আঞ্চলিক নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলবে

কক্সবাজারের উখিয়ার মধুরছড়া আশ্রয়শিবিরে রোহিঙ্গা বসতি। প্রথম আলো ফাইল ছবি
কক্সবাজারের উখিয়ার মধুরছড়া আশ্রয়শিবিরে রোহিঙ্গা বসতি। প্রথম আলো ফাইল ছবি
>

প্রথমা প্রকাশন থেকে রোহিঙ্গা: নিঃসঙ্গ নিপীড়িত জাতিগোষ্ঠী শিরোনামের একটি বই প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। বইটির লেখক মিয়ানমারে বাংলাদেশের সাবেক কনস্যুলেট প্রধান মেজর (অব.) মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম। সেই বইয়ের অংশবিশেষ; যেখানে বাংলাদেশ, ভারত, চীন ও মিয়ানমার—এই দেশগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক, স্বার্থ ও আঞ্চলিক নিরাপত্তার বিভিন্ন দিক আলোচিত হয়েছে, তা প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য তিন পর্বে ধারাবাহিকভাবে ছাপা হচ্ছে। আজ তৃতীয় ও শেষ পর্ব।

১১ লাখ নিপীড়িত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বর্তমান শিবির জীবনের মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য করার পর কেউ যদি মনে করে, এটা এই অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য কোনো প্রকার হুমকি সৃষ্টি করবে না, তবে তা ভবিষ্যতে ভুল বলে প্রতীয়মান হতে পারে। এ প্রসঙ্গে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের সাম্প্রতিক একটি বক্তব্য উল্লেখযোগ্য। তাঁর বক্তব্যের মর্মার্থ হলো, ‘রোহিঙ্গাদের এক চরম বৈষম্যমূলক অবস্থায় নিপতিত রাখা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে রোহিঙ্গাদের তাদের দলে ভেড়ানোর সুযোগ করে দেওয়ার শামিল।’

জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব প্রয়াত কফি আনান রাখাইন স্টেটের ওপর তাঁর প্রণীত প্রতিবেদনে রোহিঙ্গাদের প্রতি নিপীড়ন, নির্যাতন ও বৈষম্যমূলক আচরণের আশু অবসানে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলেছেন। অন্যথায় ভবিষ্যতে এই অঞ্চলে উগ্রপন্থা তথা জঙ্গিবাদের উত্থানের আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন এবং তেমন পরিস্থিতির উদ্ভব হলে তা শুধু আমাদের এই অঞ্চল নয়, গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে অস্থিতিশীল করে তুলবে।

জনগণকে তার ন্যায়সংগত অধিকার থেকে বঞ্চিত করলে, তার দুঃখ-দুর্দশার প্রতি নজর না দিলে তারা উগ্রপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়বে। কফি আনান এখানে রোহিঙ্গা শব্দটি উল্লেখ না করে ‘পপুলেশন’ বা জনগণ বলেছেন। এর কারণ কমিশন মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় কাউন্সেলর অং সান সু চির অনুরোধে তাদের প্রতিবেদনে রোহিঙ্গা শব্দটি পরিহার করে এবং রাখাইন অঞ্চলের মানুষদের বাঙালিও আখ্যায়িত না করে মুসলমান অথবা রাখাইন অঞ্চলের মুসলমান জনগোষ্ঠী হিসেবে উল্লেখ করেন।

জাতিসংঘের বর্তমান মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এবং সাবেক মহাসচিব কফি আনানের আশঙ্কা মোটেও অমূলক নয়। ‘মিয়ানমার সেনাবাহিনী মানুষের জীবন, স্বাধীনতা, জীবনের প্রতি সম্মান ইত্যাদির প্রতি যে অবজ্ঞা, আন্তর্জাতিক আইনকানুনের প্রতি যে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে চলেছে, তার মারাত্মক প্রভাব মিয়ানমারের নিরাপত্তা ও উন্নয়ন প্রচেষ্টায় পড়তে বাধ্য। তাদের এই মনোভাব শুধু আঞ্চলিক নিরাপত্তা নয়, বরং আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা, নিরাপত্তা ও শান্তির প্রতিও হুমকিস্বরূপ।’

