যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে নর্দার্ন ট্রায়াঙ্গলকে অনিরাপদ করেছে

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: রয়টার্স
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: রয়টার্স

২০১৯ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গুয়াতেমালা, হন্ডুরাস ও এল সালভাদরের সঙ্গে একটি চুক্তি করেছেন। ‘সেফ থার্ড কান্ট্রি’ শীর্ষক এই চুক্তি অনুযায়ী হন্ডুরাস ও এল সালভাদরের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় প্রার্থনার আগে গুয়াতেমালায় আশ্রয় চাইতে হবে। এর ফলে লাতিন আমেরিকান আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় পাওয়াটা চরম অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এ চুক্তি অনুযায়ী শুধু স্থলপথে মার্কিন সীমান্ত পাড়ি দেওয়া অভিবাসীদেরই আটকে দেওয়া হবে না, সমুদ্রপথে যুক্তরাষ্ট্রে আসা অভিবাসীদেরও প্রতিহত করা হবে। 

তবে এল সালভাদরের প্রেসিডেন্ট নায়িব বুকেলে সম্প্রতি স্বীকার করেছেন যে তাঁর দেশকে ‘আরও নিরাপদ’ করা দরকার এবং বর্তমানে দেশটির কাউকে আশ্রয় দেওয়ার ক্ষমতা নেই।

প্রকৃতপক্ষে, নর্দার্ন ট্রায়াঙ্গল নামে পরিচিত কথিত ‘নিরাপদ তৃতীয় দেশে’ মানুষ হত্যার হার ধারাবাহিকভাবে বিশ্বের সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে। এতে সহজেই বোঝা যায় যে এই দেশগুলো আর যা-ই হোক নিরাপদ নয়। দেশ তিনটিতে প্রচুর নারী হত্যার ঘটনাও ঘটে থাকে।

এই তিনটি দেশে সহিংসতা বৃদ্ধিতে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা কয়েক দশক ধরে সুপরিচিত ডানপন্থী স্বৈরশাসকদের এবং মৃত্যুদণ্ডকে সমর্থন করার অভ্যাস থেকে নরঘাতী রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর পক্ষে অব্যাহত সমর্থন পর্যন্ত। এখন এসব দেশে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ব্যবহৃত হচ্ছে। ২০০৯ সালে হন্ডুরাসে যুক্তরাষ্ট্রের উসকানিতে অভ্যুত্থানের পর সেই দেশ আগের চেয়ে বেশি অনিরাপদ হয়ে উঠেছে। 

দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোর সীমান্তে অবশ্য মার্কিন অস্ত্রের ঝনঝনানি নতুন কিছু নয়। মধ্য আমেরিকায় নিযুক্ত অ্যালকোহল, আগ্নেয়াস্ত্র ও বিস্ফোরক–বিষয়ক মার্কিন ব্যুরোর সাবেক অ্যাটাশে হ্যারি পেনেট ২০১৪ সালে বলেছিলেন, এই অঞ্চলে সহিংসতা সংঘটনে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, যার কারণে বহু মানুষ উত্তর আমেরিকার দিকে আশ্রয়ের জন্য ছুটে যাচ্ছে।

সে সময় পেনেটের অনুমান অনুসারে, এল সালভাদরের অবৈধ অস্ত্রের অর্ধেক এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের দ্য নিউ ইয়র্কার পত্রিকার সাংবাদিক জোনাথন ব্লিৎজার এক প্রতিবেদনে লিখেছিলেন যে এল সালভাদর থেকে উদ্ধার হওয়া অবৈধ ও অনিবন্ধিত অস্ত্রের ৪৯ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছে; হন্ডুরাসে এটি ছিল ৬৪ শতাংশ এবং গুয়াতেমালায় ২৯ শতাংশ। আর এসব অস্ত্রের কারণে এই দেশগুলোতে সহিংসতার ঘটনা বহু গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

