পোশাকশিল্পে নারী শ্রমিকের 'আত্মহত্যার' অধিকার

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

ফাহিমা খাতুন, হাল সাকিন: গোরস্থান, মধ্যপাড়া, তারাবাড়িয়া, চরতারাপুর, পাবনা সদর, জেলা পাবনা। পোশাকশ্রমিক ফাহিমার দাফন হয়ে গেছে। সবাইকে বিশ্বাস করতে বলা হয়েছে, ফাহিমা আত্মহত্যা করেছেন প্রকাশ্যে। প্রকাশ্য দিবালোকে তাঁর কর্মস্থলের ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মাহুতি দিয়েছেন তিনি। (দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সমকাল, ২৪ ডিসেম্বর) সব পত্রিকা ছাপেনি এই খবর। আরপি-পাগল অনলাইনগুলোও আঁধারে রেখেছে ফাহিমার খবর। যে তিন-চারটি দৈনিক ছেপেছে, তাদেরও আগাগোড়া এক বয়ান, যেন আইয়ুব খানের আমলে আমলাদের মুসাবিদা করা প্রেসনোট। একই আদলে, একই কাঠামোয় লেখা একই বয়ান পড়ে যে-কারও মনে হবে, স্বৈরাচারী ফাহিমা আইনকানুনের তোয়াক্কা না করে ইচ্ছেমতো ছুটি ভোগ করে যেদিন খুশি সেদিন কাজে যোগদান করতে এলে তাঁকে আইনকানুন আর সহবত লেহাজের তালিম দেওয়ার সময় তিনি খেপে গিয়ে সাততলা থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে সবাইকে বিপদে ফেলার চেষ্টা করেন।

পুলিশ বলেছে, শুনেছি ঘটনা। পরিবারের পক্ষ থেকে লিখিত অভিযোগ পাওয়া গেলে আইগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পোশাকমালিকদের সৌজন্যে পাওয়া শিল্প-পুলিশের গাড়িতে চড়া পুলিশ যে এতটুকু বলেছে, তাতেই আমাদের ধন্য হওয়া উচিত। ফাহিমার স্বামী শ্রমিক মিরাজুল ইসলাম কোনো অভিযোগ নিয়ে পুলিশ-আদালত করবেন না বলে আগেই জানিয়েছিলেন। ২৫ ডিসেম্বর প্রথম আলোর পাবনার আলোকচিত্রী প্রতিনিধির কাছে আবার তা-ই বলেছেন। মিরাজুল খুব ভালো করেই জানেন, বিচার চাইলে, অভিযোগ জানালে কী হয়। তাঁর এখন চিন্তা, চাকরি বাঁচিয়ে কীভাবে তিনি তাঁর প্রতিবন্ধী সন্তানকে বড় করবেন। ফাহিমা তাঁদের একমাত্র সন্তান বাক্‌প্রতিবন্ধী জাকিরের (৮) অসুস্থতার খবর শুনে ছুটি নিয়ে ছুটে গিয়েছিলেন শ্বশুরবাড়ি। জাকির তার দাদা-দাদির কাছেই থাকত।

সাভার সদর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত কার্যালয়ের সামনে স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপের কাজীপুর ফ্যাশনস লিমিটেড কারখানা। সেখানেই ছয়তলার ফিনিশিং শাখায় অপারেটরের কাজ করতেন ফাহিমা খাতুন (২৮)। থাকতেন স্বামীর সঙ্গে কলমা এলাকার নুরুল হকের বাড়িতে। তিন বছর ধরে তিনি কাজীপুর ফ্যাশনস লিমিটেডে কাজ করছিলেন।

অসুস্থ সন্তানকে দেখে ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হন ফাহিমা। তাঁর ডান হাত ভেঙে না গেলেও ১৮টি সেলাই দেওয়া হয়। আহত অবস্থাতেই ছুটির নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কারখানায় এসে দুর্ঘটনার কথা আর হাতের অবস্থা কর্তৃপক্ষকে সশরীরে জানান। এ সময় গালিগালাজ করে কর্তৃপক্ষ তাঁকে কারখানা থেকে বের করে দেয় বলে অভিযোগ। এরপর তিনি নিজের চিকিৎসা করিয়ে ২৩ ডিসেম্বর আবার কাজে যোগ দিতে কারখানায় আসেন। কর্তৃপক্ষ তাঁকে কাজে যোগদানের অনুমতি না দিয়ে সবার সামনে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করলে তিনি ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়েন। অন্য কারখানার শ্রমিক স্বামী মিরাজুল দুর্ঘটনার খবর পেয়ে কাজীপুর ফ্যাশনস লিমিটেডে ছুটে যান। ততক্ষণে করিতকর্মা কর্তৃপক্ষ ফাহিমার দেহ ঢাকা মেডিকেলে পাঠিয়ে দেয়। রিয়াজুল ফাহিমার লাশ পান ঢাকা মেডিকেলে।

