর ব্যত্যয় ঘটলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্বাচনী আইন ভঙ্গের অভিযোগে অভিযুক্ত করতে পারে। আচরণবিধির দৃশ্যমান প্রয়োগ পরিস্থিতি উন্নয়নের পূর্বশর্ত। তবে আমাদের তো একটাই নির্বাচন কমিশন। হাজারো ব্যর্থতা সত্ত্বেও তাদের দিকেই তাকিয়ে থাকতে হবে। জরাজীর্ণ অতীত আর সমস্যাসংকুল বর্তমানকে ভুলে আমরা একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ চাই। অন্ধকার সুড়ঙ্গের অপর প্রান্তে দেখতে চাই আলোর রশ্মি। কমিশন প্রত্যয়ী হলে অন্তত ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনে এটা অসম্ভব হবে না। মাহবুব তালুকদারের মতো আমরাও অতীতের কদর্যময় কাহিনির পুনরাবৃত্তি চাই না।

আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
[email protected]