ইরান: এই ক্ষোভ শুধু বিমান ধ্বংসের কারণে নয়

ইরানে গত কয়েক দিনের বিক্ষোভ অকস্মাৎ ঘটেনি। ছবি: এএফপি
ইরানে গত কয়েক দিনের বিক্ষোভ অকস্মাৎ ঘটেনি। ছবি: এএফপি

নতুন বছরের গোড়াতে এক সপ্তাহের বেশি উত্তেজনাকর পরিস্থিতি এবং যুক্তরাষ্ট্র-ইরানের মধ্যে প্রায় যুদ্ধ হওয়ার মতো আশঙ্কার আপাত অবসান হয়ে ইরান যেন গত বছরের নভেম্বরেই ফিরে গেছে। কিন্তু এর পরে কী হবে, ইরানের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি কোথায় যাবে এবং তার প্রতিক্রিয়ার মাত্রা ও বিস্তৃতি কত দূর হবে, সেটাই এখন বিবেচনার বিষয়। এদিকে ইতিমধ্যে ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র আরও বেশি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।

৩ জানুয়ারি মার্কিন ড্রোন হামলায় ইরাকে ইরানের সবচেয়ে প্রভাবশালী সেনাধ্যক্ষ জেনারেল কাশেম সোলাইমানির হত্যা এবং ইরাকের অভ্যন্তরে মার্কিন ঘাঁটিতে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলাকে ছাপিয়ে আলোচনার কেন্দ্রে গত কয়েক দিন ছিল তেহরান বিমানবন্দর থেকে উড্ডীন হওয়ার পরে ইউক্রেনীয় বিমানের ধ্বংস হওয়ার ঘটনা। এই ঘটনা ঘটে ইরান যখন ইরাকে মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা চালায়, তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই।

ইরান প্রথমে একে দুর্ঘটনা বলে দাবি করলেও তিন দিন পরে স্বীকার করছে যে তার নিক্ষিপ্ত ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতেই বিমান ধ্বংস হয়ে ১৭৬ জন যাত্রীর সবাই প্রাণ হারিয়েছেন। এতে ইরানিরা ছাড়াও ছিলেন কানাডা, জার্মানি, আফগানিস্তানসহ অন্যান্য দেশের নাগরিকেরা; ফলে এর প্রতিক্রিয়া হয়েছে আন্তর্জাতিক। সোলাইমানিকে হত্যার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র সারা বিশ্বেই নিন্দিত হচ্ছিল এবং বৈশ্বিকভাবে ইরানের প্রতি সহানুভূতির মাত্রাই ছিল বেশি; ইরাকে মার্কিন ঘাঁটিতে ইরানের প্রতীকী হামলায় প্রাণনাশ না হওয়ায় এবং এই হামলার ব্যাপারে ইরাককে আগে থেকেই জানানোর কারণে সেই সহানুভূতি বড় রকমের হ্রাস হয়নি।

সেই সুযোগে ইরান একটি বড় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, যা সবার মনোযোগ আকর্ষণ করলেও আলোচনায় ততটা আসেনি। সেটি হচ্ছে ইরান ২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তি থেকে সরে এসেছে, ইরান বলেছে ওই চুক্তির আওতায় পারমাণবিক কর্মসূচিতে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ, মজুত, গবেষণা বা উন্নয়ন সীমিত রাখার যেসব শর্ত ছিল, সেগুলো তারা মেনে চলবে না। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এর পরে ইউরোপের দেশগুলোকে এই চুক্তি থেকে সরে আসার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন, কিন্তু তাতে কেউ কর্ণপাত করছিল না। কিন্তু বিমান বিধ্বংসের ঘটনা এবং তা অস্বীকারের চেষ্টা ইউরোপ এবং কানাডার কাছে ইরানের গ্রহণযোগ্যতা অনেকটাই হ্রাস করেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রোববার তেহরানে বিক্ষোভ চলার সময়ে ব্রিটেনের রাষ্ট্রদূতকে সাময়িকভাবে আটকের ঘটনা।

