উন্নয়ন অনুকূল সংস্কৃতিতে বর্ষটি উদ্যাপিত হোক

এ বছর আমাদের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, স্বাধীনতার স্থপতির জন্মশতবার্ষিকী। এর পরের বছরই স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। দুটি বছরজুড়ে ব্যতিক্রমী উন্নয়ন অনুকূল কর্মসূচির মাধ্যমে আমরা ঘুরে দাঁড়াতে পারি দক্ষিণ কোরিয়ার মতো, যারা একসময় উন্নয়নের মাপকাঠিতে আমাদের সমকাতারে দাঁড়িয়ে ছিল, আর এখন স্যামসাং মোবাইল দিয়ে তারা বিশ্ব দখল করে নিয়েছে, জাপানের মতো যারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ থেকে বের হয়ে এসে মাত্র ১৯ বছরের মধ্যে অলিম্পিক খেলা আয়োজনের আগেই বুলেট ট্রেন চালু করে সারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। 

আমাদের সুপ্তশক্তি অনেক, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে সামনে রেখে এই সুপ্তশক্তিকে উন্নয়নের কাজে লাগাতে হবে। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী এবং কারাগারের রোজনামচা বই দুটি পড়লে বোঝা যায় মূল্যবোধের বিচারে, ভিন্নমতাবলম্বীদের মতের প্রতি শ্রদ্ধার মাপকাঠিতে কালের স্রোতে আমাদের অবস্থান দুর্বল। সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ে তিনি কতটা অন্তঃপ্রাণ ছিলেন, নিজের আরাম-আয়েশ পরের স্বার্থোদ্ধারে কতটা অগুরুত্বপূর্ণ ছিল। গোটা জীবনটাই ছিল পরের কারণে স্বার্থ দিয়ে বলি, জনগণের কল্যাণে, সাধারণ মানুষের স্বার্থোদ্ধারে কতটা দুর্ভোগ পোহানো যায়, তারই উপাখ্যান। এই নিবেদিত প্রাণ মানুষের আদর্শের যারা সৈনিক, তাদের অবশ্যই ক্ষুদ্র মানুষের মতো আরাম-আয়েশ আর ভোগ করলে চলবে না, তাদের জীবন হবে অন্যের জন্য নিবেদিত। মনে রাখতে হবে সাধারণ মানুষকে উজ্জীবিত, অনুপ্রাণিত করতে ভোগ নয়, ত্যাগই সর্বোৎকৃষ্ট কার্যকর হাতিয়ার। সুতরাং ‘এক মুজিব লোকান্তরে লক্ষ মুজিব ঘরে ঘরে’ স্লোগানটি বাস্তবায়ন করার জন্য চাই আত্মত্যাগ। 

দেশের সাধারণ মানুষের, বিশেষ করে তৈরি পোশাকশিল্পের শিল্পীদের শ্রমে-ঘামে, প্রবাসে কর্মরত কর্মীদের হাড়ভাঙা শ্রমে, পরিশ্রমে, নিগৃহীত, বিড়ম্বিত জীবনের বিনিময়ে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার জোগানে আমাদের দেশটি অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছে, যদিও বৈদেশিক ঋণের বোঝা এখনো রয়েই গেছে। সুতরাং আরও অনেক কিছু করার রয়েছে, সকল পর্যায়ে এমন বলিষ্ঠ নেতৃত্বের জন্য গোটা জাতি অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় আছে। 

যুগে যুগে, কালে কালে, মহাপুরুষেরা জাতি, দেশের অগ্রগতি, স্বাধীনতা অর্জনের জন্য নির্ভোগ থেকে ত্যাগের পথ দেখিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু দেখিয়েছেন সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য, স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য অবলীলায় যেকোনো সময় কারাবাস হাসিমুখে মেনে নেওয়া যায়। যদিও দুঃখজনকভাবে এই স্বাধীন দেশে তিনি বেশি দিন থাকতে পারেননি। আমাদের সবাইকে বঙ্গবন্ধুর দেখিয়ে দেওয়া পথ অনুসরণ করতে হবে। বঙ্গবন্ধু ত্যাগের যে উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন, তা এককথায় অনন্য। দেশে এই উদাহরণগুলো অধিক হারে প্রতিষ্ঠা করা দরকার। এবং তা প্রতিষ্ঠা করার খুবই যোগ্য সেনানী হলো বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উদ্বুদ্ধ কর্মীরা। তারা সাধারণ মানুষের মধ্যেও এই ত্যাগের আদর্শ ছড়িয়ে দেবে, এটাই প্রত্যাশা। এ কাজের যোগ্য সময় হলো মুজিব শতবর্ষ, যার ধারাবাহিকতা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতেও বজায় রাখা প্রয়োজন। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী ’৭৫ সালের নারকীয় ঘটনার কোনোরকম প্রতিরোধ গড়তে না পারার ব্যর্থতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, তার বিশ্লেষণ করে আমাদের সঠিক পথে অগ্রসর হতে হবে। 