মিয়ানমারকে ঘিরে চীনের ভূকৌশলগত ও ভূরাজনৈতিক পরিকল্পনা রয়েছে। এ পরিকল্পনা ভন্ডুল করতে মিয়ানমারকে অস্থিতিশীল করে তুলতে তৃতীয় পক্ষ হাত বাড়ালে তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না। ইতিমধ্যে চীনের বিরুদ্ধে আমেরিকা প্রকাশ্যে বাণিজ্যযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে মাইকেল পোলিসবরি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ দ্য হানড্রেড ইয়ার ম্যারাথন: চায়না’স সিক্রেট স্ট্র্যাটেজি টু রিপ্লেস আমেরিকা অ্যাজ দ্য গ্লোবাল সুপারপাওয়ার বইয়ে ২০৪৯ সালের মধ্যে চায়না কীভাবে আমেরিকাকে বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতির এক নম্বর পরাশক্তির স্থান থেকে বিচ্যুত করে নিজে সেই স্থান দখলে নেওয়ার পরিকল্পনা এঁটেছে, তার সবিস্তার বর্ণনা দিয়েছেন। ‘আগামী দিনে চায়না এমনই এক বিশ্বব্যবস্থার প্রবর্তন করবে, যা তার জন্য অনুকূল হবে, এমন একটি বিশ্ব, যেখানে আমেরিকার আধিপত্য লোপ পাবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর উডস ও সান ফ্রান্সিসকো প্রতিষ্ঠিত ভূরাজনীতি ও অর্থনীতিতে আমেরিকার আধিপত্যকে খর্ব করে চীনের স্বার্থে সে নতুন বিশ্বব্যবস্থা চালু হবে। আমেরিকা সর্বাত্মকভাবে তার এই অধঃপতন এবং চীনের উত্থানকে ঠেকাতে নিজেকে নিয়োজিত করবে এবং এটাই স্বাভাবিক।’

এ প্রেক্ষাপটে রাখাইনের থা শোয়ে গ্যাসফিল্ড থেকে নির্বিঘ্নে চীন গ্যাস নিয়ে যাবে—হয়তো ভবিষ্যতে আমেরিকা তা চাইবে না, চকপিউ ডিপ সি পোর্টের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগর হয়ে চীন অবাধে ভারত মহাসাগরে বিচরণ করবে, হয়তো আমেরিকা তা-ও চাইবে না। চীন চাইবে রাশিয়া-চীন, মধ্য এশিয়া-চীন, মালাক্কা হয়ে চীন এবং চীনের চতুর্থ বৃহত্তম জ্বালানি সরবরাহ লাইন যেন কোনো হুমকির মুখে না পড়ে। হয়তো আমেরিকা এর উল্টোটাই চাইবে। এই চাওয়া না-চাওয়ার মধ্যেই ভবিষ্যতে মিয়ানমার, বিশেষ করে রাখাইনকে ঘিরে দুই পরাশক্তিধর দেশের সংঘাত দেখা দিতে পারে। সেটা রোহিঙ্গা ইস্যুকে ঘিরে দ্রুততার সঙ্গে ঘনীভূত হতে পারে। এ ধরনের সংঘাতময় দৃশ্যপটে ভারত চীনের সঙ্গে তার বর্তমান ভূরাজনৈতিক অবস্থার আলোকে আমেরিকার পক্ষ নিলে তা এই অঞ্চলের জন্য আরও জটিল এক আঞ্চলিক নিরাপত্তার সংকট তৈরি করবে।

