নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা ও সম্ভাবনা

বিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন একই সঙ্গে শঙ্কা ও সম্ভাবনা নিয়ে হাজির হচ্ছে। শঙ্কা হলো চট্টগ্রামের উপনির্বাচনের মতো ভোটকেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতি কম হয় কি না (ভোট পড়েছে ২৩ শতাংশের মতো)। বিএনপি সেখানকার মতো কারচুপির অভিযোগ করে কি না। হারলে কারচুপির অভিযোগ নতুন নয়, কিন্তু ২৩ শতাংশ ভোটারের উপস্থিতিটা লক্ষণীয়। এটা ভোটের প্রতি মানুষের অনীহার নির্দেশক। 

সম্ভাবনা হলো ভালো ও ব্যতিক্রম কিছু ঘটে কি না। মুজিব শতবর্ষের ক্ষণগণনার মধ্যে নির্বাচনটি হবে। একটা শুদ্ধতা প্রত্যাশিত। এ কথা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, অবাধ নির্বাচন হলে লড়াইটা জমবে। কিন্তু অবাধ যে হবে, সেটা মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হতে হবে। খবর বেরোচ্ছে, প্রধান দুই দলই আচরণবিধি ভঙ্গ করছে। একজন ভিন্নমতাবলম্বী (কারও কাছে বিএনপিপন্থী) নির্বাচন কমিশনার বলেছেন, বিধি প্রণেতারাই বিধির বিরুদ্ধাচরণ করছে। গোটা নির্বাচন প্রক্রিয়ায় এই প্রচারণাপর্ব একটি দিক মাত্র। দুই দলই সমানভাবে বিধি ভঙ্গ করতে পারে, কিংবা পারে না, সেই বিষয়ে জনমনে একটা স্পষ্ট ধারণা আছে। 

নির্বাচন অবাধ হতে দিলে কী ফল দাঁড়াবে? একজন মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান, কারাবন্দী তিনবারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া কিংবা নির্বাসিত তারেক রহমানের ভাবমূর্তি বিএনপির মেয়র প্রার্থীদের বড় সুবিধা দেবে—এমন ভাবা সহজ নয়। অন্যদিকে সরকারি দল রাজধানী ঢাকার দুটি সিটি নির্বাচনেই যদি হেরে যায়, তাহলে সেটা সরকারকে দুশ্চিন্তায় ফেলে দেবে, এমনটা ধরে নেওয়ারও কারণ নেই। সিলেটের মেয়র পদটি বিএনপির থাকার কারণে সরকার রাজনৈতিক লভ্যাংশ পাচ্ছে। তবে সংকটটা খালি চোখে অবাধ নির্বাচনসংশ্লিষ্ট হলেও বাস্তবে তা আরও গভীর। 

গত এক দশকে সরকারের ভেতরে সরকার, সমাজের ভেতরের সমাজ, দলের ভেতরে দল গড়ে উঠেছে। এই স্তরগুলো নানা ধরনের ক্ষমতা পরিকাঠামো ও ক্ষমতা উপকাঠামো তৈরি করেছে। কিন্তু কোথাও কোনো ধরনের পদ্ধতিগত বিকেন্দ্রীকরণ ঘটেনি বা স্বচ্ছতার বিষয়ও নেই। আমরা দেখেছি নির্বাচিত সিটি মেয়রদের ক্ষমতা সংকুচিত হয়েছে। তাঁদের ওপর কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব ও খবরদারি আরও বেড়েছে। 

মেয়র সাঈদ খোকন একটি মেয়াদ পার করেছেন, তিনি তাঁর প্রয়াত বাবার উচ্চারিত ‘নগর সরকারের’ ধারণা ভুলেও মুখে আনেননি। সবাই ধরে নিয়েছেন, নগর সরকারের কাছে অধিকতর ক্ষমতা অর্পণ বা নিদেনপক্ষে একটা বড় ধরনের সংস্কার আনার বিষয়টি আর বাস্তবসম্মত চিন্তা নয়। যেভাবে চলছে, সেভাবেই চলুক। অথচ রাজধানী ঢাকার শাসনব্যবস্থায় দরকার ব্যাপকভিত্তিক পরিবর্তন আনা। নগর প্রশাসনের সঙ্গে নাগরিকের সম্পর্ক এখনো ভীষণ আলগা, অগোছালো এবং নৈরাজ্যপূর্ণ। যেমন সামরিক শাসনামলে যে করকাঠামো আরোপ করা হয়েছিল, আজ পর্যন্ত তাতে পরিবর্তন আনা হয়নি। এখন আপনি যদি সেবা ও করসীমার যৌক্তিকীকরণের কথা বলেন, তাহলে করহার বাড়বে। কিন্তু নগরবাসী তা নাকচ করবেন। কারণ, তাঁরা ইতিমধ্যে বিভিন্ন ধরনের বাহিনী ও গ্রুপকে অবৈধ ‘কর’ দিতে দিতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। তাঁরা নিশ্চিত জানেন, করহার বাড়ানো হলে শুধু তাঁদের বোঝাটা আরও বাড়াবে। অধিকতর ভালো সেবা তাঁরা পাবেন না। চাঁদাবাজি ও দুর্নীতির কারণে প্রতিদিন তাঁদের যে বাড়তি টাকাটা দিতে হয়, সেটার কোনো লাঘব হবে না। 

