একজন ধীমানদা ও উপাচার্যের ব্যাটিং

ক্রিকেট ব্যাট হাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মো. আখতারুজ্জামান
ক্রিকেট ব্যাট হাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মো. আখতারুজ্জামান

তখন লাটাই-গুলতি-মার্বেল চর্চার বয়স। নারকেল আর তালগাছের ‘বাগলো’ (ডাল) কেটে ব্যাট বানিয়ে সবে ক্রিকেট খেলা শিখছি। কপিল দেবের বলের ‘ঘাপানে’ জাভেদ মিয়াঁদাদ কয় মিনিটে প্যান্ট নষ্ট করে মাঠ ছেড়েছিলেন; ইমরান খানের বোলিংয়ে গাভাস্কার কীভাবে নাই হয়ে গিয়েছিলেন—বড় ভাইদের আড্ডায় ওঠা এই সব গল্প তখন কান খাড়া করে শুনি।

একদিন বাড়ি থেকে আধা সিগারেট দূরত্বের একচিলতে জমিতে সবাই ক্রিকেট খেলছি। আচমকা হাজির হলেন ধীমানদা। শ্রীকান্ত উপন্যাসের কলকাতা নিবাসী ‘নতুনদা’র চেয়ে ঠাটে–বাটে ‘ঢাকাপ্রবাসী’ ধীমানদা কম যেতেন না। মেলাদিন পর পর গ্রামে আসতেন। আমাদের অমন পাড়াগাঁয়ে সব সময় তিনি ‘ইন’ করে জামা প্যান্ট তো পরতেনই, এমনকি জুতাও পরতেন। খানিকক্ষণ পরপর ঠোঁটে পমেড ধরনের কিছু একটা ঘষতেন। কথা বলতেন টাইপ করা বাংলায়।

ধীমানদা বললেন, ‘কী সব হাবিজাবি ব্যাট করিস? আয়, আজকে তোদের ব্যাটিংয়ের ক্লাস নেব।’ আইনস্টাইন বাড়ির ওপর এসে ‘জায়গির মাষ্টার’ থাকতে চাইলে বাড়িওয়ালার যে দশা হওয়ার কথা, আমাদেরও তাই হলো।

ধীমানদা ব্যাট হাতে পিচে দাঁড়ালেন। ব্যাট নাচিয়ে নাচিয়ে বললেন, ‘যদি লেগ দিয়ে বল আসে, তাহলে আস্তে করে বাঁ পা’টাকে পেছনে ফেলে টুক করে বলটাকে অফে ঠেলে দাও। চার হয়ে গেল! আর যদি অফ দিয়ে বল আসে, তাহলে ডান পা পেছনে ফেলে ঝেড়ে বলটা বাতাসে ভাসিয়ে দাও। দেখবে ছয় হয়ে গেল! নিয়ম মেনে ব্যাট করলে চার–ছয়ের অভাব আছে রে পাগলা!’

এইভাবে আধঘণ্টা ধরে চার আর ছক্কা মারার জ্ঞান দিলেন ধীমানদা। কথা শুনে মনে হলো, চার–ছয় তো জলভাত, খুচরা–খাচরা রান নিতে যাব কোন দুঃখে?

তত্ত্বীয় ক্লাস শেষে ব্যবহারিক ক্লাস শুরু হলো। ধীমানদা পিচে দাঁড়ালেন। বোলার আমাদের লিটু। লিটুর লিকলিকে দেহ। খালি গা। হাড়গোড় গোনা যায়। পরনের লুঙ্গি কাছা মারা। লিটু বল করল। ধীমানদা তাঁর গ্রামার মেনে ছয় বা নিদেনপক্ষে চার মারার জন্য ব্যাট চালালেন। দেখা গেল, তিনি বোল্ড আউট। মাঝখানের উইকেট বলের ধাক্কায় ছিটকে গেল। ধীমানদা বিব্রত হলেন। তাঁকে সহজ করতে সবাই বলল, ব্যাপার না!

ধীমানদা আবার ছক্কা মারার কৌশল দেখাতে ব্যাট করতে দাঁড়ালেন। লিটু দ্বিতীয় বল করল। এবার অফ স্টাম্প উড়ে গেল। ধীমানদা মহা বিব্রতকর অবস্থায় পড়লেন। তবু তিনি আবার দাঁড়ালেন। লিটু আবার বল করল। আবার বোল্ড আউট। ধীমানদা আর ‘ক্লাস’ নিলেন না। প্রমিত বাংলা আর ইংরেজির মতো কিছু একটা ভাষায় কী সব বিড়বিড় করতে করতে সটকে পড়লেন। বড় হয়ে বুঝলাম, হাড়–জিরজিরে লিটুদের প্র্যাকটিক্যাল বোলিংয়ের সামনে ধীমানদা–দের থিউরিটিক্যাল ব্যাটিং বেশিক্ষণ টেকে না। আরও বুঝলাম, ক্রিকেট শুধু খেলার জন্যই লোকে খেলে না। এই খেলা নানান জনে নানান কারণে খেলে।

বিনোদনের বাইরেও যে অন্য উদ্দেশ্যে ক্রিকেট খেলা হয়, তা প্রথম ব্যাট হাতে দেখিয়ে দিয়েছিলেন বিএনপির নেতা তারেক রহমান। বিএনপি সরকারের আমলে আওয়ামী লীগ একবার হাওয়া ভবন ঘেরাও কর্মসূচি নিয়েছিল। পুলিশ ভবনের চারপাশ ঘিরে ফেলেছিল, যাতে জনমানুষ ধারেকাছে ঘেঁষতে না পারে। যখন ঢাকা শহর উত্তেজনায় টান টান, তখন ছোট ভাই আরাফাত রহমান কোকোকে নিয়ে তারেক রহমান পুলিশবেষ্টিত চৌহদ্দির ভেতরে ক্রিকেট খেলতে নেমেছিলেন। ফিল্ডিং করছিলেন পারিষদ বর্গ, পাত্র-মিত্র, সেপাই–সান্ত্রি।