ভূরাজনীতির বিষয়ে আগ্রহী পর্যবেক্ষকমাত্রই এটা লক্ষ করে থাকবেন, চীন ক্রমশ তার ভূকৌশলগত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এগোচ্ছে। বেল্ট অ্যান্ড রোড এ ক্ষেত্রে চীনের ঘোষিত বাহন। ইতিমধ্যে চীন নেপালকে তার নৌবন্দর ব্যবহারের সুযোগ দিয়েছে। ভারতীয় প্রভাববলয়ের ছায়ায় থাকা ভুটানেও চীন তার অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তারে উদ্যোগী হয়েছে। চীন-পাকিস্তানের সম্পর্ক, চীন-ভারতের সম্পর্ক যতই শীতল হয়, ততই উষ্ণতার উচ্চতায় পৌঁছায়। শ্রীলঙ্কাকে নিয়ে ভারত-চীনের দ্বৈরথ ইতিমধ্যে ভূরাজনীতিবিজ্ঞানের ছাত্রদের মধ্যে ঔত্সুক্যের জন্ম দিয়েছে।

চীন-ভারত সম্প্রতি ডোকলামকে ভিত্তি করে যে তুলকালাম কাণ্ডের জন্ম দিয়েছিল, তা বিশ্ববাসীকে শঙ্কিত করে তুলেছিল। ডোকলাম—যার ওপর ভুটান ও চীন উভয়েই কর্তৃত্ব দাবি করে আসছে, সেখানে ২০১৭ সালে চীন সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নিলে ভুটানের স্বার্থ রক্ষায় সেখানে ভারত সৈন্য পাঠায়। ৭২ দিন চীন-ভারত পরস্পর যুদ্ধংদেহী মনোভাব প্রদর্শন করে নিজ নিজ সৈন্য প্রত্যাহার করে।

আশ্চর্যের বিষয়, ভুটানের স্বার্থ রক্ষায় ভারতের এমন ভূমিকার পরও দেখা গেছে, ভুটানিজরা তাদের স্বার্থ রক্ষায় ভারতকে একক ভূমিকায় দেখতে চায় না, বরং তারা অন্যান্য দেশের সঙ্গেও তাদের কৌশলগত সম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী।

রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে মিয়ানমার যদি ব্যর্থ হয়, তবে ভবিষ্যতে রাখাইন অঞ্চলকে ঘিরে দুই অর্থনৈতিক ও সামরিক পরাশক্তি চীন ও আমেরিকার সংঘাত-সংঘর্ষের উদ্ভব হতে পারে। এই আশঙ্কার পেছনে যুক্তি হলো, দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান বাণিজ্যবিরোধ ও সামরিক আধিপত্য বিস্তারের অদম্য আকাঙ্ক্ষা। চীনের অর্থনৈতিক স্বার্থে আঘাত হানতে চাইলে রাখাইন অঞ্চল আমেরিকার জন্য সে সুযোগ এনে দেবে। কারণ, এই অঞ্চল ঘিরে রয়েছে চীনের ব্যাপক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। এর মধ্যে চকপিউ-কুনমিং গ্যাস এবং তেল পাইপলাইন, মিটশোনে ড্যাম, কুনমিং গ্যাস-তেল পাইপলাইন এবং চকপিউ গভীর সমুদ্রবন্দরকে ঘিরে মেরিটাইম সিল্ক রুট গড়ে তুলে স্বপ্নের বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রতিষ্ঠায় চীনের ব্রতী হওয়া ইত্যাদি। এর বাইরেও চীন ত্বরিত মিয়ানমারের তেল, গ্যাস, জলবিদ্যুৎ ও খনিজ সম্পদ আহরণের মতো ৬২টির বেশি প্রকল্পে নিজেদের জড়িত করেছে।