এই নির্বাচনের বড় পরিহাস হলো, এটা একটা রুটিন ভোটযজ্ঞ। গতানুগতিক, গা–সওয়া। ভোট হবে ইভিএমের মাধ্যমে। সুতরাং উদ্বেগ থাকবে। বিশেষ করে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের একটি রায় আমরা স্মরণ করাব। ভারতের ইসি ইভিএম চালু করে সমস্যায় পড়েছিল। কারণ, এর বৈধতা বা শুদ্ধতা চ্যালেঞ্জ হলে ইসি সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারেনি। এর ফলে একটা পরিবর্তন এল। সুতরাং বাটন টেপাই শেষ কথা থাকল না। সঙ্গে একটি পেপার ট্রেইল যুক্ত করা হলো। আমাদের ইসির ভারতীয় ইসির ওই অভিজ্ঞতা অজানা থাকার কথা নয়। কিন্তু তারা সেটা নিল না কেন? এই ইভিএম যদি পদ্ধতি হিসেবে অকার্যকর বা বিতর্কিত বিষয় বলে গণ্য হয়, তাহলে ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে তার একটা অভিঘাত থাকবে। 

৩০ জানুয়ারির ঢাকাই নির্বাচনী প্রচারণা বিতর্ক দেখাচ্ছে, আমরা কীভাবে নন–ইস্যুকে ইস্যু করতে পারি। ইস্যু হওয়ার কথা চলমান মেয়র নির্বাচনের ধাঁচ। সেটা রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির। একজন ব্যক্তি মেয়রের ওপর সব মনোযোগ এসে পড়ছে। এতে গণতন্ত্র পরাস্ত হচ্ছে। এটা বদলানো উচিত। বিদ্রোহী কাউন্সিলররা নির্বাচিত হলে কী হবে, তা পরিষ্কার নয়। বহু উপ–আইন তৈরি করে নগর ভবন। কিন্তু তা আমলাতন্ত্রের ধারায়। এই ধরনের বিষয়ের বদল দরকার, তা কেউ বলে না। 

ভালো ভোটের জন্য কতগুলো সামাজিক ও রাজনৈতিক পূর্বশর্ত দরকার। কিন্তু সেগুলো বেমালুম ভুলে থেকে আমরা ভান করছি। সেই ভানটা হলো; ‘নির্বাচন অবাধ হওয়াটা ইসির ওপরই নির্ভর করছে। সিইসি বা ইসি টিম চাইলে ৩০ জানুয়ারি ভালো ভোট হবে, নইলে হবে না। ইসি চাইলেই অতীতের ধারাবাহিক দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলে শক্তিশালী হতে পারে। তারা রাতারাতি এতটাই শক্তি অর্জন করতে পারে যে, তারা সরকারি দলের যেকোনো ধরনের আইন লঙ্ঘন বা অভিপ্রায়কে “না” বলতে পারে।’ বিষয়টি বরং উল্টো। ইসি অবাধ নির্বাচন না চাইলেও সরকার যদি চায়, তা হলেই অবাধ নির্বাচন হবে। ইসি ঠেকাবে না, ঠেকাতে পারবেও না। 

মুজিব শতবর্ষের প্রতি আমরা যদি শ্রদ্ধা জানাতে চাই তাহলে সরকারকে প্রমাণ দিতে হবে যে, তারা ভালো ভোট দেখতে চাইছে। এটা ৩০ জানুয়ারির অনেক আগেই স্পষ্ট করতে হবে। ৩০ জানুয়ারি মানুষ উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট দেবে বা দিতে পারবে কি না, সেই প্রশ্ন ভোটের আগমুহূর্ত পর্যন্ত অমীমাংসিত থাকবে। এটাই সব থেকে বেশি উদ্বেগের। বিএনপি ভোটের দিনে প্রার্থিতা তুলে নিতে পারে না, তা–ও হলফ করে বলা যায় না।

মিজানুর রহমান খান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক