বিবর্ণ পাহাড়ে সবুজ বিপ্লব

রয়টার্স প্রতীকী ছবি।
রয়টার্স প্রতীকী ছবি।

বান্দরবানের লামায় অবস্থিত কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনে যখন পৌঁছাই, তখন সূর্যটা শৈলসারির সবুজ গায়ে হামাগুড়ি দিয়ে অনেকটাই উঠে এসেছে। প্রায় বিনিদ্র রাত কাটিয়ে ভোরে চট্টগ্রাম স্টেশনে নেমে যখন নাশতা খাওয়ার কথা ভাবছি, তখন কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের জ্যেষ্ঠ সংগঠক সাইফুদ্দিন সাইফ সেই ভাবনায় রীতিমতো জল ঢাললেন। বললেন, গন্তব্যে পৌঁছানোর আগে কোনো নাশতা নয়। অবশ্য লামা পৌঁছাতে খুব বেশি সময় লাগল না। সুতরাং পৌঁছানোর পর আর বিলম্ব নয়। দ্রুততার সঙ্গেই শেষ হলো প্রাতরাশ। অস্থিরতায় আছি, কখন ছুটব পাহাড়ে। এরই মধ্যে বাংলোঘরের অসাধারণ এক বারান্দায় বসলাম চা খেতে। এখানে বসে চারপাশে কত কিছুই যে দেখার আছে! পত্রসমৃদ্ধ লাল কাঞ্চনের গাছগুলোকে কেবলই আপেলগাছ মনে হচ্ছে! পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে সবুজের সমারোহ। বেরোনোর প্রস্তুতির জন্য খানিকটা সময় পাওয়া গেল। ইতিমধ্যে ১০–১২ জনের একটা দল হলো। সবাই প্রস্তুত। আমরা হাঁটতে শুরু করি।

চারপাশে শুধু গাছ আর গাছ। এদের মধ্যে অচেনা এমন একটি গাছ দেখালেন সাইফ। স্থানীয় নাম মনকলা। পোশাকি নাম পিরালু বা পেডালু। সবুজ রঙের একটি ফল ঝুলছে গাছে। গাছটি বিপন্ন। পরে পাহাড়ের অন্যত্র আরও কয়েকটি মনকলাগাছ দেখেছি। এই ফলের ভর্তা নাকি অনেক সুস্বাদু। চোখে পড়ল সুদৃশ্য পাইন বীথি। আমাদের পাহাড়ে গাছটি স্বল্পতম হলেও নেপাল-ভারতের পাহাড়ে অঢেল। পাহাড়ের ঢালে একটি বুড়ো ধারমারা গাছ চোখে পড়ল। পাহাড়ি পথের রীতি অনুযায়ী আমরা ঢাল বেয়ে উঠছি, আবার নামছি। মাঝেমধ্যে দু-একটি ধ্যানঘর দেখা গেল। নির্জনতম এসব স্থান ধ্যানের জন্য উত্তম বৈকি। দলনেতা সাইফ এবার খাড়া পথে ঢাল বেয়ে নিচে নামতে বললেন। দুপাশে এমন কিছু গাছ দেখছি, যেগুলো স্বাভাবিকভাবে এখানে থাকার কথা নয়। জানা গেল, এ সবই সাইফের কীর্তি।

তিনি দীর্ঘদিন ধরেই দেশের দূরদূরান্ত থেকে অনেক দুর্লভ প্রজাতির ও বিপন্ন গাছ এখানে এনে লাগিয়েছেন। বিশাল পরিসরের এই নন্দনকাননে বিপুল তাঁর কর্মযজ্ঞ। এই কর্মযজ্ঞের একটি ধারা উদ্ভিদ ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণের উদ্যোগ। এই কাজের জন্য গড়ে উঠেছে একটি চমৎকার কর্মী দল। করপোরেট অফিসের বড় অঙ্কের পারিশ্রমিককে তুচ্ছজ্ঞান করে এখানে নিজেদের উৎসর্গ করেছেন। আরও বেশি বিস্মিত হলাম এই শুনে যে মাত্র তিন দশক আগেও চারপাশের এই পাহাড়ের অধিকাংশই ছিল ন্যাড়া। একটি সংঘবদ্ধ চক্র গাছ কেটে, আগুন জ্বালিয়ে রুক্ষ উপত্যকায় পরিণত করেছিল এই পাহাড়কে। সবার আন্তরিক প্রচেষ্টায় অতি দ্রুত পাহাড়ের নিজস্ব রং ফিরে এসেছে।