এল সালভাদরের একজন নৃতাত্ত্বিক, লেখক ও এমএস-১৩ গ্যাং (যুক্তরাষ্ট্রের একটি অপরাধী চক্র) সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ হুয়ান হোসে মার্টিনেজ ডি’আউবুইসন সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন, যদিও খুব বিখ্যাত একটা মিথ প্রচলিত আছে যে এই অঞ্চলে পাওয়া অস্ত্রগুলো গৃহযুদ্ধের সময়কার অস্ত্র, কিন্তু সত্যি ঘটনা হচ্ছে বিভিন্ন সহিংস ঘটনায় যেসব অস্ত্র ব্যবহৃত হচ্ছে, সেগুলো যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি বন্দুক, কোনো সামরিক গ্রেডের অস্ত্র নয়।

মার্টিনেজ বলেছেন, এই সব অস্ত্রের মধ্যে অনেকগুলো যুক্তরাষ্ট্র থেকে সাধারণত বৈধভাবে এল সালভাদরে প্রবেশ করে। তবে পরে সেগুলো কালোবাজারে চলে যায়। আরেকটি বিষয়, যা উপেক্ষা করা উচিত নয় তা হলো, অনুমোদিত দোকান থেকে অস্ত্র কেনা ব্যক্তিরাই ঘন ঘন সহিংসতায় লিপ্ত হচ্ছে। তীব্র নিরাপত্তাহীনতার কারণে এখন শুধু নর্দার্ন ট্রায়াঙ্গলেই নয়, গোটা লাতিন আমেরিকাজুড়ে ব্যক্তিগত সুরক্ষা নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। আর এই সুযোগে গড়ে উঠেছে অসংখ্য প্রাইভেট সিকিউরিটি কোম্পানি। ২০১৭ সালে শুধু হন্ডুরাসেই ছিল ১ হাজার ৩৮টি নিবন্ধিত প্রাইভেট সিকিউরিটি কোম্পানি। এ ছাড়া অনিবন্ধিত বহু কোম্পানি রয়েছে।

তবে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, নর্দার্ন ট্রায়াঙ্গলে এই প্রাইভেট সিকিউরিটি কোম্পানিগুলোই অপরাধী গোষ্ঠীগুলোর প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী, যেহেতু আমদানি করা অস্ত্রগুলো চুরি হয়েছে, হারিয়ে গেছে অথবা কোনো না কোনোভাবে কালোবাজারে পৌঁছে গেছে। আরও উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, এসব প্রাইভেট সিকিউরিটি কোম্পানিতে সাবেক ও বর্তমান পুলিশ এবং সেনা কর্মকর্তারা কাজ করছেন। এল সালভাদরে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের প্রাইভেট সিকিউরিটি ফার্মগুলোতে কাজ করার বা ফার্ম গঠনের অনুমতি দেওয়া হয়। এদিকে গুয়াতেমালায় প্রাইভেট সিকিউরিটি কোম্পানিগুলো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। 

নভেম্বর ২০১৮ সালে মায়ামি হেরাল্ড পত্রিকা রাজনৈতিক প্রতিবাদকারীদের হত্যার জন্য হন্ডুরাস সামরিক পুলিশের মার্কিন অস্ত্রের ব্যবহার সম্পর্কে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে। অন্য দেশগুলোতে মার্কিন অস্ত্রের সরাসরি বিক্রি করার সময় কীভাবে ‘মানবাধিকার উদ্বেগ’ বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে,
সে বিষয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের উদ্ধৃতি দিয়ে নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়।

তবে শেষ পর্যন্ত মুনাফা সব সময় মানবাধিকারকে ছাপিয়ে যায় এবং মার্কিন অস্ত্রশিল্প সম্ভবত এই মুহূর্তে বেশ সুরক্ষিত বোধ করছে। 

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত
বেলেন ফার্নান্দেজ মার্কিন লেখক ও সাংবাদিক