সংঘাতের এ সম্ভাবনা বাস্তবে রূপ নিলে তা মিয়ানমার পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে, এই অঞ্চলকে বিপর্যস্ত করলে তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। অন্যদিকে মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের রয়েছে সুবিস্তৃত সীমান্ত। চীন কখনো চাইবে না তার ঘাড়ের ওপর অন্য কোনো বৃহৎ শক্তি এসে নিশ্বাস ফেলুক। এই লক্ষ্য সামনে রেখে চীন মিয়ানমারের ওপর তার প্রভাবকে অক্ষুণ্ন রাখতে মিয়ানমারকে সর্বক্ষেত্রে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে ও যাবে। এ রকম এক পরিস্থিতিতে চীন বহুপক্ষীয় হস্তক্ষেপে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান চাইবে না। আবার এ-ও সত্য, চীন স্বীয় স্বার্থে মিয়ানমারকে চাপে রাখার কৌশল হিসেবে মিয়ানমারের সংঘাতকে কাজে লাগাতে এবং একধরনের সংঘাতময় পরিস্থিতি সেখানে বিরাজিত থাকুক, সে ব্যাপারেও সচেষ্ট থাকবে।

মিয়ানমার থেকে প্রকাশিত ইংরেজি দৈনিক দ্য ইরাবতীর সঙ্গে এক সাক্ষাত্কারে প্রখ্যাত সুইডিশ সাংবাদিক বার্টিল লিন্টার এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, ‘শান্তি স্থাপন প্রচেষ্টাকারী পশ্চিমা দেশগুলোর মিয়ানমারে তেমন স্বার্থ না থাকলেও চীনের মিয়ানমারে রয়েছে ভূকৌশলগত স্বার্থ, যা চীন অর্জন ও রক্ষণে সচেষ্ট। চীনের এই ভূকৌশলগত স্বার্থের নাম চীন-মিয়ানমার ইকোনমিক করিডর, যার ওপর ভিত্তি করে চীন তার ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের কৌশলগত পরিকল্পনা প্রণয়ন করছে। এ প্রসঙ্গে এ কথা মনে রাখা জরুরি, চীন মিয়ানমারে জাতিগত সংঘাত বন্ধ হয়ে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠিত হোক, তাতে তেমন আগ্রহী হবে না। চীন মিয়ানমারে সেই স্থিতাবস্থা দেখতে চাইবে, যার মাধ্যমে তার কৌশলগত লক্ষ্য অর্জিত হবে। চীন কোনো যুদ্ধ চাইবে না...তবে স্বীয় দ্বন্দ্ব-সংঘাত জিইয়ে রাখতে আগ্রহী হবে ততটুকু, যতটুকুর ওপর ভর করে সে তার কৌশলগত স্বার্থ উদ্ধার করতে সক্ষম হবে। এর অর্থ হচ্ছে, চীন তার ঈপ্সিত মিয়ানমারের মাধ্যমে ভারত মহাসাগরে প্রবেশাধিকার অর্জন না করা পর্যন্ত জাতিগত এ সংঘাত-সংঘর্ষ চলতে থাকবে।’

এক শ বছর আগে হ্যালফোর্ড ম্যাকিন্ডার বিশ্ববাসীর সামনে ‘হার্ডল্যান্ড তত্ত্ব’ হাজির করেছিলেন। এ তত্ত্বের সারবস্তু ‘হার্ডল্যান্ড’ তথা পূর্ব ইউরোপ যে শক্তি শাসন করবে বিশ্ব তথা এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকা তার প্রভাবাধীন থাকবে। তিনি তাঁর তত্ত্বে উল্লেখ করেন, সাগর যে শক্তির কবজায় থাকবে, বিশ্ব সে শক্তি শাসন করবে। কারণ, সাগর অবারিত করবে বাণিজ্য। বর্তমান বাস্তবতায় বিশ্ববাণিজ্যে যে শক্তির যত বেশি প্রসার ঘটবে, বিশ্বকে সে শক্তি তত বেশি কবজায় ও আধিপত্যে নিয়ন্ত্রণের সুযোগ পাবে। এই প্রেক্ষাপটে বর্তমান আমেরিকা-চীনের বাণিজ্যযুদ্ধ। এ বাণিজ্যযুদ্ধে জয়লাভের জন্য এই দুই অর্থনৈতিক ও সামরিক পরাশক্তি সাগর দখলে যেমন মত্ত, তেমনি সাগর সন্নিহিত দেশগুলোকে প্রভাববলয়ে রাখার প্রতিযোগিতাতেও মগ্ন। রোহিঙ্গা সংকট এবং এর বর্তমান প্রেক্ষাপট ও ভবিষ্যৎ সমাধান সার্বিকভাবে এই আলোকে বিচার করাই বাঞ্ছনীয়।

