সিলেট নগরে পরিযায়ী পাখি

পাখিরা প্রকৃতির শিশু। সমাজে যদি শিশুরা নিরাপদ থাকে, তাহলে ধরে নিতে হয় সমাজটাই নিরাপদ। তেমনি যে এলাকায় পাখিরা আসে এবং নিরাপদে বসবাস করে, সেখানকার প্রকৃতিকেও স্বাভাবিক বলে ধরে নিতে হয়। সিলেট নগরের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা ঘাসিটুলা। শহরের মধ্যে হলেও, জায়গাটা দিনের বেলায় জনারণ্যে পরিণত হলেও কয়েক বছর ধরে তা পরিযায়ী পাখিদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। প্রথম আলোর খবরের শিরোনাম ‘নগরে নির্ভয়ে অতিথির আবাস’ কথাটার মধ্যে তাই অন্য তাৎপর্য লুকিয়ে আছে।

সিলেটের ঘাসিটুলায় একচিলতে জলাশয় ছিল বলে, সেই জলাশয়ে পাখিরা নির্ভয়ে বিচরণ করতে পারে বলে, নগর নিসর্গের নতুন অংশীদার হয়েছে পরিযায়ী পাখি। আর তারা এসে কলকাকলি আর ওড়াউড়ি দিয়ে ঘনবসতিপূর্ণ ওই এলাকার গায়ে নৈসর্গিক সৌন্দর্যের ছোপ লাগিয়ে দিয়েছে। পাখিবান্ধব শহরের ধারণা গড়তে এই অভিজ্ঞতা নগর–পরিকল্পনাবিদ ও নগর প্রশাসকদের পাথেয় হতে পারে।

শীতকালে যে পরিযায়ী পাখিদের আমরা দেশের বিল–হাওর–জলাশয়ে ভিড় করতে দেখি, সেসব পাখির বাহারি নাম অতিথি পাখি। কিন্তু অনেকেই মনে করেন, এদের বেশির ভাগ মূলত বাংলাদেশেরই আবাসিক পাখি। কেবল গ্রীষ্ম এলেই তারা মৃদু শীতের সন্ধানে আরও উত্তরে বেড়াতে যায়। এসব পাখির পরিভ্রমণ চক্রে বাংলাদেশের জলাশয়গুলো থাকা মানে বাংলাদেশের প্রকৃতির একটি নিয়ম পালিত হওয়া। পাখিরা যদি না আসে আর, তাহলে ধরে নিতে হবে যে আমাদের প্রাকৃতিক বিপর্যয় তীব্র হয়েছে, জলাশয়গুলো স্বাভাবিকতা হারিয়েছে এবং মানুষ ওসব পাখির জন্য উপদ্রবের জন্ম দিয়েছে। সুতরাং প্রাকৃতিক ছন্দের স্বাভাবিকতা পরিমাপের একটা দিক হলো পরিযায়ী বা অতিথি পাখিদের আগমন ও স্বচ্ছন্দ বিচরণ।

ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার জলাশয়ে শীতের পাখিদের আস্তানা করার ঘটনা তাই এটাও বোঝায় যে বাংলাদেশে তাদের আবাসস্থল ক্রমেই এত কমে আসছে যে তারা এখন একটু ঠাঁইয়ের জন্য শহরকেও বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে। অন্যদিকে, যদি প্রতিটি শহরে আমরা ছোট–বড় জলাশয় রক্ষা করতে পারতাম এবং এখনো যা আছে তা যদি বাঁচাতে পারি, তাহলে সেগুলোও এ রকম মনোরম দৃশ্যে সমৃদ্ধ হবে, পাখিরা সেখানেও আসবে। তার জন্য পাখি শিকার, বিক্রি ও আহার সবভাবেই বন্ধ করতে হবে, আইনানুগ শাস্তি নিশ্চিতের ব্যবস্থা থাকতে হবে এবং পাখিদর্শনের নামে নাগরিক–উৎপাত থেকে বিরত থাকতে হবে।

পরিযায়ী পাখিদের আগমন ও কলকাকলিময় বিচরণ কেবল মনোমুগ্ধকর বলেই নয়, শহরের মানুষের একঘেয়ে জীবনে একচিলতে নৈসর্গিক আনন্দের খোরাকও বটে। নাগরিকেরা যদি তা সিলেটের ঘাসিটুলার মতো করে উপলব্ধি করেন, তবেই তাঁদের মঙ্গল। ঘাসিটুলার অধিবাসীরা তিন বছর ধরে এই শীতকালীন পাখিদের আগলে রাখছেন, ক্ষতি হতে দিচ্ছেন না বলেই পাখিরা গতবারও এসেছে, আগামীবারও সম্ভবত আসবে। তার মানে, সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের গোচরে ও চিন্তায় বিষয়টা থাকা দরকার। নিজ নিজ এলাকাকে পাখিবান্ধব করা কেবল প্রকৃতিরই প্রয়োজন নয়, মানুষেরও সুস্থ–সুন্দর জীবনের আয়োজনের জন্যও দরকারি।