ধর্ষণ এবং আমাদের আচার-বিচার

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে মজনুকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ছবি: প্রথম আলো
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে মজনুকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ছবি: প্রথম আলো

কুর্মিটোলা ধর্ষণের ঘটনার প্রতিক্রিয়া ও প্রতিবাদ যতই ঘনীভূত হচ্ছে, ততই ভয় দানা বাঁধছে, না জানি তেলেঙ্গানা নীতি অনুসরণ করে বসেন। দু-একজন ইতিমধ্যেই সে আশঙ্কা ব্যক্ত করে টুইটার-ফেসবুকের দেয়ালে লিখে ফেলেছেন তাঁদের বক্তব্য।

তেলেঙ্গানা নীতি কী?

গত বছরের ২৭ নভেম্বর বুধবার ভারতের হায়দরাবাদ শহরে ২৭ বছর বয়সী এক প্রাণী চিকিৎসককে গণধর্ষণ করার পর তাঁকে গলা টিপে হত্যা করা হয় এবং পরে তাঁর দেহটিও জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। শহরের এক টোল প্লাজার কাছে এ ঘটনার পর ভারতজুড়ে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ চলতে থাকে। প্রতিবাদ ক্রমেই মারমুখী হতে থাকে। চলমান প্রশাসনিক আর বিচারিক ব্যবস্থা নিয়েও প্রতিবাদীদের ক্ষোভ বিক্ষোভে পরিণত হতে থাকে। পুলিশের গাফিলতি নিয়ে প্রশ্ন উঠতে থাকে। এই বেসামাল পরিস্থিতিকে সামাল দেওয়ার জন্য পুলিশ সন্দেহভাজন চারজনকে আটক করে। কয়েক দিন জেল হেফাজতে রাখার পরে ৪ ডিসেম্বর বুধবার ওই চারজনকে পুলিশ নিজেদের হেফাজতে নিয়ে যায়। দ্রুত বিচারের দাবিতে মানুষ তখনো রাস্তায়। পুলিশ মানুষকে তাড়াতাড়ি বাড়ি পাঠানোর জন্য এক নতুন সিদ্ধান্ত নেয়। শুক্রবার ৬ ডিসেম্বর পুলিশ অভিযুক্ত ব্যক্তিদের অপরাধ সংঘটনস্থলে নিয়ে যায়। এরপর ‘সন্দেহভাজনেরা এক পুলিশ কর্মকর্তার বন্দুক চুরি করে পালানোর চেষ্টা করলে তাদের গুলি করা হয়।’

বলা বাহুল্য, সেই গুলিতে চারজনই পটল তোলে। পুলিশ সুরতহালের জন্য মৃতদেহ ঘটনাস্থলে ফেলে রাখে। মানুষ এত চটজলদি ফলের আশা করেনি। তবে সিনেমার মতো এনকাউন্টারে আমজনতা খুশি হয়। যে পুলিশকে তারা প্রায় থানাবন্দী করে রেখেছিল, তাদের ওপর গোলাপের পাপড়ি ছিটায়, মালা পরায়, মিষ্টিমুখ করায়। নিহত নারীর প্রতিবেশীরা এ ঘটনা পটকা ফাটিয়ে এবং মিষ্টি বিতরণ করে উদ্‌যাপন করেন।

অনেকে টুইটার ও ফেসবুকে পুলিশের প্রশংসা করতে গিয়ে বলেছিলেন যে তারা ‘ন্যায়বিচার’ করেছে।

শুধু দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল স্রোতের উল্টো দিকে গিয়ে বলেছিলেন, ‘মানুষ এই এনকাউন্টারের কারণে উৎসব পালন করছে, কিন্তু এটা আমাদের বিচারব্যবস্থা নিয়ে একটা গুরুতর প্রশ্ন তুলে দিল। গোটা দেশের ভাবা দরকার যে ফৌজদারি বিচার বিভাগ আর তদন্ত বিভাগকে কী করে শক্তিশালী করা যায়।’ ওই দেশে যেটাকে এনকাউন্টার বলে, এ দেশে সেটা ‘বন্দুকযুদ্ধ’। কুর্মিটোলার ঘটনায় ফুঁসে ওঠা তরুণসমাজকে ঠান্ডা করার জন্য কেউ যেন তেলেঙ্গানা নীতি অনুসরণ না করেন, সেদিকে আমাদের একটু হুঁশ রাখা দরকার।

ধর্ষণের বিচার কি হয়?
মানুষ না জাগলে কোনো অপরাধেরই বিচার পাওয়া দুষ্কর। এরপরও সে জাগা হতে হবে সে রকম এক জাগরণ। দিনাজপুরে ১০–১২ জন মানুষকে জীবন দিতে হয়েছিল ইয়াসমিন ধর্ষণ আর হত্যার বিচারের জন্য। ইয়াসমিন হত্যার বিচার হলেও বিচার চেয়ে মাঠে নামা মানুষদের হত্যার বিচার দূরের কথা, কোনো ক্ষতিপূরণও তাঁদের পরিবার পায়নি।