তবে এ-ও সত্য, রোহিঙ্গা সমস্যা প্রলম্বিত হলে চীন চাইলে বা না চাইলেও অন্য শক্তি রোহিঙ্গা ইস্যুতে হস্তক্ষেপের সুযোগ নিতে আগ্রহী হবে। নয়াদিল্লির জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর সাউথইস্ট এশিয়ার নির্বাহী পরিচালক নেহজিনপাও কিপজেন ২ এপ্রিল ২০১৯ ওয়াশিংটনের উইড্রো উইলসন সেন্টারে ‘রোহিঙ্গাদের জন্য এরপর কী’ শীর্ষক আলোচনায় বলেছেন, রোহিঙ্গা সমস্যার আশু সমাধান না হলে রোহিঙ্গারা র‍্যাডিকেলাইজেশনের ঝুঁকিতে থাকবে। আরসা ও আইসিসের মতো মিলিট্যান্ট গ্রুপগুলো এই অঞ্চলে সক্রিয় হয়ে হতাশাগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের দলে টানবে। এ পরিস্থিতি পুরো এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে।

রোহিঙ্গাদের অবহেলিত অবস্থা তাদের যে উগ্রবাদে ঠেলে দেবে, তা ক্রমান্বয়ে স্পষ্ট হবে ও হচ্ছেও। মিয়ানমারের প্রেসিডেন্টের অফিসের মহাপরিচালক উ ঝ থে সম্প্রতি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, মিয়ানমার আইসিসের লক্ষ্যস্থলে পরিণত হতে যাচ্ছে। সম্প্রতি ইরাক ও সিরিয়ায় তাদের বিপর্যয়ের পর মিয়ানমারের উত্তর রাখাইনে তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে। উ ঝ থে এ প্রসঙ্গে উল্লে¬খ করেন, ‘আইএসআইএস প্রধানত স্থানীয়ভাবেই তাদের যোদ্ধাদের গড়ে তুলছে এবং বাইরের যোদ্ধারা স্থানীয়দের সাহায্যে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে, শ্রীলঙ্কায় এমনটিই ঘটেছে।’

মালয়েশীয় পুলিশপ্রধান মোহাম্মদ ফৌজি হারুনকে উদ্ধৃত করে মিয়ানমারের দ্য ইরাবতী পত্রিকার এক নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে, আইসিস এখন দক্ষিণ ফিলিপাইন ও রাখাইন অঞ্চলে তাদের তৎপরতা চালাবে। উ ঝ থে তাঁর বক্তব্যে আরও উল্লেখ করেন, ‘ইন্দোনেশিয়া সন্ত্রাসী আক্রমণের ব্যাপারে আমাদের সতর্ক করেছে।’ রাখাইন বিষয়ে মিয়ানমারের বিশেষজ্ঞ উ মমং শোয়ের ধারণা, ‘২০১৭ সালে রাখাইন অঞ্চলে পরিচালিত সামরিক অভিযানের কারণে বহু রোহিঙ্গা তরুণ বাংলাদেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এই সব তরুণ এখনো তাদের বাস্তুভিটায় ফিরে আসতে পারেনি। শিবিরে বসবাসকারী এই সব তরুণের মনে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আক্রোশ ঘনীভূত হবে। এই আক্রোশ আইএসআইএসকে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনায় সহজ সুযোগ এনে দেবে।’

এএনপির (আরাকান ন্যাশনালিস্ট পার্টি) কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির সদস্য উ পে থান আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, ‘যদি অবস্থার সুযোগ নিয়ে ধর্মীয় উগ্র গোষ্ঠী আত্মঘাতী হামলা চালায়, তবে অবস্থার চরম অবনতি ঘটবে।’