সিচুয়েশন আন্ডার কন্ট্রোলে আছে—পাবলিককে এটা বোঝাতে সেই ঘরোয়া ক্রিকেটের আয়োজন করা হয়েছিল। তারেক রহমান বোঝাতে চাচ্ছিলেন, বিরোধীরা রাস্তায় যে চিৎকার–চেঁচামেচি করছে, তা নিয়ে তাঁর কোনো মাথাব্যথা নাই। উদ্বেগ নাই। টেনশন নাই। খেলাচ্ছলে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সাথে এই রকমের খেলো মশকরা এর আগে কেউ করেছিলেন কি না জানা নাই।

অতি সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য ড. মো. আখতারুজ্জামানকে অবিকল তারেক রহমানের ভঙ্গিমায় ক্রিকেট ব্যাট হাতে দেখা গেল। তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হয়ে যখন হাসপাতালে কাতরাচ্ছিলেন এবং এই ঘটনার প্রতিবাদে ক্যাম্পাস যখন উত্তাল, তখন তিনি শিক্ষকদের একটি ক্রিকেট লিগ উদ্বোধন করলেন।

এই ঐতিহাসিক মুহূর্ত ক্যামেরাবন্দী করে বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তর গণমাধ্যমে পাঠাল। ছবিটি ফেসবুকে ওঠার পর ক্রিকেটের প্রতি বিন্দুমাত্র মমত্ববোধ না থাকা লোকেরা এখন যা নয় তাই বলে যাচ্ছে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, উপাচার্য হাসিমুখে রক্ষণাত্মক ভঙ্গিমায় ব্যাট চালাচ্ছেন। নব্বইয়ের দশকের অতি পরিচিত আম্পায়ার ডেভিড শেফার্ড যে ক্যাপ পরতেন, তাঁর মাথায় সেই ক্যাপ। মোট চৌদ্দজন শিক্ষক অর্ধবৃত্তাকারে তাঁকে আধা বেষ্টন করে আছেন। তাঁদের মধ্যে ১৩ জন হাস্যোজ্জ্বল মুখে করতালি দিচ্ছেন। উইকেটকিপারের ভূমিকায় শৈলচূড়ার বরফের মতো শুভ্র শ্মশ্রুমণ্ডিত ও কাশ্মীরি শাল পরিবেষ্টিত এক ভদ্রলোককে দেখা যাচ্ছে।

বিরল এই স্থিরচিত্রের মধ্য দিয়ে অতি স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়েছে, উপাচার্য মনে করেছেন, ধর্ষণ-টর্ষণ নিয়ে টেনশনের কিছু নাই। ক্রিকেটবিদ্বেষী ছেলেপেলে ফেসবুকের পাতায় জাতির কাছে প্রশ্ন রেখেছে, মেয়েটা যদি উপাচার্যের নিজের মেয়ে হতেন, তাহলে কি তিনি এভাবে বল–ব্যাট নিয়ে মাঠে পড়ে থাকতে পারতেন কি না। তাঁর এই নির্জলা ক্রিকেট প্রেমের মধ্যে নিষ্ঠুরতা খোঁজার চেষ্টা করেছেন কেউ কেউ। ক্রীড়ামোদী পক্ষের কেউ কেউ আবার পাল্টা যুক্তি দিয়ে বলেছেন, ধর্ষণের শিকার হওয়া ছাত্রীর জন্য ক্রিকেটের মতো মহান ক্রীড়াকলাকে এড়িয়ে যাওয়া কোনো কাজের কথা নয়। সবচেয়ে বড় কথা হলো, কয় দিন পরপরই ছেলেপেলে আন্দোলনের নামে উপাচার্যকে টেনশনে ফেলার চেষ্টা করে। তার একটা ভদ্রোচিত জবাব দেওয়া দরকার ছিল। তারেকীয় কায়দায় তাদের বুঝিয়ে দেওয়া দরকার ছিল, এই সব আন্দোলন–ফান্দোলন নিয়ে কর্তৃপক্ষ বিশেষ কিছু ভাবে না। তাঁদের এ নিয়ে টেনশনের কিছু নাই।

উপাচার্য আমার শৈশবের ধীমানদার মতো মাঠে নেমে দেখিয়ে দিয়েছেন, কীভাবে ব্যাট দিয়ে বল ঠেকাতে হয় এবং তাঁর সেই বল ঠেকানোর দৃশ্য দেখে কীভাবে অন্যদের হাততালি দিতে হয়। লুঙ্গি কাছা মারা লিটুর মতো অল্প কিছু ছেলে মেয়ে আছে, যারা মনে করে এটা রসিকতার সময় নয়, এটা গভীর বিষাদের সময়। এই বিষাদ থেকে যে ন্যায়সংগত ক্রোধের জন্ম হয়, এখন সেই ক্রোধের সময়। এটা গুগলি বোলিংয়ের সময়। এই লিটুরা যদি প্র্যাকটিক্যাল বল করা শুরু করে, তাহলে মশকরার ব্যাটিং দিয়ে উইকেট বাঁচানো যাবে কি!

সারফুদ্দিন আহমেদ: প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
[email protected]