কারখানার ব্যবস্থাপক মো. রেদুয়ানুল হক সংবাদকর্মীদের জানিয়েছেন, ফাহিমা কয়েক দিন ছুটিতে ছিলেন। নিয়ম হলো মেডিকেল থেকে রিপোর্ট নিয়ে এসে কাজে যোগ দিতে হবে। কিন্তু তিনি এটি না করে সরাসরি কাজে যোগ দিতে আসেন। পরে নাকি তাঁরা শুনতে পেরেছেন, ফাহিমা ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছেন। তবে তাঁদের অনেক মেহেরবানি, বিষয়টি তাঁরা খতিয়ে দেখবেন। তবে ফাহিমার মৃতদেহ দাফন করার যাবতীয় ব্যবস্থা তাঁরা নিয়েছেন। দাফন হয়ে গেছে বড়দিনের দিন, ২৫ ডিসেম্বর।

ফাহিমাই কি প্রথম?
সোমবার ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৯ বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ-বিলসের উদ্যোগে ‘শোভন কাজ ও কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা পরিস্থিতি-২০১৯’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী তৈরি পোশাক শিল্পে ২০১৯ সালে সহিংসতায় হতাহত হয়েছে ১২৫ জন শ্রমিক, যার মধ্যে পুরুষ ৩৯ জন এবং নারী ৮৬ জন এবং এর মধ্যে ৩৮ জন নিহত, ৭৫ জন আহত, ৫ জন নিখোঁজ হয়েছে এবং আত্মহত্যা করেছে ৭ জন।

প্রতবিদেন উপস্থাপন অনুষ্ঠানে এ বছরেরই (৬ মার্চ) রাজধানীর শান্তিনগর ইপোক গার্মেন্টসের পাঁচতলার ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়েন নাসরিন আক্তার (১৯) নামের এক নারী পোশাকশ্রমিক। ওই ঘটনাকেও আত্মহত্যা বলে জানানো হয়েছিল। চট্টগ্রামের ফোর এইচ অ্যাপারেলসের নারী শ্রমিক হাজেরা খাতুন কাপড় চুরির অপবাদে গত ১০ মার্চ আত্মহত্যা করেন। গত ১৭ মার্চ আত্মহত্যা করেন গাজীপুরের লাভলী। মাসের পর মাস বেতন না পেয়ে লাভলী আত্মহত্যা করেন। লাভলীর বেতন তবু বকেয়াই থেকে যায়।

গত ৬ অক্টোবর চট্টাগ্রামের কর্ণফুলী ইপিজেডের হেলা ক্লথিং বিডি লিমিটেডের বিল্ডিং থেকে পড়ে যাওয়া নারী শ্রমিক আমেনার মৃত্যুকে আত্মহত্যা হিসেবে চালানোর চেষ্টা চলে। নিহত শ্রমিকের পরিবার এখনো দাবি করে, কারখানার কর্তাব্যক্তিদের কুপ্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় আমেনাকে ফেলে দেওয়া হয়েছে। মৃত্যুর আগে তাঁর বোনকে বলে যাওয়া অডিও রেকর্ডই তার বড় প্রমাণ। পুলিশ বলছে, তদন্ত চলছে। আমেনা এখন শুয়ে আছেন তাঁর গ্রামের বাড়ি বাঁশখালীর কবরে।

ঘটনাগুলো খতিয়ে দেখা হোক বা না হোক, পোশাকশিল্প খাতের নারীরা যে নির্যাতনমূলক ব্যবস্থাপনার নিষ্ঠুর শিকার হচ্ছেন, তাতে কোনো ভুল নেই। সাভার হত্যাকাণ্ড (রানা প্লাজা হত্যাকাণ্ড) কি শুধুই অবকাঠামোর পতন ছিল, নাকি জবরদস্তির ফলাফল ছিল। সেদিন শ্রমিকদের কাজে যোগ দিতে বাধ্য করা হয়েছিল। এটাই আমাদের পোশাক খাতের সুশাসন। মজবুত ইমারতেও বন্ধ হবে না এমন সব মৃত্যু। পোশাকশিল্পের নারী শ্রমিকদের অন্য সব অধিকার না থাকলেও আত্মহত্যার অধিকার আছে। এটাই-বা কম কী!

গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক ও গবেষক।