শহরভিত্তিক নয়—এমন সব দেশের মধ্যে আমাদের দেশটি সবচেয়ে জনঘনত্বপূর্ণ দেশ। মাথাপিছু প্রাকৃতিক সম্পদ সবচেয়ে কম। এই দেশকে অগ্রসর হতে হলে অবশ্যই সব কর্মকাণ্ডে ব্যয়সাশ্রয়ী হতে হবে, সাধারণ মানুষকে আগে রেখে এই গুণে উদ্বুদ্ধ করবেন সব স্তরের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা। হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পে যে উন্নয়ন হবে, তার চেয়ে ঢের বেশি, কার্যকর ও টেকসই উন্নয়ন হতে পারে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উদ্বুদ্ধ জনগোষ্ঠীর স্বেচ্ছাশ্রমে। দেশের বর্তমান আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে মুজিব শতবর্ষ উদ্‌যাপনের অংশ হিসেবে নিচের বিষয়গুলো আমি প্রস্তাব করতে চাই।

১। সব স্তরের নেতারা জনগণকে বিলাসবহুল জীবন ও ভোগের পরিবর্তে ত্যাগ ও মিতব্যয়ী জীবনযাপনে, দেশীয় পণ্য ও সেবা গ্রহণ করতে সাধারণ জনগণকে উদ্বুদ্ধ করবেন। যেসব শিল্পোদ্যোক্তা প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেও বাংলাদেশের শিল্পকে দেশে ও বহির্বিশ্বে তুলে ধরে কর্মসংস্থান করছেন, বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করছেন এবং গোটা জাতিকে আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান করছেন, তাঁদের জন্য সহযোগিতার হাত প্রসারিত করা উচিত। 

২। জনগণকে আইনকানুন মেনে চলতে এবং বেআইনি কাজ করা থেকে বিরত রাখতে উৎসাহিত করবেন, যেমন রাস্তাঘাট, সরকারি জমি, নদীর তীর দখল, চাঁদাবাজি করা। কোনো পর্যায়ের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরাই আইনশৃঙ্খলা নিজের হাতে তুলে নিয়ে অরাজক অবস্থার সূচনা করবেন না। 

৩। ঢাকা শহরের চারদিকে প্রাকৃতিকভাবে জলাশয় রয়েছে, এই জলাশয় ব্যবহার করে নৌপথ এবং তার পাশে চক্রাকার রাস্তা তৈরি করে রাজধানীর রাস্তার ওপর যেমন চাপ কমানো সম্ভব, ঠিক তেমনই চক্রাকার জলাশয় শহরের পরিবেশ রক্ষায়ও প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করতে পারে। আন্তজেলা যানবাহনগুলো চক্রাকার পথ ব্যবহার করে রাজধানীতে প্রবেশ না করেই কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে। একই সঙ্গে রাজধানীর যানবাহনও এই চক্রাকার পথ ব্যবহার করে রাজধানীর যানজট কমাতে অবদান রাখতে পারে। এমন একটি চক্রাকার রাস্তা ও জলাশয় স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে তৈরিতে রাজধানীর স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩০-৪০ লাখ ছাত্রসহ যুব সম্প্রদায়কে উৎসাহিত করা উচিত। দেশ গঠনের এই কাজের মাধ্যমে আমাদের তরুণ সম্প্রদায়ের মধ্যে দেশের প্রতি মমতা ও ভালোবাসা তৈরি হবে। 

এই ইচ্ছাতালিকা কিছুটা প্রতীকী। এটাকে যুক্তিসংগতভাবে সমৃদ্ধ করে বাস্তবায়ন করাই হবে মুজিব শতবর্ষ উদ্‌যাপনের শ্রেষ্ঠ উপায়।

মোহাম্মদ কায়কোবাদ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)–এর শিক্ষক ও ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস