বিডিআর মামলার রায়

পিলখানার বিয়োগান্ত ঘটনায় হাইকোর্ট বিভাগের দেওয়া ঐতিহাসিক রায়ের কিছু পর্যবেক্ষণ অবিলম্বে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার দাবি রাখে। বিশেষ বেঞ্চের তিন বিচারপতি কতগুলো বিষয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে অভিন্ন মতামত ব্যক্ত করেছেন, যা রাষ্ট্র চাইলে অবশ্য প্রতিপালনীয় হিসেবেই গ্রহণ করতে পারে।

রায়ে বিপথগামী সাবেক বিডিআর জওয়ানদের দ্বারা সংঘটিত নৃশংসতা ও বর্বরতার চিত্র যথার্থভাবে ফুটে উঠেছে। এর পাশাপাশি বিচারপতিরা তঁাদের পর্যবেক্ষণে সাবেক বিডিআর জওয়ানদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব তৈরির ঐতিহাসিক কারণও নির্দেশ করেন। বিচারকেরা একবাক্যে বলেছেন, ডাল–ভাত কর্মসূচি নেওয়া একেবারেই ঠিক হয়নি। তঁাদের কথায়, এটা ছিল একটা ‘ভয়ংকর উসকানি।’ তাঁরা সর্বসম্মতিক্রমে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন যে ভবিষ্যতে বিডিআর বা বিজিবি বলে কথা নয়, কোনো শৃঙ্খলা বাহিনীকে সংশ্লিষ্ট করে এ ধরনের কর্মসূচি যাতে না নেওয়া হয়। কারণ যেকোনো শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যের জন্য এটা অগৌরবের, গ্লানিকর। নীতিনির্ধারকদের এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে।

আবার তঁারা তাৎপর্যপূর্ণভাবে এই প্রশ্নও তুলেছেন যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার গঠনের মাত্র ৪৮ দিনের মাথায় পিলখানার ঘটনা কি শুধুই দাবিদাওয়া আদায় করার লক্ষ্যেই পরিচালিত হয়েছিল কি না। আদালত ‘গোয়েন্দা ব্যর্থতার’ বিষয়ে যথার্থই দিকনির্দেশ করেছেন। সরকারের দায়িত্বশীল গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এত বছর পরেও তাদের কোনো অভ্যন্তরীণ জবাবদিহি নিশ্চিত করা হয়েছে কি না, হয়ে থাকলে কীভাবে কী হয়েছে, সেসব বিষয়ে সীমিতভাবে হলেও মানুষের জানার অধিকার আছে।

পিলখানা থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশের নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে কতটা কী ঢেলে সাজানো হয়েছে, তা আমরা জানি না। পিলখানার ঘটনার আগে বিডিআরে তীব্র অসন্তোষ কোনো লুকোছাপার ব্যাপার ছিল না। আদালত বলেছেন, এ বিষয়ে প্রকাশ্য লিফলেট বিতরণের বিষয়টি তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতা ও কমান্ডার অফিসারদের নজরে আনা হয়েছিল। অবশ্য এতে সন্দেহের অবকাশ কম যে পিলখানা ট্র্যাজেডির দ্রুত বিচার, ভুক্তভোগীদের ক্ষতিপূরণ প্রদানে সরকার অবশ্যই সন্তোষজনক পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু আজও সব প্রশ্নের সব ধরনের উত্তর শতভাগ পাওয়া গেছে, তা বলা দুরূহ।

এটা বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে বিচারকেরা পৃথক রায়ে তিনটি কমিটি গঠনের সুপারিশ করেছেন। ‘ঘটনার পেছনের ঘটনা’ খতিয়ে দেখতে বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী একটি তদন্ত কমিশন গঠনের সুপারিশ করেছেন। তিনি নির্দিষ্টভাবে প্রশ্ন তুলেছেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন নতুন সরকারকে উৎখাত করে দেশকে অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলতে একটি স্বার্থান্বেষী মহলের প্ররোচনা ছিল কি না। সদ্য অবসরে যাওয়া বিচারপতি মো. শওকত হোসেন বিদ্রোহের আগাম তথ্য না দিতে পারার ব্যর্থতা খতিয়ে দেখতে বেশি জোর দিয়েছেন। তাই তিনি এ জন্য তদন্ত কমিটি করতে বলেছেন।

পূর্বাভাস দিতে না পারার একই ব্যর্থতার বিষয়টি বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদারও তাঁর রায়ে গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি অবশ্য এ জন্য তৎকালীন বিডিআরের ‘রাইফেলস সিকিউরিটি ইউনিট (আরএসইউ)’–কে অভিযুক্ত করেছেন বলে প্রতীয়মান হয়। তিনি ওই সংস্থাটির কর্মকর্তারা কেন সম্ভাব্য বিদ্রোহ ও হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে আগাম তথ্য দিতে পারেননি, তা খতিয়ে দেখতে একটি তদন্ত কমিটি এবং তার ফলাফল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জনসমক্ষে প্রকাশে ‘সুপারিশ’ করেন।

পিলখানা বিদ্রোহ ও হত্যাকাণ্ড একটি জাতীয় শোকগাথা। একাত্তরের ৯ মাসে ৫৭ জন আর ২৪ ঘণ্টার কম সময়ে ৫৫ সেনা অফিসারকে হারানোর ঘটনা বিস্মৃত হওয়ার নয়। ক্ষমা ও ন্যায়বিচারকে প্রাধান্য দিয়ে গঠনমূলক মনমানসিকতা নিয়ে আমাদের আত্মজিজ্ঞাসা করে যেতে হবে। লক্ষ্য থাকবে, এমন ধরনের দুর্ভাগ্য যেন জাতিকে আর স্পর্শ না করে।