নারীর জীবন, ভয়ের জীবন

খুব ভয় হচ্ছে আমার। ভীষণ, ভীষণ ভয়। ভয় হচ্ছে নিজের জন্য, ভয় হচ্ছে আমার কিশোরী কন্যাটির জন্য। এ ভয় আক্রান্ত হওয়ার। এ ভয় যখন-তখন যেকোনো জায়গায় ধর্ষণের শিকার হওয়ার। বিকেল পাঁচটা মানে তখনো দিনের আলো মরেনি। এই দিনের আলোয় যদি রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে কোনো মেয়েকে ধর্ষণ করা যায়, তাহলে বলুন কেন ভয় পাব না আমি?

আমিও যে মাঝে মাঝে একা একা অনেক জায়গায় যাই। কখনো হেঁটে, কখনো রিকশায় বা কখনো বাসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীটির ক্ষেত্রে যেমনটি ঘটেছে, একা পেয়ে আমাকে কেউ রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করবে না, এমন ভরসা তো এখন আর আমি পাচ্ছি না। আমার মনে হয়, এ ভয় শুধু আমার নয়, দেশের আরও বহু নারীর। তাঁরাও আমার মতোই আক্রান্ত হওয়ার, ধর্ষণের শিকার হওয়ার ভয় পাচ্ছেন।

পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ৫ জানুয়ারি রোববার বিকেলে বান্ধবীর বাসায় যেতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়েরই একটি বাসে ওঠেন। বাস থেকে কুর্মিটোলা এলাকায় নামার পর অজ্ঞাতপরিচয় একজন তাঁর মুখ চেপে ধরে। এরপর পাশের ঝোপে নিয়ে তাঁকে ধর্ষণ করা হয়। এখন পর্যন্ত জানা গেছে একজনই এর ঘটনা ঘটিয়েছেন। তার মানে খুব বেশি ঝামেলা পোহাতে হয়নি ধর্ষককে। রুমালে চেতনানাশক মিশিয়ে নাকে চেপে ধরলেই হলো, ব্যস, কেল্লাফতে। তা হলে তো আমার নাকেও যে কেউ রুমাল চেপে ধরতে পারে। চেতনা হারালে চিৎকারও করতে পারব না। ফলে নিজেকে রক্ষার তো আর কোনো উপায়ই থাকবে না। কী ভয়াবহ ব্যাপার!

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণের ঘটনায় বিক্ষোভ হচ্ছে, মানববন্ধন হচ্ছে। বিক্ষোভকারীরা অবিলম্বে ধর্ষককে গ্রেপ্তারের দাবি ও কঠিন শাস্তির দাবি জানাচ্ছেন। যখন এই লেখা লিখছি তখনো ধর্ষণ বা এর সঙ্গে জড়িত হিসেবে কারও গ্রেপ্তারের খবর পাইনি। পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে। হয়তো তারা ধর্ষককে গ্রেপ্তারে সক্ষম হবে। কিন্তু কঠিন শাস্তি কি আদৌ নিশ্চিত করা যাবে? পাঠক, কেন এই প্রশ্ন জেগেছে? কারণ, আগেও তো দেশে কত মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়েছে। কিন্তু খুব কম ক্ষেত্রেই ধর্ষকের কড়া শাস্তি হয়েছে।

২০১৭ সালে বনানীর রেইনট্রি হোটেলে দুজন বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত হন পাঁচ যুবক। তাঁদের মধ্যে ছিলেন আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে সাফাত আহমেদ। প্রথম কয়েক দিন এ ঘটনায় ব্যাপক হইচই হয়। ধর্ষণের ঘটনায় মামলা হওয়ার পর আসামিরা ধরাও পড়েন। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেই মামলার কোনো সুরাহা হয়নি। আসামিরা আসলেই কোনো শাস্তি পাবেন কি না, কে বলতে পারে। বহুল আলোচিত তনু ধর্ষণ ও হত্যা মামলার আসামিদের তো এখনো চিহ্নিতই করা যায়নি। এ রকম আরও বহু নজির আছে বিচার না হওয়ার, শাস্তি না পাওয়ার। তাহলে বলুন, ভয় পাব না কেন নিজেকে নিয়ে।

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ১ হাজার ৪১৩ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিল ৭৩২ জন। অর্থাৎ আগের বছরের তুলনায় ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে দ্বিগুণ। ২০২০ সালে এই সংখ্যা যে বেশি হবে, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। কারণ, এটা এখন সবার জানা হয়ে গেছে, ধর্ষণ করলে কিছু হয় না।

সত্যি এই দেশে মেয়েরা কী অসহায়! কোথাও তাঁদের কোনো নিরাপত্তা নেই। তাঁরা যে শুধু রাস্তাঘাটে আক্রান্ত হচ্ছেন তা নয়। বাড়িতে, কর্মস্থলে, গণপরিবহনে সবখানেই তাঁরা নিগৃহীত হচ্ছেন। কিন্তু এসবের কোনো প্রতিকার নেই। দেশে যৌন হয়রানি প্রতিরোধের একটি নীতিমালা রয়েছে। নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে আইন রয়েছে। কিন্তু এ দেশে প্রতিদিন যে হারে নারীরা যৌন হয়রানি, ধর্ষণসহ নানা ধরনের সহিংসতার শিকার হচ্ছেন, তাতে এসব আইন ও নীতিমালা যে অসার, তা প্রমাণিত হয়েছে। এসব আইন ও নীতিমালার কোনো প্রয়োগ বলতে গেলে নেই-ই।

মনে প্রশ্ন জাগে, কবে আমাদের দেশের নারীরা নিরাপদে চলাচল করতে পারবেন, নাকি এ রকম চলতেই থাকবে? আমরা নারীরা কি সব সময় নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতেই থাকব? কোথাও কি আমরা একা একা যেতে পারব না? তাহলে কি আমাদের সব সময় কাউকে না কাউকে সঙ্গে নিয়ে বের হতে হবে? তাতেও যে রেহাই পাব এমন নিশ্চয়তা কই। স্বামীকে বেঁধে রেখে স্ত্রীকে দল বেঁধে ধর্ষণের ঘটনা তো প্রায়ই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তবে কি এই ভয়ের রাজ্যেই আমাদের বসবাস করতে হবে? কে আমাদের মনের ভয় দূর করার দায়িত্ব নেবে? আদৌ কেউ নেবে কি?

রোকেয়া রহমান: সাংবাদিক