মার্ক টালির চোখে 'নিয়ন্ত্রিত সাংবাদিকতা'

মার্ক টালি (২০১৭ সালে তোলা ছবি)
মার্ক টালি (২০১৭ সালে তোলা ছবি)

মার্ক টালি নামটি বাংলাদেশে বেশ পরিচিত। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিবিসিতে তাঁর প্রতিবেদনগুলো আমাদের মনে ভীষণ নাড়া দিত, আশা জাগাত। মার্ক টালি তখন ছিলেন বিবিসির দক্ষিণ এশীয় ব্যুরোর প্রধান। দিল্লিতে তাঁর অফিস। তিনি সে সময় একাধিকবার সীমান্ত এলাকায় এসে শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে সরেজমিনে রিপোর্ট করতেন। বাংলাদেশ ও বাংলাভাষী মানুষের সঙ্গে তাঁর নৈকট্যের আরেকটি কারণ মার্ক টালির মায়ের জন্ম বাংলাদেশের আখাউড়ায়। তাঁর জন্ম কলকাতায়। এখন মার্ক টালির বয়স ৮৪ বছর। ২০১৩ সালে ৭৮ বছর বয়সে তিনি কলকাতা সিটি করপোরেশন থেকে জন্মনিবন্ধন সনদ উদ্ধার করেন।

অনেক বছর আগে আলোচনা প্রসঙ্গে মার্ক টালি বলেছিলেন, ‘আমি সেই দিনের অপেক্ষায় আছি, যেদিন আমি কলকাতা থেকে আমার মায়ের জন্মস্থান আখাউড়া জংশন হয়ে ত্রিপুরায় যেতে পারব।’ আগরতলা-আখাউড়া রেলসংযোগের কাজ চলছে। ২০২০ সালের শেষ নাগাদ সেখানে ট্রেন যোগাযোগ ফের চালু হবে আশা করা যায়। তখন মার্ক টালির স্বপ্ন সত্যিই সফল হবে। উল্লেখ্য, ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আগে এই রেললাইন চালু ছিল।

মার্ক টালি বিবিসির চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর আর যুক্তরাজ্যে ফিরে যাননি। ভারতেই থেকে যান। ভারত নিয়ে তাঁর উল্লেখযোগ্য বই মিসেস গান্ধী’স লাস্ট ব্যাটল, রাজ টু রাজীব, নো ফুল স্টপ ইন ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়া আনএন্ডিং জার্নি প্রভৃতি।

সম্প্রতি ভারতের জনপ্রিয় সাময়িকী ফ্রন্টলাইন-এর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে মার্ক টালি বর্তমান বিশ্বে সাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জ, সংকট ও সম্ভাবনা নিয়ে কিছু কথা বলেছেন। তাঁর সাক্ষাৎকারটি ভারতের প্রেক্ষাপটে হলেও বাংলাদেশসহ সব উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রে কমবেশি প্রযোজ্য।

মার্ক টালি ভারতের গণমাধ্যমের দীর্ঘ ঐতিহ্যের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, অনেক দুর্বলতা সত্ত্বেও ভারত যে অনেক ক্ষেত্রে ভালো করছে, তার কারণ স্বাধীন গণমাধ্যম। সেই সঙ্গে গণমাধ্যমের সীমাবদ্ধতার কথাও জানিয়েছেন। তাঁর ভাষ্য, গণমাধ্যম যেভাবে কাজ করছে, তাতে সমালোচনার অনেক কিছু আছে। বেশির ভাগ বৈদ্যুতিন মাধ্যম অযৌক্তিকভাবে সরকারকে সমর্থন করছে। ব্যতিক্রম এনডিটিভি। এনডিটিভির সাংবাদিকতার প্রশংসা করে এই প্রবীণ সাংবাদিক বলেন, প্রতিষ্ঠানটি সংবাদ পরিবেশনে ভারসাম্য রক্ষা ও সমালোচনার ধারাটি অক্ষুণ্ন রেখেছে। ভারতে এত এত বেসরকারি টিভি চ্যানেল। তার মধ্যে তিনি একমাত্র এনডিটিভির নাম নিলেন।

মার্ক টালির মতে, সার্বিকভাবে টিভি সাংবাদিকতার মান মারাত্মকভাবে নেমে গেছে। তারা সাংবাদিকতার সস্তা পথ বেছে নিয়েছে। শুধু সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে সংবাদ পরিবেশন করছে। তৃণমূলের মানুষ কী ভাবছে, তা খতিয়ে দেখছে না। এ ছাড়া কোনো গণমাধ্যম ফলোআপ করতেও আগ্রহ দেখায় না। একটা-দুটো প্রতিবেদন করে দায়িত্ব শেষ করে। এটি কাঙ্ক্ষিত নয়।