ঘোরা পথে আমরা মূল প্রবেশপথের কাছে চলে এলাম। এখানে পাহাড়ের ঢালুতে একটি ক্যাশিয়াগাছ দেখে চমকে উঠি! জানামতে, এই গাছ ঢাকা ও সাভার মিলিয়ে মাত্র হাতে গোনা কয়েকটি। তা ছাড়া গাছটি দেশে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানোর কোনো তথ্যও লিপিবদ্ধ নেই। গাছটির আনুমানিক বয়স হিসাব করলে যে সময়টা পাওয়া যায়, সে সময়ে এই দুর্গম পাহাড়ে এসে কারও গাছ লাগানোর সম্ভাবনাও ক্ষীণ। যদি গাছটি প্রাকৃতিকভাবে জন্মে থাকে, তাহলে আমাদের উদ্ভিদ তথ্যভান্ডারের জন্য এটি একটি চমকপ্রদ সংযোজন। গাছটির বাংলা নাম নেই। উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম ক্যাশিয়া ব্যাকেরিয়ানা। পরের দিন একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল। ঝোপঝাড়ের ভেতর প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো অসংখ্য দইগোটার গাছ দেখতে পেলাম। ধারণা ছিল, আমাদের দেশে দইগোটা আবাদিত উদ্ভিদ। লামার এই দুর্গম পাহাড়ে না এলে জানাই হতো না, এই গাছ এখানকার পাহাড়ে প্রাকৃতিকভাবে জন্মে।

প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরের কোয়ান্টাম কসমো স্কুল আমাদের পরবর্তী দিনের গন্তব্য। পথে পথে অসংখ্য গাছের সমারোহ। কেলিকদম, স্বর্ণচাঁপা, নাগেশ্বর, নাইচিচি উদাল, মাকড়িশাল, তোকমা, গর্জন, রসকাউ, নীলবনলতা, দাঁতরাঙা, বুনো আম, সোনালি বাঁশ, আরও কত–কী! পথের পাশে সাতজন বীরশ্রেষ্ঠর নামে সাতটি শিমুলগাছের একটি থিম গার্ডেন বানানো হয়েছে। বীরশ্রেষ্ঠদের স্মরণে রাখার চমৎকার আয়োজন। পরিচ্ছন্ন নীলাকাশের গায়ে ছোপ ছোপ মেঘ আর দূরের পাহাড়ের সবুজ আঁকিবুঁকি দেখতে দেখতে গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম। ততক্ষণে সূর্য উষ্ণতা ছড়াতে শুরু করেছে। মাঠের ধারেই স্কুলে প্রাতরাশ সারলাম। কসমো স্কুলের কোমলমতি শিশুরা যে প্যারেড নৈপুণ্য দেখাল, তাতে মুগ্ধতা আরও বাড়ল।

আমাদের জন্য সর্বশেষ চমক ছিল প্রায় ২৯ প্রজাতির বাঁশ নিয়ে গড়ে ওঠা ব্যাম্বোরিয়াম। এখানে আছে নানান আকৃতি আর গড়নের বাঁশ। প্রবেশপথেই প্যাঁচাবাঁশ আর লাঠিবাঁশ চোখে পড়বে। তারপর ঢুলিবাঁশ, বরাকবাঁশ, ভুদুমবাঁশ, বাইজ্জা, পলিমারফিসহ আরও অনেক বিচিত্র বাঁশ চোখে পড়ল। এখানে শুধু উদ্ভিদই নয়, পাশাপাশি অন্যান্য প্রাণসম্পদও যথাযথভাবে সংরক্ষিত হচ্ছে। একঝাঁক মেধাবী তরুণ প্রকৃতি সংরক্ষণের পাশাপাশি মানবিক সমাজ নির্মাণের যে ব্রত নিয়েছেন, তা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে।

মোকারম হোসেন: প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক। সাধারণ সম্পাদক, তরুপল্লব
[email protected]