মধ্যবিত্তই এখন সবচেয়ে নাজুক

গত ৪০ বছরে বিশ্বের বিপুলসংখ্যক মানুষ দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে এসেছে। চরম দারিদ্র্যের সংখ্যাও অনেক কমেছে। মূলত বিশ্বায়নের বদৌলতে চীন ও ভারতের মতো জনবহুল দেশে বিপুলসংখ্যক মানুষের দারিদ্র্যের চক্র থেকে বেরিয়ে আসা এই শতাব্দীর অন্যতম বড় খবর বলেই মানছেন অর্থনীতিবিদেরা। পশ্চিমা উন্নত দেশগুলো তো এই সমস্যা আরও অনেক আগেই সমাধান করেছে। কিন্তু গত চার দশকে িবশ্বে মধ্যবিত্তের অবস্থা খারাপ হয়েছে বলেও অর্থনীতিবিদেরা বলছেন।

দারিদ্র্য বিমোচনে জাতিসংঘসহ বিশ্বের সব দেশই গুরুত্ব দিয়েছে। এ লক্ষ্যে অনেক প্রকল্প প্রণীত হয়েছে। উন্নত দেশের দান-অনুদান, এনজিওগুলোর ক্ষুদ্রঋণ, বিশ্বায়নের কারণে স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে কারখানা স্থানান্তর—দারিদ্র্য বিমোচনে এসবের বড় ভূমিকা আছে। কিন্তু একই সঙ্গে মধ্যবিত্তের জীবনমান উন্নয়নে নজর দেওয়া হয়নি। এই সময়ে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মতো বৈশ্বিক সংস্থাগুলো নব্য উদারনীতিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছে। এতে দেশে দেশে বৈষম্য বেড়েছে। সেই বৈষম্যের সবচেয়ে বড় শিকার হয়েছে মধ্যবিত্ত শ্রেণি। স্বাস্থ্য, শিক্ষার মতো মৌলিক চাহিদা থেকে সবকিছু বেসরকারীকরণের ফলে এসব সেবার ব্যয় বহুগুণ বেড়ে গেছে।

 ১৯৯২ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য হারে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ ঘটেছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৯২ সালে বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর মাত্র ৯ শতাংশ মধ্যবিত্ত ছিল। দুই দশক পরে মধ্যবিত্তের হার দ্বিগুণের বেশি বেড়ে ২০ শতাংশ হয়েছে। কিন্তু যে সমাজে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বাসস্থানের মতো মৌলিক চাহিদার ন্যূনতম নিশ্চয়তা নেই, সেই সমাজে মধ্যবিত্তকে সামাজিক মর্যাদা ঠিক রাখতে উদয়াস্ত পরিশ্রম করতে হয়। ফলে তাদের পক্ষে গ্রাসাচ্ছাদন ছাড়া অন্য কিছুর চিন্তা করা কঠিন। অথচ একসময় মানুষকে এক চাকরির বাইরে কিছু না করলেও চলত। তখন বই পড়ার সময় ছিল। বাস্তবতা হলো, আজ সেই একই শ্রেণির মানুষকে একসঙ্গে একাধিক কাজ করতে হয়। ফলে আজকের এই মধ্যবিত্ত নিছক অর্থনৈতিক মধ্যবিত্ত। অবসর সময়, বই পড়া, সিনেমা বা নাটক দেখতে যাওয়া, বৈকালিক বা সান্ধ্য আড্ডা—এসবই আমাদের নাগরিক জীবন থেকে একরকম হারিয়ে যাচ্ছে। অথচ মানুষের সামাজিক সত্তার বিকাশে এসবের গুরুত্ব অপরিসীম।

২০১৫ সালে বিআইডিএসের সেই গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণির ৪৮ দশমিক ৪ শতাংশ বা প্রায় অর্ধেকই বেসরকারি
চাকরি করে। আর ২০ শতাংশের বেশি সরকারি চাকরি করে। মধ্যবিত্তের প্রায় ২২ শতাংশ ব্যবসা করে। নিম্নমধ্যবিত্তের মধ্যে ৫১ দশমিক ৬ শতাংশ বেসরকারি চাকরি করে। আর ব্যবসায় সম্পৃক্ত মাত্র ১৭ শতাংশ। এই তথ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে বর্তমানে সরকারি চাকরির বেতন–ভাতা বাড়লেও বেসরকারি খাতের বেতন আনুপাতিক হারে বাড়েনি। অথচ পরিসংখ্যান বলছে, মধ্যবিত্ত শ্রেণির ৪৮ দশমিক ৪ শতাংশ বা প্রায় অর্ধেকই বেসরকারি চাকরি করে। সাধারণভাবে সরকার এ ব্যাপারে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে পারে না, তা হয়তো ঠিক, কিন্তু পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে সরকারের ভূমিকা প্রয়োজনীয় হয়ে উঠছে। বিপুলসংখ্যক নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষকে মধ্যবিত্তের কাতারে তুলে আনতে সব খাতেই মজুরিকাঠামো দরকার। অথচ ১০২টি প্রাতিষ্ঠানিক শিল্প খাতের অন্তত ৬২টিতে ঘোষিত ন্যূনতম মজুরি নেই। যেসব শিল্পে ঘোষিত মজুরি আছে, সেখানেও মজুরিকাঠামো পরিপূর্ণভাবে মানা হয় না।

যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় চার দশক ধরে মধ্যবিত্তের আয় বাড়ছে না। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বেশির ভাগ নাগরিকের পক্ষেই আর মধ্যবিত্ত জীবন যাপন করা সম্ভব হচ্ছে না। ২০০৭-০৮ অর্থবছরের আর্থিক সংকটের সময় তাঁদের দুর্বলতা পরিষ্কার হয়ে উঠল। যাঁরা স্টক মার্কেটে বিনিয়োগ করেছিলেন, তাঁদের টাকা উধাও হয়ে যায়। যাঁরা নিরাপদ ভেবে সরকারি বন্ডে টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন, তাঁদের অবসরকালীন উপার্জন প্রায় শূন্যের কোঠায় চলে এল। কারণ, কেন্দ্রীয় ব্যাংক (ফেডারেল রিজার্ভ) ক্রমাগতভাবে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি বন্ডের সুদহার কমাচ্ছিল। টিউশন ফি আকাশছোঁয়া হয়ে গেলে ঋণই হয়ে ওঠে একমাত্র ভরসার স্থল। কিন্তু শিক্ষাঋণ কখনোই মওকুফ হয় না বলে এই ঋণ আগের ঋণের চেয়েও বড় বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। এই ক্রমবর্ধমান আর্থিক চাপে পড়ে মধ্যবিত্ত চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে যায়।

সারা বিশ্বেই মধ্যবিত্ত শ্রেণি সংকুচিত হচ্ছে। সম্প্রতি বিবিসির এক জরিপে বলা হয়েছে, মধ্যবিত্ত শ্রেণি সমাজের ভারসাম্য বজায় রাখে। সে জন্য মধ্যবিত্ত শ্রেণির সংকুচিত হওয়া বা তাদের হতোদ্যম হয়ে যাওয়া সমাজের জন্য ভালো নয়। ঐতিহাসিকভাবে মধ্যবিত্ত শ্রেণি উদার গণতন্ত্রের সমর্থক। ফলে এই শ্রেণি মার খেলে উদার গণতন্ত্রও মার খাবে। সমাজে চরমপন্থার বিস্তার ঘটবে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপসহ এশিয়ার দেশে দেশে যে জনতুষ্টিবাদী ও কট্টরপন্থী দলগুলো ক্ষমতায় এসেছে, তার পেছনে মধ্যবিত্ত শ্রেণির সংকুচিত হওয়া অন্যতম প্রধান কারণ। বিশ্বায়নের মধ্য দিয়ে যে নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্ম হয়েছে, সেই শ্রেণি আবার পুরোনো মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে ভিন্ন। এরা জনতুষ্টিবাদের জোয়ারে ভেসে যায়। সে জন্য এখন রাজনীতিকদের এসব ব্যাপারে নজর দেওয়া দরকার।

অন্যদিকে দারিদ্র্য বিমোচন হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসা মানুষেরা যে ভালো আছে, সে কথাও বলার উপায় নেই। আয় বাড়ছে ঠিকই, কিন্তু তাদের জীবন চরম অরক্ষিত। নগরের বস্তিতে বসবাস করতে হচ্ছে তাদের। সেখানে না আছে সুপেয় পানি, না আছে জীবনের অন্যান্য রম্যতা। তাদেরও মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে তুলে আনার সংগ্রাম নিরন্তর চালিয়ে যেতে হবে।

অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (ওইসিডি) সংজ্ঞা অনুসারে, যাঁরা দিনে ১০ থেকে ১০০ ডলার আয় বা ব্যয় করেন, তাঁরাই মধ্যবিত্ত। অর্থনৈতিক বিচারে মধ্যবিত্তের সংখ্যা বাড়ছে। তাদের হিসাব অনুসারে, ২০২০ সালে এশিয়ায় মধ্যবিত্তের সংখ্যা দাঁড়াবে ১৭০ কোটি। আর ২০৩০ সালে বৈশ্বিক মধ্যবিত্তের সংখ্যা দাঁড়াবে ৪৯০ কোটি।

অন্যদিকে মধ্যবিত্ত বাড়লে প্রবৃদ্ধিও বাড়ে। পাশাপাশি ঐতিহাসিকভাবে এই শ্রেণি সমাজের ভারসাম্য বজায় রেখেছে। সে জন্য এখন সারা বিশ্বে মানুষের আয় বাড়ানোর পাশাপাশি যাপিত জীবন সহজ করার চেষ্টা করতে হবে। আর বৈষম্য কমানোর ব্যাপারে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ে তুলতে হবে।

প্রতীক বর্ধন: প্রথম আলোর সহসম্পাদক
[email protected]