হয়তো এ বিষয়গুলো মাথায় রেখে ৯ এপ্রিল নেপিডোতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সীমান্তসম্পর্কিত উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে আরসা ও আরাকান আর্মি দমনের বিষয়ে ঐকমত্য হয়।

রাখাইনে বর্তমানে চলমান আরাকান আর্মি ও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সংঘাত চরম আকার ধারণ করতে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনী মংডু, বুথিডং, রথিডং, মিনবু, পুনাজ্জম, ম্রা উ, চকউতো ইত্যাদি অঞ্চলে প্রায় ৬৬টি নতুন সেনাক্যাম্প স্থাপন করেছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এই কর্মকাণ্ডে ৩৪ হাজারের বেশি স্থানীয় মানুষ গৃহহারা হয়ে অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছে। উদ্বাস্তু এসব মানুষের মনে যে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হচ্ছে, তা থেকেও এসব নিপীড়িত মানুষ উগ্রবাদে দীক্ষা নিলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না।

বেল্ট অ্যান্ড রোড ঘিরে চায়না এমনই এক বিশ্বব্যবস্থার প্রবর্তনে উদ্যোগী, যেখানে আমেরিকা তার বর্তমান মোড়লগিরি হারাবে। একই কথা বর্তমানে চীনের সঙ্গে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় মত্ত ভারতের জন্যও প্রযোজ্য।

বিষয়টি আমলে নিয়েই হয়তো ২০১৭ সালে বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত প্রথম বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে ভারত যোগদান থেকে বিরত থাকে। ২০১৯ সালের ২৬ এপ্রিল থেকে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় বেল্ট অ্যান্ড সামিটেও ভারত অংশগ্রহণ করেনি। এর পেছনে রয়েছে ভারতের ভূকৌশলগত স্বার্থ। প্রথমত ভারত সিপিইসিকে (চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর) তার সার্বভৌমত্বের ওপর হস্তক্ষেপ বলে মনে করে। কারণ, এই করিডর কাশ্মীরের পাকিস্তান অংশের গিলগিট-বাল্টিস্তান হয়ে গাদওয়ারে পৌঁছেছে। সিপিইসিতে চীন তার বৃহত্তম বিনিয়োগ করেছে। দ্বিতীয়ত ‘উহান স্পিরিট’–এর (২০১৮ সালের এপ্রিলে চীনে উহান শহরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও চীনের প্রেসিডেন্টের মধ্যে সমঝোতায় স্থির হয়, দুই দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে কৌশলগত যোগাযোগ বিদ্যমান থাকবে। এটাই উহান স্পিরিটের মূল কথা) ওপর আঘাত।

পুলওয়ামায় ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ জইশ-ই-মুহাম্মদের আত্মঘাতী বোমা হামলায় ৪০ জনের বেশি ভারতীয় আধা সামরিক বাহিনী সিআরপিএফের জওয়ান নিহত হন। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ব্রিটেন, ফ্রান্স জইশ-ই-মুহাম্মদ নেতা মাসুদ আজহারকে সন্ত্রাসী তালিকাভুক্তির উদ্যোগ নিলে চীন সেই উদ্যোগে বাধা দেয়। ৩ জুলাই ২০১৯ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী বিআইএসএস আয়োজিত সেমিনার যথার্থই বলেছেন, বর্তমানে রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের হলেও আগামী দিনে এটাই হবে বৈশ্বিক সংকট। তাই এই সংকট মোকাবিলায় সবারই ভূমিকা থাকা প্রয়োজন। রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান না হলে বাংলাদেশ-ভারতের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে তা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

[ শেষ ]

মেজর (অব.) মোহাম্মদ এমদাদুল ইসলাম মিয়ানমারে বাংলাদেশের সাবেক কনস্যুলেট প্রধান