তবে ভারতের মুদ্রিত মাধ্যমের সাংবাদিকতার প্রশংসা করে তিনি বলেছেন, সংবাদপত্রের চিত্রটা উজ্জ্বল। অনেক পত্রিকাই গুরুত্ব দিয়ে ভিন্নমত প্রকাশ করে। এ প্রসঙ্গে তিনি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ও বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এ অনেক গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধ ও মতামত পড়েছেন বলে জানিয়েছেন। কেউ কেউ সরকারকে সমর্থন করছে। ঠিকই আছে।

দুই দেশের গণমাধ্যমের তুলনামূলক আলোচনা করতে গিয়ে মার্ক টালি বলেছেন, ব্রিটেনের সংবাদপত্রগুলো এভাবে না হয় ওভাবে একটি রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে থাকে। ভারতে সেটা নয়। যেসব পত্রিকা একসময় অধিক সরকার-সমর্থক ছিল, তারা পরে আর সরকারের সঙ্গে যুক্ততা রাখেনি। সরকারকে চ্যালেঞ্জও করছে। ব্রিটেনের অনেক পত্রিকা ঘোষণা দিয়ে কোনো রাজনৈতিক দলকে সমর্থন বা বিরোধিতা করে। এই ধারা পশ্চিমের আরও অনেক দেশে আছে। গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নিউইয়র্ক টাইমস ও আরও অনেক পত্রিকা ঘোষণা দিয়ে হিলারি ক্লিনটনকে সমর্থন করেছিল। বাংলাদেশ বা অন্য কোনো উন্নয়নশীল দেশে দলীয় মুখপত্র ছাড়া কোনো গণমাধ্যমের পক্ষে এ ধরনের ঘোষণা দিয়ে টিকে থাকা কঠিন।

ভারতের গণমাধ্যমের সাম্প্রতিক প্রবণতায় মার্ক টালি উদ্বিগ্ন। তিনি বলেন, বর্তমান অবস্থা ভিন্ন। লোকজন মনে করে, গণমাধ্যমের ওপর অঘোষিত জরুরি অবস্থা চলছে।

ইন্দিরা গান্ধীর আমলে যখন জরুরি অবস্থা ছিল, তখন গণমাধ্যমের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ ছিল। কুলদীপ নায়ারসহ অনেক সাংবাদিক গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। বিবিসিতে সরকারের সমালোচনা করায় মার্ক টালিকেও লন্ডনে ফেরত যেতে হয়েছিল। জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করা হলে তিনি আবার দিল্লিতে আসেন।

সম্ভবত এসব মনে রেখেই মার্ক টালি গণমাধ্যমে অঘোষিত জরুরি অবস্থা আছে বলে মন্তব্য করেছেন। সংশ্লিষ্টদের মতে, ঘোষিত জরুরি অবস্থার চেয়ে অঘোষিত জরুরি অবস্থা আরও বিপজ্জনক। ঘোষিত জরুরি অবস্থায় সরকার থেকে জানিয়ে দেওয়া হয় কী লেখা যাবে, কী লেখা যাবে না। কিন্তু অঘোষিত জরুরি অবস্থায় আগে থেকে কিছু বলা হয় না। সরকার তক্কে তক্কে থাকে। সুযোগ পেলেই খড়্গহস্ত হয়।

মার্ক টালি মনে করেন, শুধু গণমাধ্যম নয়, রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোও দুর্বল হয়ে পড়েছে। সবল হয়েছে পুলিশ ও আমলাতন্ত্র। সরকার পুলিশ ও তদন্ত সংস্থাগুলোকে রাজনৈতিক স্বার্থে কাজে লাগাচ্ছে। ফলে ন্যায়বিচার পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।

মার্ক টালি ভারতের প্রেক্ষাপটে কথাগুলো বললেও বাংলাদেশের বাস্তবতার সঙ্গেও হুবহু মিলে যায়। বেমিল হলো মার্ক টালি ভারতে স্বকীয়তায় উজ্জ্বল একটি টিভি চ্যানেলের নাম করেছেন। বাংলাদেশে হয়তো এখন সেটিও সম্ভব নয়। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এখন শুধু উন্নয়নশীল নয়, উন্নত দেশেও চ্যালেঞ্জের মুখে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন টমাস জেফারসন সংবাদপত্রহীন রাষ্ট্রের বদলে রাষ্ট্রহীন সংবাদপত্রের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। সেই দেশটির বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রকাশ্যে গণমাধ্যমকে হুমকি দিচ্ছেন। তাঁর সরকারের সমালোচনা করে কোনো প্রতিবেদন বা বিশ্লেষণ প্রকাশিত হলেই তিনি ‘ফেক নিউজ’ বা ভুয়া খবর বলে গালমন্দ করেন। যখন তাঁর এই প্রচারণাও খুব কাজে আসছে না, তখন তিনি সাংবাদিকদের জনগণের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করলেন। তাঁর বাক্সন্ত্রাস থেকে রেহাই পায়নি নিউইয়র্ক টাইমস-এর মতো পত্রিকাও। শুধু ট্রাম্প নন, পৃথিবীর অনেক রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানই কথায় কথায় সাংবাদিকদের একহাত নিতে ছাড়েন না।

মার্ক টালি গণমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে আরেকটি বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন। সংবাদপত্র বা টেলিভিশনের মালিকানা কার হবে? তাঁর মতে, সংবাদপত্র বা টেলিভিশন ব্যক্তিমালিকানায় থাকলে মালিকের কথা শুনবে। সরকারের কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা নিলে তার সমালোচনা করতে পারে না। আবার তারা বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভরশীল হলে বিজ্ঞাপনদাতার মন জুগিয়ে চলতে হয়। মার্ক টালির কথাটি অনেকটা ঢালাও বলে মনে হয়। তিনি যে জনমালিকানার কথা বলেছেন, তা সাম্প্রতিক ধারণা। দেশে দেশে শত শত বছর ধরে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য যে লড়াই-সংগ্রাম চলেছে, তাতে পেশাদার সাংবাদিকদের সঙ্গে মালিকেরাও বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন। কেউ কেউ রাষ্ট্রযন্ত্রের দ্বারা নিগৃহীত হয়েছেন। তাই সব মালিক বা উদ্যোক্তা গণমাধ্যমকে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থে ব্যবহার করেন, এ ধারণা সঠিক নয়।

মার্ক টালি মনে করেন, জনমালিকানায় পরিচালিত গণমাধ্যম অধিকতর স্বাধীনতা ভোগ করে। উদাহরণ হিসেবে তিনি ব্রিটেনের পত্রিকা গার্ডিয়ান ও সম্প্রচার প্রতিষ্ঠান বিবিসির কথা বলেছেন। টেলিভিশন লাইসেন্স ফি দিয়ে যে আয় হয়, সেটাই বিবিসির আয়ের প্রধান উৎস। আগে বহির্বিশ্বের অনুষ্ঠানের জন্য সরকার বরাদ্দ দিত। এখন সেটিও নেই। অন্যদিকে ভারতের নিউজ পোর্টাল দ্য ওয়্যার ও ব্রিটেনের পত্রিকা গার্ডিয়ানও চলে সমর্থক ও গ্রাহকদের চাঁদা বা অর্থায়নে। গার্ডিয়ান গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে তহবিল সংগ্রহ করছে।

মার্ক টালি বলেছেন, বিবিসি জনগণের কাছ থেকে লাইসেন্স ফি দিয়ে চলছে বলেই সরকারের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত। টেলিভিশন কী প্রচার করবে কী করবে না, তা বলার এখতিয়ার সরকারের নেই।

কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতায় গ্রাহক মাশুল কিংবা লাইসেন্স ফি দিয়ে পত্রিকা ও টিভি চালানো সম্ভব নয় বলেই সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। বাংলাদেশে একসময় টিভি সেটের জন্য লাইসেন্স ফি নেওয়া হতো। পরে সেটি বাদ দেওয়া হয়। তখন বিটিভি ও বাংলাদেশ বেতারের বাইরে কোনো সম্প্রচার প্রতিষ্ঠান ছিল না। বর্তমানে কেব্ল অপারেটররা দর্শকদের কাছ থেকে মাশুল নিলেও টিভি কর্তৃপক্ষ কোনো অর্থ পায় না। বরং তাদের সম্প্রচার অনেকাংশে অপারেটরদের মর্জির ওপর নির্ভর করে। ইদানীং বেসরকারি টিভি চ্যানেলের মালিকদের কেউ কেউ পে-চ্যানেল চালু করার কথা বলছেন। এমনিতেই দেশীয় টিভি চ্যানেলের দর্শক কমে গেছে। তাঁদের আগ্রহ ভারতের জনপ্রিয় হিন্দি ও বাংলা চ্যানেলের প্রতি। এ অবস্থায় মাশুল দাবি করলে দর্শক আরও কমে যাবে।

আর বাংলাদেশে সংবাদপত্রের বড় সমস্যা হলো এর উৎপাদন খরচ অনেক বেশি। ২০ পাতার একটি পত্রিকা মুদ্রণে (কাগজ ইত্যাদিসহ) খরচ হয় ২০ টাকার কাছাকাছি। নির্ধারিত মূল্য ১০ টাকা। হকার বা এজেন্টের কমিশন বাদ দিয়ে পাওয়া যায় ৬ থেকে সাড়ে ৬ টাকা। ফলে বিজ্ঞাপনই আয়ের প্রধান উৎস। বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হলে পত্রিকার দাম বাড়াতে হবে। কিন্তু আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির যুগে যেখানে পাঠক প্রায় বিনা মূল্যে সব তথ্য হাতের কাছে পেয়ে যাচ্ছেন, সেখানে পত্রিকার দাম বাড়ানো কতটা বাস্তবসম্মত, তা-ও ভেবে দেখার বিষয়।

মার্ক টালি ভারত ও ব্রিটেনের গণমাধ্যমের সংকটের কথা বলেছেন, তাঁর মতো করে সংকট উত্তরণের পথ বাতলেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের গণমাধ্যমের সংকট আরও গভীর, উত্তরণের পথ অধিকতর সংকুচিত।

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]