আচার্যের বক্তব্য সঠিক, কার্যকর করবেন কে?

আবুল মোমেন
আবুল মোমেন

রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ একজন ব্যতিক্রমী মানুষ। তিনি বরাবর গণমানুষের কাছাকাছি থেকে জনসেবার রাজনীতি করেই ধাপে ধাপে শীর্ষ পদে উঠেছেন। সংসদীয় গণতন্ত্রে এ পদটি আলংকারিক এবং বর্তমানে তাঁর কর্মক্ষেত্র ও কর্মজীবন সম্পূর্ণ আনুষ্ঠানিকতানির্ভর। তিনি বিভিন্ন সময়ে একে বন্দিজীবন আখ্যায়িত করে তাঁর নিঃসঙ্গতার একঘেয়েমির অনুযোগ করে থাকেন। তবে এই আলংকারিক পদের আনুষ্ঠানিকতার মধ্যেও রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ও সর্বমান্য পদের যে অভিভাবকত্বের সুযোগ আছে, তা কাজে লাগানো যায়। জনগণ এবং বিশেষভাবে বিরোধী দল সময় সময় তাঁর কাছে অভিভাবকের বিবেক ভূমিকা প্রত্যাশা করে থাকে।

রাষ্ট্রপতি পদাধিকারবলে দেশের সব পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য। তিনিই উপাচার্য নিয়োগ দিয়ে থাকেন, যদিও আমাদের বাস্তবতায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যে প্রস্তাব আসে, তা অনুমোদন বা তাতে অনুস্বাক্ষর দেওয়া ছাড়া তাঁর পক্ষে অন্য পদক্ষেপ নেওয়া কঠিন, এর রেওয়াজও তৈরি হয়নি। তবে একবার তিনি সরকারি দল ও বিরোধী দলের মধ্যে সৃষ্ট অচলাবস্থা নিরসনে মধ্যস্থতার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তা ফলপ্রসূ না হলেও বোঝা যায় রাষ্ট্র ও সমাজের কল্যাণে তিনি যেমন কথা বলতে পারেন, তেমনি উদ্যোগও নিতে পারেন।

সম্প্রতি ঢাকা ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি সমাবর্তন বক্তৃতায় আচার্য আবদুল হামিদ সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চলমান দুর্নীতি, অব্যবস্থা, শিক্ষকদের কাজে অবহেলা, র‍্যাগিংয়ের মতো নিষ্ঠুরতা বন্ধে ব্যর্থতা ইত্যাদি নিয়ে সমালোচনা করেছেন। গত ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫২তম সমাবর্তনে তিনি সান্ধ্য কোর্স পরিচালনা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান ও গবেষণার মূল কাজের বাইরে নানা অর্থকরী কাজে শিক্ষকদের বাড়তি আগ্রহের কেবল সমালোচনাই করেননি, এসব বন্ধের আবেদন জানিয়েছেন। পরে ১১ জানুয়ারি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তনে প্রধান অতিথির ভাষণে রাষ্ট্রপতি সরাসরি কোনো কোনো উপাচার্যের দুর্নীতি বা দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার কঠোর সমালোচনা করেছেন। লিখিত বক্তৃতার বাইরেও তিনি তাঁর স্বভাবসুলভ লঘু চালে ছাত্রদের অনিয়ম-অন্যায়ের যেমন, তেমনি শিক্ষক-অভিভাবকদের দুর্নীতিরও কঠোর সমালোচনা করেছেন।

রাষ্ট্রপতির এসব সমালোচনা জনগণকে আশ্বস্ত ও আশাবাদী করেছে। আদতে আলংকারিক হলেও রাষ্ট্রের শীর্ষ পদ থেকে বিবেকী উচ্চারণ হলে তার কিছু প্রভাব যে সংশ্লিষ্টদের ওপর পড়ে, তা বোঝা গেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সান্ধ্য কোর্স বন্ধে তাঁর বক্তব্যের পর কর্তৃপক্ষ এখন ভাবনাচিন্তা করতে বাধ্য হচ্ছে। সান্ধ্য কোর্স থাকা অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও বিষয়টি নিয়ে নড়াচড়া হচ্ছে। মনে হয় এবং আশার কথা, রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ আচার্য হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজকর্মের নৈতিক দায় অনুভব করেন এবং এ ক্ষেত্রে তাঁরও যে কিছু করণীয় আছে, সেটাও তিনি মানেন। আমরা কেবল বলব সমাবর্তনে বা অন্যান্য ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিক ভাষণে তাঁর ভূমিকা সীমাবদ্ধ থাকবে না। রাষ্ট্রপতি ও আচার্য হিসেবে তিনি আরও সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিতে পারেন, যাতে এ ধরনের অনিয়ম বন্ধে উপাচার্য, শিক্ষক, ছাত্র ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা তাগিদ অনুভব করেন। রাষ্ট্রপতির সাম্প্রতিক বক্তব্যের পেছনে তাঁর যে অভিপ্রায় প্রকাশ পেয়েছে, তাতে জনমতেরই প্রতিফলন ঘটেছে বলে আমরা মনে করি। তবে কেবল বক্তব্য নয়, আচার্য হিসেবে দায়িত্বটা যে তাঁর এবং এর প্রতিফলন নাগরিক হিসেবে আমরা দেখতে চাই।