৫ জানুয়ারি যেদিন কুর্মিটোলার ধর্ষণের খবর নারী নির্যাতনের তালিকায় স্পষ্ট করে লেখা হয়ে যায়, ঠিক তার আগের দিন এক ধর্ষককে বিনা বিচারে সম্মানের সঙ্গে কেবল ‘অব্যাহতি’ দেওয়া হয়। মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার গুয়াগাছিয়া ইউনিয়নের শিমুলিয়া সিদ্দিকীয়া মাদ্রাসার ঘটনা। শিক্ষক কারি মুজাহিদুল ইসলাম ছিলেন ওই মাদ্রাসার ইবতেদায়ি বিভাগের শিক্ষক। মাদ্রাসার পাশে ভাড়া বাসায় থাকতেন আর প্রাইভেট পড়াতেন। ১ জানুয়ারি বুধবার বিকেলে একজন ছাত্রী প্রাইভেট পড়তে গেলে শিক্ষক মুজাহিদ তার শ্লীলতাহানি করেন। বিষয়টি স্থানীয় লোকজন টের পেলে তারা শিক্ষককে আটকে রেখে মাদ্রাসা কমিটিকে অবহিত করেন। প্রধান শিক্ষক ও পরিচালনা কমিটির সদস্যরা বিচারের আশ্বাস দিয়ে অভিযুক্ত শিক্ষককে ছাড়িয়ে নিয়ে যান। শিক্ষক মুজাহিদুল নিজের অপকর্মের কথা স্বীকার করে পদত্যাগের আবেদন করলে মাদ্রাসা কমিটি তাকে ‘বিধি মোতাবেক’ অব্যাহতি দিয়ে দেয়। (ছাত্রীর শ্লীলতাহানির ‘অভিযোগে মাদ্রাসা শিক্ষককে অব্যাহতি’, দৈনিক যুগান্তর ৪ জানুয়ারি)।

অভিযুক্ত শিক্ষককে অব্যাহতি দেওয়ায় ওই ছাত্রীর বাবা বাদী হয়ে পরের দিন গজারিয়া থানায় লিখিত অভিযোগ করেন। গজারিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) গণমাধ্যমকর্মীদের বলেছেন, অভিযুক্ত শিক্ষককে আটকের চেষ্টা চালাচ্ছে পুলিশ।

আত্মস্বীকৃত ধর্ষণকারী বা শ্লীলতাহানীকারীকে ছেড়ে দেওয়া মানে অন্য আরও শিশুকে বিপদে ফেলা। প্রমাণিত ধর্ষক বা ধর্ষণের চেষ্টা করা ব্যক্তিকে কোনো অবস্থাতেই অন্য একটি স্কুলে বা মাদ্রাসায় গিয়ে কাজ করার সুযোগ দেওয়াটাও একটা অপরাধ। শিক্ষকদের ডেটাবেইসে এদের নাম লাল করে দেওয়া উচিত।

বিচার এড়ানোর কত কত উপায় আছে। একটা তো গেল চাকরিচ্যুত করে আদালতের শাস্তি থেকে অব্যাহতি। গত ১৯ ডিসেম্বর রাতে নড়াইল সদরের মাইজপাড়া ইউনিয়নের বোড়ামারা গ্রামের মান্নান শিকদারের বাড়িতে সালিসে ফয়সালা হয় একটি ধর্ষণের অপরাধের। এর আগেও দুই দফা সালিসে এক লাখ টাকা দিয়ে মিটমাটের সিদ্ধান্ত হয়। তৃতীয় দফা সালিসে ৮০ হাজার টাকায় রফা হয়। এর মধ্যে ১০ হাজার টাকা গ্রাম্য সালিসকারীরা পাবেন। বাকি ৭০ হাজার পাবে ক্ষতিগ্রস্তের পরিবার। এ ছাড়া পুলিশের জন্য যা করা দরকার, তা আসামিপক্ষ করবে—এই মর্মে সালিসে সিদ্ধান্ত হয়। ধর্ষণের শিকার শিশুটির প্রতিবন্ধী বাবা জানান, সালিসের সভাপতি সোলেমান মোল্লার কাছ থেকে তিনি ৭০ হাজার টাকা বুঝে পেয়েছেন। সংবাদমাধ্যমে এই সালিসের কথা প্রচারিত হলে পুলিশ প্রশাসন নড়েচড়ে বসে। সালিসকারীদের থানায় ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। (প্রথম আলো, ১ জানুয়ারি)

এগুলো দুটি ঘটনামাত্র। এ রকম অজস্র আছে, নিয়মিতই ঘটে। সমাজ-বিচার প্রশাসন, পুলিশ বাহিনী যদি একযোগে কাজ না করে, আরও অসংখ্য নারী-শিশু নির্যাতনের শিকারের তালিকায় নাম লেখাবে।

কুর্মিটোলা–কাণ্ডের আসামি ধরা পড়েছে। নেটে নেটে তার ছবি ভেসে বাড়াচ্ছে। সে ছবি দেখে ঘর পোড়া গরুর মতো মনে পড়ল সেই ছোট্ট মেয়েটির কথা। ১৯৯৮ সালে মাত্র ছয় বছর বয়সী সেই শিশু ঢাকা সিএমএম কোর্টের পুলিশ নিয়ন্ত্রণ কক্ষে ধর্ষিত হয়েছিল। পুলিশ বেশ কিছুদিন পরে ‘মরা’ নামে এক ভবঘুরেকে ধরে এনে ধর্ষক হিসেবে সংবাদমাধ্যম ও কোর্টের সামনে হাজির করেছিল। ২১ বছর পার হলেও সেদিনের সেই শিশুটি কোনো বিচার পায়নি।

তবুও আস্থা রাখছি।

গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক গবেষক
nayeem 5508 @gmail. com