র‍্যাগিংবিরোধী কমিটি

রাষ্ট্রের অব্যাহত নীরবতার প্রেক্ষাপটে হাইকোর্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে র‍্যাগিংবিরোধী কমিটি গঠন করতে একটি যথার্থ নির্দেশনা দিয়েছেন। র‍্যাগিং ও বুলিয়িং কমবেশি বেদনাদায়ক বৈশ্বিক প্রবণতা। এটা মানবাধিকারের লঙ্ঘনও বটে। 

বুয়েটে আবরার হত্যাকাণ্ডের পর এটা আশা করা স্বাভাবিক ছিল যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নিজ গরজে র‌্যাগিংবিরোধী কমিটি করবে। কিন্তু তারা তা করেনি। বরং ছাত্ররাজনীতি–বিষয়ক বিতর্কে অংশ নিতে কার্যত তাদের অনেককে উৎসাহী দেখা গেছে। গত ৯ অক্টোবর রিটকারী সাত দিন সময় দিয়ে সংশ্লিষ্টদের আইনি নোটিশ দেন। কিন্তু তাতেও কাজ হয়নি। আইনি নোটিশ বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে আদালতের নির্দেশনা উপেক্ষা করা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে।

আমরা আশা করব, আবরার হত্যাকাণ্ডের পটভূমিতে হাইকোর্ট আগামী তিন মাসের মধ্যেই কমিটি গঠনের যে নির্দেশনা দিয়েছেন, তা তামিল হোক। এই বিষয়ে যেকোনো ধরনের কালক্ষেপণ অমার্জনীয় বিবেচিত হওয়া উচিত। কারণ, যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে একইভাবে হাইকোর্ট কমিটি করতে বলেছিলেন। কিন্তু বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সেই কমিটি গঠিতই হয়নি। আবার কোথাও গঠিত হলেও তা কাগজে-কলমে রয়ে গেছে। এই মনোভাব পরিহার করতে হবে। 

 এই জনগুরুত্বসম্পন্ন মামলাটির শুনানি যাতে দ্রুত সম্পন্ন হয়, সে জন্য অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছে সক্রিয় ও অগ্রণী ভূমিকা প্রত্যাশিত। কারণ, তাঁর দপ্তর তৎপর না হলে প্রস্তাবিত কমিটি গঠন প্রক্রিয়া পিছিয়ে যাবে। আমরা তখন দেখব, রাষ্ট্রপক্ষ রুটিনমাফিক সময় বাড়ানোর দরখাস্ত হাতে হাজির হচ্ছে। স্বরাষ্ট্রসচিব, শিক্ষাসচিব ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যানসহ বিবাদীদের চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। তঁারা এই বিষয়ে প্রতিবেশী ভারতের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারেন। 

ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ২০০১ সালে র‍্যাগিংবিরোধী নীতিমালা জারি করেন। তবে বুয়েটের ঘটনায় আমরা ২০০৯ সালে হিমাচল প্রদেশের উদাহরণটিকে সব থেকে প্রাসঙ্গিক মনে করি। সেখানে চিকিৎসাশাস্ত্রে পড়ুয়া নবাগত শিক্ষার্থী হত্যার ঘটনায় তাঁর চার অগ্রজ ছাত্রের মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি কলেজের অধ্যক্ষ, যাঁর কাছে নিহত ছাত্রটি অভিযোগ করেও প্রতিকার পাননি, তঁাকে বাধ্যতামূলক অবসরে যেতে হয়েছে। বুয়েটের ঘটনায় ভিসির অপসারণের দাবি অপূর্ণই থেকেছে। 

 র‌্যাগিংয়ের অভিযোগ বিশ্বাসযোগ্য হলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেই বাদী হয়ে থানায় এজাহার দায়ের করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ২০০৭ সালে ভারতের রাঘবন কমিটির কিছু পর্যবেক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ। তারা বলেছিল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সহশিক্ষা কার্যক্রমের ঘাটতি র‍্যাগিং বাড়ার জন্য দায়ী। এ ধরনের অপরাধ কমাতে নবাগত ও জ্যেষ্ঠদের মধ্যে আলাপ-আলোচনার সুযোগ তৈরি, আবাসন সংকট দূর, ক্যাম্পাসের বাইরে থাকা ছাত্রাবাসগুলোর নিবন্ধন ও তদারকি দৃঢ় করা প্রয়োজন। এসব আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটেও প্রযোজ্য। ভারত আমাদের ৯৯৯–এর মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ২৪ ঘণ্টা খোলা র‍্যাগিংবিরোধী বিশেষ সেল খুলেছে। এ ধরনের সেল খোলা থাকলে তা র‍্যাগিং বা যৌন হয়রানি প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করতে পারে। 

তবে সার্বিক বিচারে জনস্বার্থে করা রিটের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারক সৃষ্ট আইন বা নীতিমালা অনুসরণে আমাদের দেশের রেকর্ড প্রীতিপ্রদ নয়। এটা অনিচ্ছুক ঘোড়াকে পানি খাওয়ানোর মতো একটি বিষয়। আমরা মনে করি, সংসদের চলতি অধিবেশনে নির্দিষ্টভাবে র‍্যাগিংবিরোধী নির্দিষ্ট আইন করার বিষয়টি আইনপ্রণেতারা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে পারেন।

যদি এমনটা প্রতীয়মান হয় যে, র‍্যাগিং বা বুলিংয়ের সঙ্গে জড়িতরা ক্যাম্পাসগুলোতে বোধগম্য কারণে প্রভাবশালী, তাহলে সংসদীয় আইন শ্রেয়তর। এটি সংশ্লিষ্টদের প্রতি বেশি জোরালো বার্তা পৌঁছাবে।