ব্রিটেনের রাষ্ট্রদূত রব ম্যাককেয়ারকে আটক করার কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে যে তিনি প্রতিবাদ বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন। সরকারি ভাষ্য হচ্ছে যে তাঁকে না চিনেই বিদেশি বলে আটক করা হয়েছিল; কিন্তু ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আধা সরকারি একটি বার্তা সংস্থার খবরে বলা হয়েছে, তিনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ‘সন্দেহজনক গতিবিধি এবং বিক্ষোভ সংগঠিত’ করছিলেন। রাষ্ট্রদূত তা অস্বীকার করেছেন। বিমান ধ্বংসের কারণ যে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ, তা জানার পর থেকেই ইরানিরা ক্ষুব্ধ হয়ে রাস্তায় নেমে আসেন। কয়েক দিন আগেই কাশেম সোলাইমানির জানাজা এবং মার্কিনদের বিরুদ্ধে ইরান সরকারের পক্ষে লাখ লাখ লোক সমবেত হয়েছিল; এই হত্যাকাণ্ডের কারণে শাসকেরা যে জাতীয়তাবাদী অনুভূতি তৈরি করতে পেরেছিলেন, তা কয়েক দিনের মধ্যেই তিরোহিত হয়েছে। তবে এখনো সরকারবিরোধী আন্দোলনের মাত্রা সেই উপস্থিতিকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি।

ইরানে গত কয়েক দিনের এই বিক্ষোভ অকস্মাৎ ঘটেনি। কেবল বিমান ধ্বংস নিয়ে ক্ষোভ এই ধরনের আন্দোলনের সূচনা করেনি। এই আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছে গত বছরের নভেম্বরে। সেই সময়ে গ্যাসোলিনের মূল্যবৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে ইরানের প্রধান প্রধান শহরে কয়েক সপ্তাহ ধরে বিক্ষোভ হয় এবং তা ছড়িয়ে পড়ে। সেই বিক্ষোভ মোকাবিলায় রেভল্যুশনারি গার্ডের সদস্যদের নামানো হয়েছিল। তাতে করে কমপক্ষে ৫০০ লোক মারা গেছেন—কেউ কেউ এই সংখ্যা ১৫০০ বলে দাবি করেছেন। নভেম্বরে বিক্ষোভের সূচনা হয়েছিল ১৫ নভেম্বর গ্যাসোলিনের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে। কিন্তু ক্রমেই এটি সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে এক ব্যাপক বিক্ষোভে রূপ নেয়। কেননা, ইরান এক বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে আছে।

ইরানের অর্থনৈতিক সংকটের একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে ২০১৮ সালের নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত নিষেধাজ্ঞা। এটি অন্যতম কারণ, কিন্তু একমাত্র কারণ নয়। অন্তত ইরানি নাগরিকদের একাংশ তা মনে করে না। তারা মনে করে, ইরানের অর্থনৈতিক সংকটের পেছনে আছে দুর্নীতি এবং ক্ষমতাসীনদের অব্যবস্থাপনা। যেমন দেশের অর্থনীতির ৬০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে রাজাভি ইকোনমিক ফাউন্ডেশন। আর তার ওপরে নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ড বাহিনী এবং গোয়েন্দা মন্ত্রণালয়ের। যেহেতু এই ফাউন্ডেশনের প্রধান হচ্ছেন আলী খামেনি, সেহেতু এই ফাউন্ডেশন কারও কাছে জবাবদিহি করে না, তারা করও দেয় না। ইতিমধ্যে তেলের উৎপাদন কমেছে। ২৮ লাখ ব্যারেল থেকে নেমে এসেছে ৫ লাখ ব্যারেলে। মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ। খাদ্যদ্রব্যের দাম বেড়েছে দ্বিগুণ। ইরানি মুদ্রার দাম কমেছে প্রায় ৬০ শতাংশ। ২০১৮ সালের মাঝামাঝি থেকে ইরানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির কোনো তথ্য প্রকাশ করে না। আইএমএফের হিসাবে অর্থনীতি সংকটে আছে। এমনও শোনা যায় যে অনেক মধ্যবিত্ত পরিবার বড় শহর থেকে ছোট শহরে বা গ্রামে চলে যাচ্ছে ব্যয় সংকোচনের জন্য।

