মার্কা নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই

আমাদের আশপাশে কত–কী ঘটছে—গণমাধ্যমের কল্যাণে চটজলদি তার খবর পেয়ে যাই। অনেক কাগজে নানান মতলব থেকে সংবাদ ছাপা হয়ে থাকে। কখনো-সখনো কিছু খবর আড়াল করা হয়। কিন্তু ছবি কথা বলে। এখন তো ফেসবুকে নাগরিক সাংবাদিকতার জয়জয়কার। অনেক আজেবাজে খবরের পাশাপাশি কিছু অনুসন্ধানী তথ্যও পাওয়া যায়।

একদিন দেখলাম, ঢাকার দুই মেয়রের একজন মহাসমারোহে লোকলস্কর নিয়ে রাস্তা ঝাঁট দিচ্ছেন। কত লোক, কেউ তো গুনে দেখেনি। খবরের শিরোনাম হলো হাজার লোক নিয়ে রাস্তা সাফ—গিনেস রেকর্ডসে এটা নাকি উঠে গেছে। এ উপলক্ষে অংশগ্রহণকারীরা সবাই নতুন টি–শার্ট, টুপি পেলেন। ওই সময় ডেঙ্গুর আক্রমণে নগরবাসী ছিল জেরবার। আমরা খুব আনন্দ পেলাম, পথঘাট পরিষ্কার থাকলে মশা ধ্বংস হবে, ডেঙ্গু হবে না।

আরেক মেয়র কি বসে থাকবেন? তিনি আরও এককাঠি সরস। কয়েকজনকে নিয়ে নেমে গেলেন রাস্তায়। একজন ময়লা ফেলছে, আর তিনি প্লাস্টিকের বেলচা দিয়ে ওই ময়লা ট্রলি-বিনে ফেলছেন। দেখে আমরা খুব মজা পেলাম।

গত বছর দেশে ডেঙ্গু ছিল অনেকটা মহামারির মতো। হাসপাতালগুলো আক্রান্ত রোগীর ভিড় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছিল। তখন শুনলাম আরও মধুর বচন—উত্তরের মশা দক্ষিণে আসে, দক্ষিণের মশা উত্তরে যায়। ঢাকা সিটি করপোরেশন যে দুই ভাগ হয়ে গেছে, মশা মশাই তো জানেন না! দোষ মশারই।

নগরবাসী দেখতে চায় কাজ। কৌতুক কখনো কখনো আনন্দ দেয়। কিন্তু কখনো যে তা বিরক্তিকর হতে পারে—নগরপাল এটা বোঝেন না। আর্ট ফিল্মের অভিনয় তো যাত্রাপালায় চলে না। অভিনয়টুকু শিখতে হয়। অনেক নগরবাসীর অপেক্ষা, কবে কুশীলব বদলাবে। তো পালাবদলের মাহেন্দ্রক্ষণ এসে গেছে। এ বছর জানুয়ারির শেষে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। এ নিয়ে মাঠ বেশ গরম। এ পর্যন্ত প্রধান দুই দলের প্রার্থীদের নাম জানা গেছে। আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরু না হলেও কায়দা করে নানামুখী প্রচার চলছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছিল এক বছর আগে। এরপর এটাই হবে বড়সড় একটা নির্বাচন। সাংবাদিক আর বিশ্লেষকদের দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়ে গেছে। টিভি চ্যানেলগুলো এ নিয়ে নানান অনুষ্ঠান সাজাবে। দর্শক-শ্রোতাদের কাছে এটা কখনো বিনোদন, কখনোবা অত্যাচার। সেই তো একঘেয়ে কথা। পুরোনো কাসুন্দি ঘাঁটা।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, হেরে গেলে বিরাট কোনো ক্ষতি হয়ে যাবে না। এটা শুনে কেউ কেউ আসমানের চাঁদ মুঠোয় পুরে ফেলছেন। তার মানে, দলের প্রার্থীর হেরে যাওয়ার আশঙ্কা ক্ষমতাসীন দল নাকচ করে দিচ্ছে না। নির্বাচন যে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে, এটা তার আগাম আভাস।

কেউ কি কখনো বলে যে—আমি জোর করে জিতব? আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ হলো বিএনপি। এই দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু হবে না। তবু আমরা নির্বাচনে যাচ্ছি আন্দোলনের অংশ হিসেবে। এটা আবারও প্রমাণিত হবে যে সরকার নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে করবে না।’

কথা–চালাচালি চলতেই থাকবে মাসজুড়ে। কে কী বলবেন, তা ইতিমধ্যে আমাদের মুখস্থ হয়ে গেছে, এঁদের মধ্যে যাঁরা নির্বাচিত হবেন, তাঁরা পাঁচ বছর পর পরবর্তী নির্বাচনের আগে কী বলবেন, তা–ও মোটামুটি জানা। তাঁরা বলবেন, আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। নগরে অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান কাজ করে। এদের কাজের মধ্যে সমন্বয় নেই। নগর সরকার না হলে কাজের কাজ হবে না ইত্যাদি।

নগর সরকার বা সিটি গভর্নমেন্ট হলো স্বাধীন একটি প্রতিষ্ঠান। অনেকটা রাষ্ট্রের মধ্যে আরেকটি রাষ্ট্র। যাঁরা রাষ্ট্র চালান, তাঁরা প্রতিদ্বন্দ্বী পছন্দ করেন না, নিজ বলয়ে আরও কেউ ক্ষমতাশালী হোক, এটা চান না। তাই নগর সরকার হয় না। হবেও না।

নগর সরকার না হলেও করপোরেশনের অনেক কিছু করার আছে। পৌরসভাগুলো দেড় শ বছর ধরে যা করে আসছে বা যা তাদের করার কথা, সেটি ভালোভাবে করলেই তো নাগরিকেরা অনেকটা স্বস্তি পায়। মশা মারা, রাস্তায় বিজলিবাতি, রাস্তাঘাট চলাচলের উপযোগী রাখা—সারা বছর এগুলো ঠিকঠাকভাবে করতে পারলে বাকিটা নিয়ে আলোচনা করা যায়। তো, তাঁরা তাঁদের ম্যান্ডেট অনুযায়ী কাজ করছেন না? একজন তো হুমকি দিয়েছিলেন, কারও বাড়ির ভেতরে এডিস মশা পেলে তাকে গ্রেপ্তার করা হবে। পরে দেখা গেল সিটি করপোরেশনের অফিসই এডিস মশার আঁতুড়ঘর। গণমাধ্যম বড় নির্মম। তারা অনেক সময় মানীর মান রাখে না। উল্টাপাল্টা ছবি ছাপিয়ে দেয়।

বিএনপি মনে করে, সুষ্ঠু ভোট হলে তাদের প্রার্থীরা জিতবেন। দেখা যাচ্ছে, কাউন্সিলর পদে ৫০ জনের মতো ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী। জেতার সম্ভাবনা না থাকলে এত লোক নির্বাচন করার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়তেন না। ইতিমধ্যে একজন প্রার্থী গ্রেপ্তার হয়েছেন বলে জানা গেছে। এ নিয়ে মেয়র প্রার্থী রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ করেছেন। তাঁর নামে নাকি মামলা আছে। কথা হলো, মামলা তো আছেই। কিন্তু গ্রেপ্তার করার কি আর কোনো সময় পাওয়া গেল না? মনে হয়, এ রকম গ্রেপ্তার আরও হতে পারে। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়ও এমনটি দেখা গিয়েছিল। রিটার্নিং কর্মকর্তা অবশ্য বলেছেন, ‘বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।’ অতি পুরোনো কথা।

একজন নির্বাচন কমিশনার কয়েক দিন আগে আশঙ্কা জানিয়ে বলেছিলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু না–ও হতে পারে। একজন মন্ত্রী সঙ্গে সঙ্গেই তাঁকে পদত্যাগ করতে বলেছেন। তিনি পদত্যাগ করবেন কি করবেন না, এটা নির্ভর করে তিনি কী পরিমাণ চাপে আছেন বা চাপ সামলানোর ক্ষমতা তাঁর কতটুকু। আমরা জানি, মন্ত্রী চাইলেই তাঁকে বরখাস্ত করতে পারবেন না। সরকারের সেই ক্ষমতা নেই। তাঁকে সরাতে হলে জাতীয় সংসদে তাঁকে ‘ইমপিচ’ করতে হবে। সরকার চাইলে সেটা করতে পারে। আমার ধারণা, সরকার ওপথে হাঁটবে না। নির্বাচন কমিশনে ‘ভিন্নমতের’ একজন আছেন এবং সরকার তাঁকে সহ্য করে চলছে—এটাও গণতন্ত্রের সৌন্দর্য।

নির্বাচনের মাঠে মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টির প্রার্থীরাও আছেন। মেয়র পদে তাঁদের নির্বাচিত হওয়ার তেমন কোনো সম্ভাবনা দেখি না। তবে মহাজোটের ভেতরে সালিস এবং দেনদরবার করে কয়েকটা কাউন্সিলর পদ তাঁরা পেয়েও যেতে পারেন। আওয়ামী লীগ তো জোটের রাজনীতি করে। তারা এ ক্ষেত্রে একধরনের বণ্টনবিধি অনুযায়ী চলবে। জাতীয় পার্টির কেউ জিতলে আওয়ামী লীগের কোনো ক্ষতি নেই। তাঁরা তো ঘরেরই মানুষ।

নির্বাচনের আগে বড় ধরনের সহিংসতার আশঙ্কা দেখি না। গত জাতীয় নির্বাচনটিও মোটামুটি অহিংস হয়েছিল। মেয়র প্রার্থীরা সবাই তরুণ, উচ্চশিক্ষিত এবং ধনবান। কাউন্সিলর প্রার্থীদের আমলনামা দেখলে বোঝা যাবে, তাঁরা কোন কাননের ফুল। নির্বাচন কমিশনে দেওয়া হলফনামা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে তাঁদের বৃত্তান্ত জানা যাবে।

এ নির্বাচন নিয়ে আগাম পূর্বাভাস দেওয়া কি জরুরি? বাজারে একটা প্রচার আছে—একজনকে রেখে আরেকজনকে কোরবানি দেওয়া হতে পারে। আমার কাছে এটা স্রেফ গুজব মনে হয়। বছরজুড়ে ‘মুজিব বর্ষ’ পালন করা হবে। নিজেদের মেয়র ছাড়া সরকারি দল এটি কেন উদ্‌যাপন করতে চাইবে? তাহলে কি তারা জোর করে জিতবে? আওয়ামী লীগের দাবি, তারা সবচেয়ে জনপ্রিয়, সবচেয়ে শক্তিশালী দল। সুতরাং তারা জিতবেই।

আগামী পাঁচ বছর সিটি করপোরেশনে কারা ঠিকাদারির কাজ পাবে, এ নিয়ে আড়ালে–আবডালে হয়তো প্যানেল হচ্ছে। নির্বাচনে ক্ষমতার হাতবদল হলে ঠিকাদার বদলায়—এটাই নগরবাসীর অভিজ্ঞতা। তারপরও সবাই আশা করে, ঢাকা তিলোত্তমা হবে। সিঙ্গাপুর-কুয়ালালামপুর-সাংহাই না হোক; পরিচ্ছন্ন, যানজটমুক্ত এবং পথচারীবান্ধব একটি নগর হোক, এটাই তো প্রত্যাশা। এটা পেলে নাগরিকেরা মার্কা নিয়ে মাথা ঘামাবে না।

মহিউদ্দিন আহমদ: লেখক ও গবেষক
[email protected]