অভিভাবক হিসেবে রাষ্ট্রপতির এই নৈতিক বিবেকী ভূমিকা রাষ্ট্রের অন্যান্য ক্ষেত্রেও প্রয়োজনে তিনি প্রয়োগ করতে পারেন। আমরা লক্ষ করছি, নির্বাহী বিভাগ অনেক ক্ষেত্রেই সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও স্থবিরতায় ভুগছে, অনেক প্রয়োজনীয় জরুরি সংস্কারকাজ, যেমন প্রাথমিকের সমাপনী পাবলিক পরীক্ষা বন্ধে বা প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করার বিষয়টি ভাবনা বা সুপারিশে থেমে আছে। কিন্তু শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং প্রাণবন্ত বিবেকবান মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন নবীন প্রজন্ম তৈরির কাজ এতে ব্যাহত হচ্ছে। একইভাবে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে শক্তিশালী করা বা উচ্চশিক্ষা কমিশন গঠনের বিষয়টি এখন পর্যন্ত আলোচনায় সীমাবদ্ধ রয়েছে। আটকে আছে শিক্ষা আইন, শিক্ষানীতিরও যথার্থ প্রয়োগ নেই। এ ছাড়া সংসদের ভূমিকা ও সুশাসনের অভাব জনমনে উদ্বেগ ও হতাশা সৃষ্টি করছে, যা কার্যত গণতন্ত্রকে প্রায় তাৎপর্যহীন করে তুলেছে।

অভিজ্ঞতার আলোকে এখানে দুটি কথা বলতে চাই। রাষ্ট্রপতি স্বভাবগতভাবে রসিক মানুষ এবং একজন মাঠের রাজনীতিবিদ হিসেবে তাঁর সমর্থক জনগণের সঙ্গে নানা মাত্রার রসিকতায় অভ্যস্ত। মনে হয় রাষ্ট্রপতি বা আচার্যের আনুষ্ঠানিক ভূমিকা পালনের সময় রসিকতার মাত্রা নিয়ে একটু ভাবার সুযোগ আছে। অর্থাৎ কোথাও কোথাও রুচির সীমা টানার কথা ভাবা যেতে পারে। রাষ্ট্রপতি পদটি রাষ্ট্রের এমন এক শীর্ষ পদ, যা প্রায় সম্পূর্ণভাবে দায়মুক্তির সুবিধা ভোগ করে থাকে। তাঁকে মহামান্য বলা হয়। তাই তাঁর কথা বা বক্তব্যই একধরনের নির্দেশ বলে বিবেচিত হওয়া উচিত।

বর্তমান রাষ্ট্রপতির সঙ্গে এ বক্তব্য প্রাসঙ্গিক না হলেও অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে প্রসঙ্গক্রমে এ কথাটি বলতে চাই যে, রাষ্ট্রপতির পদটি মর্যাদার। বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি পদের সম্মান অনেকেই রাখতে পারেননি। পূর্ববর্তী একাধিক রাষ্ট্রপতি মেয়াদ শেষে আবার মন্ত্রী বা সাংসদ হয়েছেন, এমনকি একজন দল ত্যাগও করেছিলেন। সাধারণত রাষ্ট্রপতি, প্রধান বিচারপতি বা সেনাপ্রধানের মতো পদ থেকে অবসরের পরে কোনো রাজনৈতিক বা পেশাগত দায়িত্ব গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয় নয়। আমাদের একাধিক সেনাপ্রধান রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন, একাধিক সচিব তা-ই করছেন। যখন এমন একজনকে রাজপথে সাধারণ পুলিশ লাঠিপেটা করে ও তাঁর রক্তাক্ত ছবি পত্রিকায় ছাপা হয়, এটা তাঁর পদের উচ্চতা এবং মর্যাদা ক্ষুণ্ন করে। আইনে বাধা না থাকলেও সবাই সব কাজ করতে পারেন না, করা উচিতও নয়। কারণ, বস্তুত মানবসমাজ আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হলেও চলে কিন্তু সামাজিক রীতি–রেওয়াজ এবং পরম্পরার দ্বারা। এটি মানবসমাজের সংস্কৃতি, মানুষই এই সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য নির্মাণ করে। তাকে অগ্রাহ্য বাÿক্ষুণ্ন করা ঠিক নয়।

তবে আমরা জানি, বর্তমান রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এ ধরনের পদ কিংবা ক্ষমতার জন্য নিজের আদর্শ বা নীতির সঙ্গে আপস করেননি। আমাদের প্রত্যাশা যে, তিনি আমাদের দেশে রাষ্ট্রপতি পদের উজ্জ্বল ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করবেন।