গত বছরের নভেম্বরে আন্দোলনের সময় বিক্ষোভকারীরা বলেছিলেন যে তাঁরা চান না দেশের ভেতরে এই অর্থনৈতিক সংকটের সময়ে ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ড বাহিনী এই অঞ্চলের অন্য দেশের মিলিশিয়াদের অর্থ জোগাক। এই ধরনের বক্তব্যের কারণেই আন্দোলনের শেষ দিকটাতে রেভল্যুশনারি গার্ডের সদস্যরা, বিশেষ করে বাসজি মিলিশিয়ার সদস্যরা বিক্ষোভকারীদের ওপরে হামলা চালায় এবং বিক্ষোভকারীদের অনেকেই নিহত হন। তা সত্ত্বেও আন্দোলন ডিসেম্বরের শেষ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। কিন্তু সোলাইমানি হত্যাকাণ্ডের পরে অবস্থার বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে যায়। ট্রাম্পের আগ্রাসী ভূমিকা এবং সোলাইমানির হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ইরানের ভেতরে নাগরিকেরা আন্দোলন করেছিলেন তাঁদের নিজস্ব শক্তিতে গড়ে ওঠা সেই আন্দোলন প্রায় পর্যুদস্ত হয়েছিল।

এখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যতই ইরানের জনগণের পক্ষে টুইট করুন না কেন, তা আসলে ইরানের জনগণের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতি পক্ষপাত নয়। কেননা, ইরানের জনগণের অধিকারের বিবেচনা করলে আন্তর্জাতিক পরমাণু চুক্তি থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত তিনি নিতেন না। ওই চুক্তির মধ্য দিয়ে ইরানের ভেতরে মধ্যপন্থী মডারেট রাজনীতিবিদদের শক্তি ও প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছিল। নিষেধাজ্ঞা যতই কঠোর হবে, ইরানের ক্ষমতাসীনদের মধ্যকার রক্ষণশীল ও উগ্রপন্থীরাই লাভবান হবে তত বেশি। ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধংদেহী মনোভাব রাখলে উগ্রপন্থীরা তাকে কাজে লাগাতে চাইবে। মার্কিন প্রশাসনের পক্ষ থেকে যদি মাত্রাতিরিক্ত সমর্থনসূচক আচরণ করা হয়, তবে তাতে ইরানের শাসকেরাই লাভবান হবে। কেননা, তারা আবারও জাতীয়তাবাদের জিগির তুলতে পারবে।

ইরানে ১৯৭৯ সালের পর এত বড় ধরনের এবং এত দীর্ঘ সময় ধরে অব্যাহতভাবে আন্দোলনের কোনো ইতিহাস নেই, যদিও প্রায়ই বিভিন্ন ধরনের বিক্ষোভ এবং আন্দোলন হয়েছে। ইতিমধ্যে বিক্ষোভের স্লোগান উঠেছে, স্বৈরাচার নিপাত যাক। এমনকি ইরানে যা কল্পনার বাইরে ছিল—খামেনির দিকেও বিক্ষোভকারীরা আঙুল তুলছেন। ইতিমধ্যে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমির আলী হাজিজাদেহ, যিনি রেভল্যুশনারি গার্ডসের অ্যারোস্পেস কমান্ডার, এই ঘটনার জন্য দায় স্বীকার করেছেন। ফলে সরকার এই ধরনের ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের মধ্য দিয়েই এখনকার এই বিক্ষোভ সাময়িকভাবে প্রশমন করতে পারছে কি না, তা দেখার বিষয়। কিন্তু বিক্ষোভের প্রকৃত কারণগুলো উত্তরোত্তর আরও ব্যাপক রূপ লাভ করবে। দেশে ইতিমধ্যেই বেকারত্বের হার ১৭ শতাংশের কাছাকাছি, তরুণদের মধ্যে এই হার ২৮ শতাংশের বেশি। ইরানের সরকারি পরিসংখ্যান কেন্দ্রের পরিচালক অমিদ আলো পারসি ২০১৯ সালের শুরুতে বলেছিলেন যে ইরানের গ্র্যাজুয়েট তরুণদের মধ্যে বেকারত্ব ৪০ শতাংশ। লক্ষ করলেই দেখতে পাওয়া যায় যে, নভেম্বরে এবং গত কয়েক দিনের বিক্ষোভের অগ্রভাগে আছেন এই তরুণেরাই, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে থেকেই সরকারের বিরুদ্ধে স্লোগান উঠছে।

ইরানের বিরুদ্ধে মার্কিন প্রশাসন ও ট্রাম্পের আগ্রাসী আচরণ এবং যুদ্ধের হুমকির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধ বহাল রাখা জরুরি। ইরানের ওপরে অন্যায় যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টাকে বৈশ্বিকভাবেই মোকাবিলা করা দরকার, পাশাপাশি ইরানের নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকারের লড়াইয়েও পাশে দাঁড়ানো প্রয়োজন। দুটিই সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর